ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২৮
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
– বাব্বা অনেক কথা বললেন? আমি বাংলা বলতে পারিনা, তবে কিছু কিছু বুঝি। যাই আমি। ওই যে একদল শরণার্থী আসছে। ওদের ছবি তুলব।
রঘু রাই দ্রুতপায়ে হেঁটে যায় সীমান্তের কাছে। অঞ্জন দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবে আমিয়া যদি ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে আসত তাহলে ও শরণার্থী শিবিরের রাজপুত্র হয়ে যেত। পরক্ষণে নিজে নিজে হাসে। নিজেকে বলে, রাজপুত্র হওয়ার এত শখ কেন? ঢং দেখানোর জায়গা পাস না। হ্যাঁ, তাইতো। আমিও যাই। দেখি কারা এসেছে। পরিচিত কেউ থাকতেও পারে।
অঞ্জন এগিয়ে যেতে থাকে সীমান্তের কাছাকাছি। বুকের ভেতর প্রবল টান, যদি অমিয়া আসে ওর বাবা-মাকে নিয়ে। ওতো জানে অঞ্জন এখানে আছে। রঘু রাই শরণার্থীদের লম্বা সারির ছবি তোলে। চারপাশে ঘুরে অনেক ছবি তোলে। শরণার্থীদের অবস্থান ওর ক্যামেরায় ফুটে উঠতে থাকে। অঞ্জন খুব অনুপ্রাণিত হয়। ভাবে, মুক্তিযুদ্ধের দলিল হয়ে থাকবে এইসব ছবি। একসময় শরণার্থীর সারি যশোর রোডে ঢুকে যায়। অঞ্জন দেখতে পায় অমিয়া নেই। ওরা হয়তো ঢাকাতেই থেকে যাবে। শরণার্থী হবেনা।
বুকের ভেতর হাহাকারের ধ্বনি ওঠে। পরক্ষণে নিজেকে শাসায়। যুদ্ধের সময় প্রেমের বাতাস বুকে টানার দরকার আছে কি? কেন ওর মধ্যে এমন হাহাকার তড়পায়। নিজেকে শাসন করে ফিরে আসে সীমান্তের ভেতর। যারা এখানে নানা ধরণের কাজ করছে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করা দরকার। নানা মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য সহযোগিতা করা দরকার। নিজেকে শাসন করে রঘু রাইয়ের পেছনে হাঁটতে শুরু করে। রঘু রাই বলে, অনেক ছবি তুলেছি। কাল সকালে এখান থেকে চলে যাব। পত্রিকায় পাঠাব। ছাপা হবে। এসব ছবি দেখলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী আরও সক্রিয় হয়ে উঠবেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য চেষ্টা করছেন। এসব ছবি দেখে খুশি হয়ে বলবেন, জয় বাংলা।
অঞ্জন হাসতে হাসতে বলে, রঘুদা, তুমি প্রধানমন্ত্রীর মনের কথা বলে ফেললে।
– ঐ যে দেখ কেমন হাঁ করে কাঁদছে একটি বাচ্চা। আমি ওর ছবিটা তুলে নেই। এটা শরণার্থী জীবনের কষ্ট।
– না, আমাদের কোনো কষ্ট নেই। আপনাদের ভালোবাসায় আমরা স্বাধীনতার যুদ্ধের যোদ্ধা। শিশুরা আমাদের মাথার মণি।
রঘু রাই অঞ্জনের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে শিশুটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ছবি তোলে। বিশাল হাঁ করে কান্নারত শিশুটির ছবি উঠিয়ে অঞ্জনকে দেখিয়ে বলে, এটা শরণার্থী জীবনের দুঃখ।
– আমি মনে করি দুঃখ না। এটা বেঁচে থাকার সত্য।
– বাব্বা, তুমি কি কবি নাকি? কতগুলো কবিতা লিখেছ?
– সত্যি কথা বলার জন্য কবি হতে হবেনা। যে কেউ বলতে পারে।
– হ্যাঁ, ঠিক। তোমার কথা শুনে আমার মন ভরে গেছে। যাই আরও ছবি তুলি।
রঘু রাই একদিকে চলে যায়, তখন দূর থেকে কান্নার ধ্বনি ভেসে আসে। অঞ্জন শব্দ শুনে সেদিকে এগিয়ে যায়। তাঁবুর কাছে গিয়ে শুনতে পায় বয়সী জয়নুল মারা গেছে। ওরা পাঁচজন এসেছিল শরণার্থী হয়ে। ছেলে ইমরুল কাঁদতে কাঁদতে অঞ্জনের কাছে এসে দাঁড়ায়। দুহাতে চোখ মুছে বলে, বাবাকে তাঁর নিজ দেশে কবর দিব। সীমান্ততো কাছেই। নিজে যেতে অসুবিধা হবেনা। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।
– হ্যাঁ, অবশ্যই করব। আমরা ঘাড়ে তুলে নিয়ে যাব ওনাকে।
– ঘাড়ে তুলতে হবেনা। আপনি মাথার দিক ধরবেন, আমি পায়ের দিক। তাহলেই নিয়ে যেতে পারব। বাবাতো শুকনো মানুষ। ওজন বেশি না।
– কবর খুঁড়ব কীভাবে?
