বর্ষার গল্প
কোনো এক বরষায়...
বাহিরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, বেলকনিতে বসে চায়ের কাপে চুমুক লাগিয়ে বৃষ্টির মুর্ছনা উপভোগ করছি। মাঝে মাঝে হাতের তালু দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটাকে আটকানোর চেষ্টা করছি কিন্তু হচ্ছে না, আঙ্গুলের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছে, থামানো যাচ্ছে না। যেমনটি আটকানো যায়নি আমার প্রেমিকা বৃষ্টিকে; বৃষ্টি তার ছদ্মনাম, কোন এক বরষায় হঠাৎ প্রথম দেখা। আজকের মত সেদিনও মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। তখন ছিল শ্রাবণ মাস, এই রোদ, এই বৃষ্টি। কাজ শেষে বাইক চেপে বাসায় ফিরছিলাম। আকাশ ছিল মেঘলা, অনেকটা পথ পেরুনোর পর হঠাৎ নামলো বৃষ্টি। আমি তড়িঘড়ি বাইক থামিয়ে একটা ছাউনিতে এসে দাঁড়ালাম। হঠাৎ একটা মেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। আহা! কি সুন্দর তার চাহনি, তার চোখ, তার লম্বা কালো কেশ, অসাধারণ মুগ্ধতা!
আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম! সে বৃষ্টিতে খানিকটা ভিজে গেছে। হাত দিয়ে কাপড় এবং চুল ঠিক করছিল। আমি রুমালটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম-লাগবে?
সে অনাগ্রহ ভরে বলল-নাহ, ধন্যবাদ।
-হয়তো লাগতে পারে, নিন।
সে কিছুটা ভেবে নিল, তারপর হাত বাড়িয়ে রুমালটা নিয়ে ভেজা চুল ও কাপড় ঠিক করতে লাগলো।
বললাম-বৃষ্টির দিন, ছাতা নিয়ে বের হতেন।
সে মুচকি হেসে বললো-আপনিও তো ছাতা নেন নাই।
নিজের কথাই নিজেই বিদ্ধ হলাম। অসাধারণ তার কণ্ঠস্বর, মুগ্ধকর নন্দিত হাসিটাও। তার সাথে আলাপ জমাতে অস্থির হয়ে পড়লাম কিন্তু কি বলে শুরু করব ভেবে পেলাম না। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করলাম, যেন বৃষ্টির এই ধারা আরো প্রবল হয়। সত্যি, বৃষ্টি আরও জোরে হতে লাগলো, মনে হলো যেন ভাগ্যদেবতা আমার পক্ষেই।
হঠাৎ সে রুমালটা বাড়িয়ে বলল- ধন্যবাদ!
আমি খুশি হয়ে বললাম-আমি বিপ্লব। একটা প্রাইভেট ফার্মে জব করি, আপনি?
সে বলল-ফারিয়া, পড়াশোনা করছি।
-একটা কথা বলব?
-বলুন!
-কিছু মনে নেবেন নাতো?
-মনে নেবো কেন! বলুন!
-সত্যিই বলছেন?
-হ্যাঁ বলুন!
-আপনি অনেক সুন্দর!
সে অপ্রস্তত হয়ে বলল-এটা কেমন কথা?
-মনের ভেতর বারবার খোচ্ছাছিল তাই বলে ফেললাম, কথাকে মুক্ত করে দিলাম! কথার স্বাধীনতাকে তো আর রোধ করতে পারি না! যদি চান তবে সরি বলতে পারি!
-থাক দরকার নেই-বলে মুচকি হাসি দিলো।
বুঝে গেলাম খুশি হয়েছে। তারপর একে একে কথার বিনিময় ঘটলো, পরিচয় হলো, চেনাজানা হলো। বর্ষা-বাদলের আশীর্বাদে আমাদের বন্ধুত্ব হলো তাই বর্ষা বাদলের দিনকে কৃতজ্ঞতা জানাতে ফারিয়াকে আমি বৃষ্টি বলে ডাকতাম। ওর ও খুব পছন্দ হয়েছিল নামটা। আমরা রাত জেগে ফোনে কথা বলতাম, ছুটির দিনে ঘুরতে বেরুতাম, রেস্টুরেন্টে বসে গল্প করতাম। আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম কিন্তু বলতে পারিনি। চাইলেই বলতে পারতাম কিন্তু বলিনি কারন আমি চেয়েছিলাম ভালোবাসার কথাটা ওর মুখ থেকে শুনতে। কতদিন, কত ছলে জানার চেষ্টা করেছি তবুও 'ভালোবাসি' কথাটি শোনা হয়নি, তবে অনুভব করতাম বৃষ্টিও আমাকে ভালোবাসে কিন্তু মুখ ফুঁটে বলত না।তবুও বিশ্বাস রেখেছিলাম, একদিন সে বলবে 'ভালোবাসি'!
