ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২৭
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
কেউ কেউ চেঁচিয়ে বলে, আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা।
– না, সবাই মুক্তিযোদ্ধা না। আমরা সবাই শরণার্থী। আমাদেরকে যুদ্ধ করে যোদ্ধা হতে হবে।
– ঠিক, ঠিক। আমরা সবাই যোদ্ধা হব। আমাদের হাতে স্বাধীনতার ফুল ফুটবে।
আমি চেঁচিয়ে বলি, চল চল আমরা এখন যে যার তাঁবুতে যাই। একদিন কেউ কেউ আমরা যশোর রোডে যাব।
– ঠিক বলেছিস। ওখানে গেলে স্বাধীনতার পক্ষে অনেক শিক্ষা পাব।
আমি আর কথা বলিনা। বুকের ভেতর কথা আটকে যায়। স্বাধীনতা লাভের শিক্ষাতো আমাদেরকে প্রতি মুহূর্তে শিখতে হবে। নিজেদের জমিন নিজেদের তৈরি করতে হবে। মনে মনে ভাবি, আমিও যশোর রোডে যাব। তবে কাউকে বলবনা। একা চলে যাব। এখান থেকে অনেকে চলে গেলে এলাকা শূন্য হয়ে যাবে। এটা হতে পারে না। যুদ্ধ করার জন্য সীমান্তের সব এলাকায় যোদ্ধাদের থাকতে হবে। সবার আত্মদানে স্বাধীনতার পতাকা উড়বে।
কয়েকটি দিন যায়। আমি তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে লোক চলাচল দেখি। আমার সামনে পাহাড়ভরা মাতৃভূমির সবুজ সৌন্দর্যকে বলি, মাগো তোমাকে ভালোবাসা আমার স্বপ্ন। এই ভালোবাসায় খুঁজে নেব মাতৃভূমির স্বাধীনতা। এমন সব ভাবনা বুকের ভেতর জমাট হয়ে থাকে। একদিন পাহাড়ের গাছের মাথায় পতাকা উড়িয়ে আসি। দূর থেকে দেখবে সবাই। বাঙালিরা যেমন দেখবে, পাঞ্জাবি সেনারাও দেখবে। দেখে ওদের চোখ পুড়ে যাবে। আর বাঙালির মাথার ওপর দিয়ে বয়ে যাবে স্বাধীনতার বসন্ত বাতাস। প্রত্যেকে বড় করে শ্বাস টেনে ছড়িয়ে দেবে বাতাসে।
আমার ভাবনায় আনন্দধ্বনি বাজতে থাকে। তিন-চার দিন পর মাকে বলে যশোর রোডে চলে আসি। দেখতে পাই সেদিন ওখানে একজন বিদেশি কবি ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে। যারা ইংরেজি বলতে পারেনা তারা হেসে মুখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকায়। হাসতে হাসতে হাততালি দেয়। আমি সবার পেছনে গিয়ে দাঁড়াই। শরণার্থী মানুষদের নিয়ে কবিতা লিখবেন তিনি। আমেরিকা থেকে এসেছেন। গর্বে-অহংকারে আমার বুক ভরে যায়। ভাবি, কবির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরব। পাশের একজনকে একথা বললে ও রেগে ধমক দিয়ে বলে, খবরদার না। এমন কিছু করলে আমাদের কাছে পিটুনি খাবি। তুই কোথায় থেকে এসেছিস? তোকে তো এখানে দেখিনি?
– আমি এখানে থাকিনা। দেখতে এসেছি। আপনারা আমার সঙ্গে এমন আচরণ করছেন কেন? আমিতো আপনাদের মতো শরণার্থী।
– তাতো বুঝতেই পারি। এখনতো এখানে বেড়াতে আসার সময় না।
– আমি কোথায় থাকব?
– আজকে গাছতলায় থাকতে হবে। পরে ইন্ডিয়ান ভাইয়েরা ব্যবস্থা করে দেবে।
– আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি ওই বড় গাছটার নিচে থাকব।
– যা, চলে যা। খাবি কি?
– জানিনা। বাতাস খাব।
– হা-হা করে হাসে সবাই। হাসতে হাসতে ইউনুস বলে, বাতাস খেয়ে বাঁচবি?