– আমার কাছে দা আছে। আগে চলেন দা দিয়ে গর্তের মতো খুঁড়ে আসি। কোনোরকমে মাটি চাপা দিলেই হবে। দাফনতো হবে না। কাফনের কাপড় নাই। ঠিকমতো গোসলও করাতে পারবনা। বাবা আমাদের সবসময় বলতেন, আমি মরে গেলে কোনোরকমে মাটি চাপা দিয়ে দিও। শরণার্থী মানুষের এভাবে কবর হবে।
চিৎকার করে কেঁদে ওঠে ইমরুল। একসময় দুহাতে চোখ মুছে বলে, আমার বাবা স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলেন না। হায় আল্লাহ–আবার কাঁদতে শুরু করে ইমরুল। অঞ্জন ওর ঘাড়ে হাত রেখে বলে, কষ্ট বুকের ভেতর ধরে রাখ। চোখের পানি ফেলতে হবেনা।
– কেন ফেলব না? ফেলবই।
ইমরুল আবার কাঁদতে শুরু করলে অঞ্জন ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। কানের কাছে মুখ রেখে বলে, চলো কবরের ব্যবস্থা করি।
তাঁবুর ভেতর কাঁদতে থাকে ইমরুলের মা আর দুই বোন। কান্নার শব্দ শুনে চারদিক থেকে লোকজন এসে জড়ো হয়। অনেকের চোখে পানি গড়ায়।
কেউ একজন আর একজনকে জিজ্ঞেস করে, তোরা কাঁদছিস কেন?
– কাঁদবনা কেন? আমরাতো সবাই শরণার্থী পরিবার। আমাদের পরিবারের একজন বাবা মারা গেলেন।
যে প্রশ্ন করেছিল সে সঙ্গে সঙ্গে পেছন হেঁটে চলে যায়। সরাসরি সীমান্তের কাছে এসে দাঁড়ায়। একজনের হাত থেকে দা নিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করে। বেশ বড় গর্ত করতে হবে। কাজটি শুধু দা দিয়ে সহজভাবে করা যাবে এটা অঞ্জনের মনে হয় না। ওভাবে একটা শাবল বা কুড়াল জোগাড় করতে পারলে মন্দ হয়না। ও শরণার্থী শিবিরের বিভিন্ন দিকে হাঁটতে শুরু করে। না, কোথাও কোনো তাঁবুর ভেতরে এসব নাই।
একজন খেঁকিয়ে বলে, শরণার্থী হয়ে বাঁচতে এসেছি। এইসব শাবল-কুড়াল ঘাড়ে তুলে আনব কেন?
– এনেছেন সবাই এটা আমি মনে করিনি। কেউ কোনো দরকারে আনতে পারে এটা ভেবে খোঁজ করছি।
– যাও ভাগ। আর খুঁজতে হবে না।
অঞ্জন আর কথা বলেনা। ভাবে তর্ক করে লাভ নেই। কোনো কোনো মানুষ এভাবে নিজেকে সাধারণের উপরে উঠায়। ও দ্রুত হেঁটে সীমান্তের কাছে গিয়ে একজনের হাত থেকে দা নিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করে। ওকে বলে তুমি কিছুক্ষণ বসে থাক। নইলে বালতিতে করে পানি আন। আমরা গোসল করিয়ে কবরে দেব।
– কাফনের কাপড়তো পাবনা। যে লুঙ্গি আর জামা পরে আছেন সেটাসহ কবরে নামাবো।
সবাই মিলে তাঁবুর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অঞ্জন তাঁর ছেলের সঙ্গে জয়নুলের মৃতদেহ উঠিয়ে নিয়ে আসে। নিয়ে যায় সীমান্তে। বালতিতে আনা পানিতে জামা-কাপড়সহ গোসল করিয়ে কবরে নামিয়ে দেয়। মতলুব বলে, আমরা সবাই মিলে বাবার জানাজা পড়ি।
– হ্যাঁ, হ্যাঁ পড়া উচিত। দাঁড়াও সবাই।
বয়সী খবিরউদ্দিন সবার সামনে দাঁড়িয়ে সুরা পড়তে শুরু করে। নিজ দেশের সীমান্তে জানাজা পড়া হয়েছে দেখে সবার বুকের ভেতর শান্তির হাওয়া বয়ে যায়। জানাজা শেষে বয়সী খবিরউদ্দিন যুদ্ধে শহীদ হওয়া মুক্তিযেদ্ধাদের জন্য দোয়া করে। সবাই খুব স্বস্তি পায়। মুক্তিযোদ্ধাদের লাশতো এখানে-সেখানে পড়ে থাকে। তাদেরনকে গণকবরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। সীমান্ত এলাকায় বেশ বড় ভিড় জড়ে ওঠে। সবাই বসে দোয়া করছে। দুহাত মুখের ওপর তুলে রাখে।
চলবে....
এসএ/