এক বছর পর সেই শ্রাবণ মাস এলো ফিরে। আকাশে মেঘ জমে, অঝরে ঝরে বৃষ্টি, বৃষ্টির মুর্ছনায় হারিয়ে যাই আমি। আমি হাতের তালুতে বৃষ্টিকে আটকাতে চাই কিন্তু পারি না, আঙ্গুল বেয়ে চুয়ে চুয়ে গড়িয়ে পড়ে, ধরতে পারিনা; যেমনটি আমার প্রেমিকা বৃষ্টির ভালবাসি কথাটি আজও তালুবন্দি করতে পারিনি।
হঠাৎ বৃষ্টির ফোন এলো-কি করো?
-এইতো অফিসে, কাজ করি।
-আগামীকাল কি ছুটি নিতে পারবে?
-কেন বলোতো?
-তুমি সব ভুলে যাও!
-স্বীকার করে নিলাম, এবার বলো।
-মনে আছে তোমার গত বছর এই বর্ষার দিনে আমাদের দেখা হয়েছিল! পরিচয় হয়েছিল, তুমি আমার ফারিয়া নাম বদলে বৃষ্টি রেখেছিলে! মনে পড়েছে কি জনাব?
-বেশ মনে পড়েছে, চোখের সামনে এখনো ভাসে গত বছরের বর্ষা বিকেলে তোমার ভেজা চুল, ভেজা কাপড়ে আমার পাশে দাঁড়ানো, পরিচয়ের সূচনা, গল্পের সম্ভার সাজিয়ে বর্ষা উপভোগ! আহ, কি দারুন মুহূর্ত! সে কি ভোলা যায়!
-তাহলে কালকে আমরা বেড়াতে যাবো, আমরা ঘুরবো, বসে গল্প করব আর একটা কথা বলবো!
-মাত্র একটা কথা!
-হয়তো অনেক কথার ভিড়ে ওই একটি কথায় সব আলো কেড়ে নিবে, তাই বললাম।
আমি আবদার করে বললাম- তাহলে এখনি বলো, শুনি!
- জ্বি না মশায়! যখনকার কথা তখনই বলতে হয়, আগে নয়!
- ঠিক আছে ম্যাডাম, যেমন তোমার ইচ্ছা!
আমি বুঝেছিলাম সে আমাকে 'ভালোবাসি' কথাটি বলবে। আমি পুলকিত হলাম, আনন্দিত হলাম, অস্থির হয়ে উঠলাম আগামীকালের অপেক্ষায়।
সকাল হতেই আমার প্রস্তুতি শুরু হলো। আমি বাইক চেপে বৃষ্টির দেওয়া ঠিকানামত লোকেশনে এসে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি এলো। আমি প্রথম দিনের মত আবারও চেয়ে রইলাম। শাড়িতে বৃষ্টিকে অনেক সুন্দর লাগছিল, একদম নয়ন ভোলানো জাগানিয়া মুগ্ধকরী! বাতাসে ওর চুলগুলো উড়ছিল, তাই দেখে আমার হৃদয়ও দুলছিল। বৃষ্টি আমার কাছে এসে মুচকি হেসে বলল-এই যে মশাই! হা করে কি দেখেন?
-তোমাকে!
-মনে হয় আমাকে আগে দেখোনি!
-এমন সুকেশিনী, মিষ্টিময়ী, লাবণ্যময়ী অপরূপা মেয়েটিকে এমন সাজে দেখার সৌভাগ্য আগে ঘটেনি তো তাই!