– বাতাস আমার মুক্তিযুদ্ধ। খেয়ে পেট ভরলে হবে স্বাধীনতা।
– বাব্বা, কথাতো না, কবিতা।
– চল, আমার বাড়িতে চল। তোকে কিছু খাওয়াব। তারপরে গাছতলায় যাবি। একটা মাদুর দেব। পেতে শুয়ে থাকবি।
দুজনে রাস্তা থেকে নেমে যশোর রোডের পাশে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবিরের ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকে। অল্পক্ষণেই দুজনে পৌঁছে যায় তাঁবুর সামনে। ইউসুফ ভেতরে ঢোকে। মুরশিদ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। চারদিকে শরণার্থী শিবির নিজের বুকে ধারণ করে। যশোর রোড ওর সামনে বিশাল হয়ে ওঠে। নিজেকে বলে, শরণার্থীর ভিড়ে যশোর রোড ভরে গেছে। যুদ্ধ! যুদ্ধ! তখন ইউসুফ বেরিয়ে ওকে তাঁবুর ভেতর নিয়ে বসায়। ওর বউ আমিনা সুজির হালুয়া বানিয়েছে। ওকে খেতে দেয়। মুরশিদ বাটি হাতে নিয়ে আমিনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলে, শরণার্থী জীবনে সুজির হালুয়া খেতে পারব ভাবি নাই।
স্বামী-স্ত্রী দুজনে আনন্দে হাসতে থাকে। মুরশিদ ওদের দিকে তাকিয়ে বলে, এ হাসি স্বাধীনতার। তারপর নিজেও হাসতে শুরু করে।
যশোর রোডে ঘুরে অঞ্জন এখন নিজেকেও শরণার্থী বলে। এখানে আসার আগে পর্যন্ত এমন ধারণা ওর ছিলনা। ভেবেছিল, কলকাতায় চলে যাবে। কলকাতার সল্ট লেকে শরণার্থীদের জন্য আস্তানা হয়েছে। এটা ও কারো কারো কাছে শুনেছে। ওখানে গিয়ে শরণার্থী হবেনা। সাধারণ মানুষের মতো জীবন কাটাবে। বলবে, আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দেব। আমার কোনো পিছুটান নাই। এখন যশোর রোডে হেঁটে চলে – মানুষের সঙ্গে কথা বলে শরণার্থীর জীবনে নিজেকে ঢোকায়। বলে, এটাই মুক্তিযুদ্ধের সত্য। এই সত্যের বাইরে যাওয়া উচিত না। নিজেকে প্রবলভাবে ধমকায়। বলে, এমন ভাবনা ভাবার কোনো যুক্তি নাই। বদমাইশি করার জায়গা পাস না তুই। এসব ভাবনার মাঝে কপালে হাত দিয়ে বলে, আর ভুল করবনা। আমার সামনে এখন যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো সত্য নাই। এটাইতো শরণার্থী জীবন কাটিয়ে ওঠার বড় দিক। দেশ স্বাধীন হলে বীরদর্পে স্বাধীন দেশে ফিরে যাবে।
যশোর রোডে হাঁটতে হাঁটতে একজন ভারতীয় ক্যামেরাম্যান দেখতে পায়। তিনি শরণার্থী শিবিরের বিভিন্ন ছবি তুলছেন। অঞ্জন তার সঙ্গে কথা বলার জন্য তাড়া অনুভব করে। নিজেকে বলে, এইসব ছবি হবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ডকুমেন্ট। এইসব ডকুমেন্ট স্মৃতির নিঃশ্বাস। ক্যামেরাম্যানের কাছে গিয়ে বলে, ভাই আপনার নাম কি?
– আমার নাম রঘু রাই। আপনার নাম কি?
– অঞ্জন।
– কোথায় থেকে এসেছেন?
– ঢাকা থেকে।
– আপনার বাড়ি কোথায়? আপনিতো বাংলা ভাষায় কথা বলছেন না?
– আমার বাড়ি পাঞ্জাবে। আমি দিল্লিতে থাকি। স্টেটম্যান পত্রিকার ক্যামেরাম্যান। অনেক ছবি তুলেছি। ছাপা হবে পত্রিকায়।
– ও আচ্ছা। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।
রঘু রাই ঘাড় নেড়ে নিজের খুশির কথা বলে।
– আপনি এখানে দাঁড়ান একটা ছবি তুলি।
অঞ্জন খুশি হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। রঘু রাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসে। রঘু রাই ক্যামেরা তাক করে বলে, হাসবেন না।
অঞ্জন হাসতে হাসতে বলে, শরণার্থী শিবির কি শুধু চোখের জলের তাঁবু? নাকি বেঁচে থাকার আনন্দের জোয়ার? নাকি যুদ্ধের সাহসের বসন্ত-দিন?
চলবে....
এসএ/