ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৪
বিষাদ বসুধা
ঝড়ের আগেই আরেফিন তার বন্ধুর গাড়িতে করে বাসার উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিলেন। কিন্তু কিছুটা পথ এগোবার পরই শুরু হয় উন্মাতাল ঝড়। ধুলোবালি আর শিলা-বৃষ্টির প্রতাপে সওগাত গাড়ি চালাতে পারছিলেন না। মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু একেবারে অন্ধকার হয়ে গেলো। গাড়ির লাইট জ্বালিয়ে ডিপার দিয়ে কোনো মতে একটা বাড়ির সামনের শেটে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখলেন। অনেকক্ষণ সেখানেই অবস্থান করেন। সেখানেও গাড়ি রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। গাছের ডালপালা ভেঙে গাড়ি ওপর পড়ার উপক্রম হলো। কী আর করা। তখন বাধ্য হয়েই তাদের বাসার উদ্দেশে রওয়ানা দিতে হলো। সওগাত আস্তে আস্তে গাড়ি টানতে শুরু করলেন।
সওগাত আলী খুব সাবধানী মানুষ। গলা পর্যন্ত মদ গিললেও গাড়ির স্টিয়ারিং ধরার পর যেন স্বাভাবিক হয়ে যান তিনি। পথ চলতে তার কোনো অসুবিধা হয় না। গাড়ি চালাতে চালাতে তিনি ঠিকই আরেফিনের বাসার কাছ পর্যন্ত চলে গেলেন। রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে বললেন, আরেফিন ওই তো তোর বাড়ির গেট। এখন যেতে পারবি না?
আরেফিন গাড় নেড়ে সায় দেন। তার কথা বিশ্বাস করে তিনি রাস্তার পাশে তাকে নামিয়ে দেন। আরেফিন গাড়ি থেকে নামার পর বার বার তাকে সতর্ক করেন। খুব সাবধানে যা। দেখিস আবার কোথাও পড়ে যাস না যেন!
আরেফিন টলতে টলতে সামনের দিকে আগান। সওগাত গাড়ি নিয়ে নিজের বাসার উদ্দেশে চলে যান। আরেফিন বেশ কিছুক্ষণ বাড়ির গেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। ঘূর্ণিঝড়ের মতোই তার মাথা ঘুরছেন। তিনি আর একা হাঁটতে পারছেন না। বাতাসের বেগের সঙ্গে বেড়েছে মদের তেজ। এমন তেজ আগে কখনো টের পাননি আরেফিন।
গেটে মানুষের উপস্থিতি টের পায় দারোয়ান সুরুজ মিয়া। তিনি উঁকি দিয়ে দেখেন। চোর-ডাকাত নাকি বাসার কেউ তা বোঝার চেষ্টা করে। মনে মনে তিনি ভাবেন, বাসার কে হতে পারে? ইদানিং নিয়মিতভাবে দেরিতে বাসায় ফেরেন আরেফিন সাব। উনি কি না কে জানে!
সরুজ মিয়া সাতপাঁচ ভেবে ঝড় উপেক্ষা করে গেটের দিকে এগিয়ে যায়। আরেফিনকে সে বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, স্যার আপনে! এই জরের মইধ্যে কই আছিলেন?
আরেফিন কোনো কথা বলেন না। তিনি সুরুজ মিয়ার কাঁধে হাত দিয়ে গেটের ভেতরে পা বাড়ান। টলতে টলতে লিফট পর্যন্ত গিয়ে বলেন, সুরুজ মিয়া, তোমার আসার দরকার নাই। এখন আমি যেতে পারব।
কথা বলতে গিয়ে বার বার জড়িয়ে যাচ্ছিল। তিনি চেষ্টা করেও ঠিকঠাকভাবে কথাগুলো বলতে পারেননি। সুরুজ মিয়া স্পষ্ট বুঝতে পারে, আরেফিনের টাল অবস্থা।
সুরুজ মিয়া বলল, স্যার যাইতে পারবেন তো!