-অনেক হয়েছে জনাব, এবার যাত্রা শুরু করো, নইলে পথে হবে দেরি, আকাশে মেঘ জমেছে, বলা যায় না, হঠাৎই নামতে পারে বৃষ্টি।
-বৃষ্টিতো আমার সামনে, মেঘের বৃষ্টি মেঘেই থাক, আমার বৃষ্টি আমারই থাক !
বুঝতে পারলাম, ‘আমার বৃষ্টি’ বলাতে বৃষ্টি লজ্জা পেয়েছে কিন্তু মনে মনে খুশিও হয়েছে। আর কথা বাড়ালাম না। বৃষ্টিকে বাইকে উঠিয়ে মনের আনন্দে যাত্রা শুরু করলাম কিন্তু জানতাম না সামনে আমার বৃষ্টির জন্য যমদূত অপেক্ষা করছে, জানলে আমি বৃষ্টিকে নিয়ে বের হতাম না।
আকাশে আগে থেকেই মেঘ জমেছিল হঠাৎ শুরু হল ঝড়, তারপর বৃষ্টি। সামনে দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না, ফাঁকা মাঠের মত। তাই দ্রুত জায়গাটা পার হবার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। সামনে থেকে আসা দ্রুতগতির একটি গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমাদের সজোরে ধাক্কা দিল। আমি সিটকে পড়লাম, জ্ঞান হারালাম! যখন জ্ঞান ফিরলো নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলাম। রক্তাক্ত শরীর আমার অসংখ্য ব্যান্ডেজে জড়ানো। প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হচ্ছিল, কথা বলতে পারছিলাম না কিন্তু বৃষ্টির জন্য আমার হৃদয় ভেঙে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল। আমি জানার চেষ্টা করছিলাম বৃষ্টির কি অবস্থা, কিন্তু কাউকে বোঝাতে পারছিলাম না। আমার এক বন্ধু সেখানে উপস্থিত ছিল, যে বৃষ্টির কথা জানত; জানতো আমি বৃষ্টির সাথে দেখা করতে বেরিয়েছিলাম। আমি বারবার তার দিকে তাকিয়ে গোঙড়াতে লাগলাম। ও আমার মনের ভাষা বুঝতে পারল। আমার কাছে বসে আমার হাতটি তার দুহাতে জড়িয়ে চুমু দিতে দিতে চোখের জল ছেড়ে দিলো। আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে লাগলো। আমি বুঝে গেলাম, বৃষ্টি আর নেই! বৃষ্টি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে! আমি গোঙড়াতে লাগলাম, মনে হলো আমি কোন অতল গহীন শূন্যে হারিয়ে যাচ্ছি! আমি আবার জ্ঞান হারালাম; বৃষ্টির হাসি, বৃষ্টির কথা, বৃষ্টির দুষ্টুমি আমার কানের এবং মনের চতুরপাশে ভেসে ভেসে বেড়ায়।
বৃষ্টিকে ভালোবেসে আজো আমি শূন্য হৃদয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াই। বৃষ্টি আমার বেঁচে থাকার প্রদীপ। আমার জেগে থাকায়, নিদ্রাগত হওয়ায় অথবা আমার স্বপ্নে কিংবা আমার আনমনা ভাবনায়, উদাসীনতায়, অস্থিরতায় সর্বত্রই মিশে আছে সে। বছরের পর বছর ঘুরে আসে বর্ষা। শ্রাবণের বৃষ্টিতে আমি ভিজে সিক্ত হই, বর্ষার বৃষ্টিতে দুহাত প্রসারিত করে উর্ধ্বপানে চোখ বন্ধ করে অনুভব করি আমার বৃষ্টিকে। অশ্রুজল আর বর্ষার বৃষ্টি মিলেমিশে একাকার হয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে জমিনের বুকে। বর্ষার ভালোবাসি কথাটি শোনা হয়নি কিন্তু প্রতিনিয়ত চিৎকার করে আমি বলে উঠি-ভালোবাসি বর্ষা, ভালোবাসি।
আমি বিশ্বাস করি, আমার ভালোবাসি কথার উত্তর দিতে আমার প্রিয়তমা বর্ষা একদিন আসবে ফিরে শ্রাবণের ধারায় কোন এক বরষায়.....
লেখক: মাঈন উদ্দীন, কুষ্টিয়া।