তুমি চিন্তা কোরো না সুরুজ মিয়া। আমি পারব।
সুরুজ মিয়া আর সামনে আগায়নি। কিন্তু আরেফিনের অবস্থা দেখে সে বেশ উদ্বিগ্ন। সে লিফটের সামনে পায়চারি করে আর ভাবে, স্যারের এমন অবস্থা কেন হইল? স্যারকে তো কোনো দিন মদ খাইতে দেখি নাই! কোনো সমস্যা হইছে নাকি কে জানে। আমার কি উপরে গিয়া দেখা উচিত স্যার যাইতে পারল কি না! না থাক।
সুরুজ মিয়া লিফটের সুইসে চাপ দিল। সে দেখল, লিফট খালি এসেছে। এতেই সে নিশ্চিত হলো আরেফিন ঠিকঠাক মতোই পৌঁছেছে। সুরুজ মিয়া নিজের শোবার ঘরে যায়। বিছানা ঠিকঠাক করে। মনে মনে বলে, ঝড় থামার তো কোনো লক্ষণ দেহি না। এর মইধ্যে ঘুমামু কি কইরা? বিস্টিও নামছে এক্কেরে আকাশ ভাইঙ্গা। কহন থামব কেডা জানে!
সুরুজ মিয়ার চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসে। হাই তুলতে তুলতে সে ঘুমাতে যায়। টানা বৃষ্টি আর থেমে থেমে বিদ্যুৎ চমকানির শব্দে তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। ছোট্ট বিছানায় শুয়ে সে কেবল এপাশ ওপাশ করে। কিছুতেই সে চোখের পাতা এক করতে পারে না।
যে মানুষটির চিন্তায় সুরুজ মিয়ার ঘুম হারাম সে মানুষটির দিনদুনিয়ার কোনো খবর নেই। সে বাসার সামনে এসে আছড়ে পড়ে। দরজায় যে কলিং বেল চাপবে সেটাও আর হয়ে ওঠে না। ঘুম নাকি মদের নেশায় চুড় হয়ে থাকা তা বোঝার উপায় নেই। জ্ঞান হারালে যে অবস্থা হয় মানুষের; আরেফিনের সে রকম অবস্থা! কিছুক্ষণ পর গোঙানির শব্দ পাওয়া যায়। বাইরে প্রচণ্ড ঝড়। তাই আরেফিনের গোঙানির শব্দও কারো কানে যায় না। তিনি পড়ে আছেন মরার মতো। যেন একটা মরা লাশ বাসার সামনে পড়ে আছে।
বনানীর নীল ময়ুরীর ফ্ল্যাট বাড়িতে সবচেয়ে ভদ্র এবং অমায়িক হিসেবে পরিচিত মোহিনীদের পরিবার। সেই পরিবারের কর্তা আজ বাড়ির দরজার ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তাকে দেখার কেউ নেই। ধরার কেউ নেই। রাস্তার টোকাইয়ের মতো, ছিন্নমূল মানুষের মতো অবস্থা হয়েছে তার। যেখানে রাত সেখানে কাত।
মানুষ কেন এভাবে নিজেকেই নিজে নিঃশেষ করে দেয়! কেন সে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারে না! কেন সে নিজের অবস্থান বোঝে না! কেন সে ভুল পথে পা বাড়ায়! কেন সে ঈর্ষার আগুনে পোড়ে! কেন সে একটা কাজ করার আগে দশবার ভাবে না? এসব প্রশ্ন প্রশ্নই থেকে যায় আরেফিনের কাছে। তিনি মোহিনীকে বুঝতে ভুল করছেন। তিনি যে তার কাছে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসাটুকু চেয়েছিলেন, তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। উল্টো যে মোহিনীকে অবহেলা অবজ্ঞা করেছেন। অথচ মোহিনী কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও আরেফিনকে ফেলে দেননি। তাকে আগলে রাখার প্রানান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
কথায় আছে না, কপালে না থাকলে পাওয়া জিনিসও হারিয়ে যায়। মোহিনী আরেফিনের জন্য এক হিরের টুকরো ছিল। তাকে একটুখানি যত্ন করলেই আরেফিনের জীবন পাল্টে যেত। তিনি সেটা চিনতে পারেননি। নিজের ভুলে তিনি যে শুধু নিজেকেই নিঃশেষ করছেন তা নয়, তিনি মোহিনীর জীবনকেও দুর্বিসহ করে তুলছেন।
আরেফিন কি শেষ পর্যন্ত তার ভুল শুধরে আবার নতুনভাবে শুরু করতে পারবেন? নাকি এটাই তার জীবনের শেষ পরিণতি? কি হবে তা কেউ জানে না। আরেফিনও না।
চলবে...
এসএ/
আরও পড়ুন