ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২২
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
রাস্তায় যাতায়াতের সময় আজিমপুর কবরস্থান দেখা হয়েছে। কিন্তু কাউকে দাফন করার জন্য এখানে আসা হয়নি। আজকে এটিও জীবনে নতুন ঘটনা। কবর দেওয়ার পরে অন্যরা চলে গেলে অঞ্জনের মনে হয় দ্রুত বাড়ি যাওয়ার ওর দরকার নেই। ঘুরে ঘুরে প্রতিটি কবর দেখবে। ও হাঁটতে থাকে। একসময় বড় একটি গাছের নিচে বসে বাতাসে শ্বাস টানে। মনে হয় মৃত ব্যক্তিদের শেষ নিঃশ্বাস এখানে বাতাসের সঙ্গে ভাসছে। ও সিদ্ধান্ত নেয় যে, কোনো কারণে মন খারাপ হলে এখানে এসে ওই কোনার জায়গায় বসে থাকবে। মৃত মানুষদের সঙ্গে কথা বলবে। ওদের কাছ থেকে কথা শুনতে পাবে না, কিন্তু বলে যাবে আবেগের কথা। দোয়া করবে মৃত মানুষের শুভকামনায়।
একসময় নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। এসব অর্থহীন ভাবনার মানে কী–নিজেকেই জিজ্ঞেস করে। কিন্তু কোনো উত্তর পায় না। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে কবরস্থান থেকে। নিজেকেই বলে, আজকের স্মৃতি আমার অভিজ্ঞতার সঞ্চয়। এসব ভাবনা মাথায় নিয়ে রিকশায় উঠে কলেজে চলে আসে। আজকে ক্লাস মিস হয়নি। দ্রুত চলে যায় ক্লাসরুমে। এখন ও ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। ক্লাস শেষ হলে বেরিয়ে আসার সময় ভাবে, আগামী বছর ডাক্তার হয়ে যাব। আনন্দ, আনন্দ। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। সামনে যুদ্ধ। যুদ্ধে আমি ডাক্তারের কাজ করব। আহতদের চিকিৎসা দিয়ে যুদ্ধের মাঠ পূর্ণ রাখব। হায়, আমার জীবনের স্বপ্ন। ও এসে কমনরুমে ঢোকে। দেখতে পায় অমিয়া বসে চা খাচ্ছে। ও ছাড়া আর কেউ নেই। তাই গিয়ে একই টেবিলে চেয়ার টেনে বসে।
– অঞ্জন ভাই ক্লাস শেষ হয়ে গেছে।
– শেষ না হলে কি এখানে আসতে পারতাম।
– তা তো ঠিকই। ছি ছি আমি একটা বোকা মেয়ে।
– থাক, এভাবে কথা বলবে না। বোকা হলে ডাক্তারি পড়তে আসতে পারতে না।
অমিয়া মৃদু হাসে। কথা বলে না। অঞ্জন বেয়ারাকে ডেকে দু’জনের জন্য চা-সিঙাড়া আনতে বলে।
– আমি তো খেয়েছি।
– আমার সঙ্গে আবার খাবে। তোমাকে চা-শিঙাড়া খাওয়াতে পারা আমার আনন্দ।
অমিয়া মৃদু হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। অঞ্জন মুগ্ধ চোখে তাকায়। ওর দৃষ্টির মুগ্ধতা অমিয়া
বুঝতে পারে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় অন্যদিকে। এই প্রথম অঞ্জন কাউকে দেখে আবেগতাড়িত হয়। ওর মনে হয় মেয়েটি দেখতে অপরূপ সুন্দরী নয়, কিন্তু চেহারা প্রবলভাবে লাবণ্যময়। তাকালে দৃষ্টি ফিরতে চায় না। পাশাপাশি মেধাবী বোধের ছায়া আছে দৃষ্টিতে। তাকালে মুগ্ধ করে।
অমিয়া বুঝতে পারে যে, অঞ্জনের দৃষ্টিতে ভেসে উঠেছে ভালোলাগার ছাপ। ও বিব্রত হয় না, নিজের ভেতেরও ভালো লাগার অনুভব টের পায়। এর মধ্যে বেয়ারা চা-সিঙাড়া নিয়ে আসে। অঞ্জন ওর দিকে তাকিয়ে বলে, দু’জনে একসঙ্গে খাব। তুমি যখন সিঙাড়ায় কামড় দেবে, আমিও দেব। তুমি যখন চায়ের কাপে চুমুক দেবে আমিও দেব।
– ভাগ্যিস ঘরে আর কেউ নেই। প্রত্যেক টেবিলে অন্যরা থাকলে সবাই হাসত।
অঞ্জন হেসে বলে, ওরা বলত অঞ্জনের মুগ্ধতাকে অভিনন্দন জানাই। তারপর হাসতে হাসতে তালি বাজাত। বলত, জয় হোক অমিয়ার। ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়ে ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রের সঙ্গে প্রেম হলো।
– প্রেম কি হয়েছে?
– হয়েছে, অমিয়া, হয়েছে। এখানেই প্রেমের সূত্র রচিত হলো। তুমি আর কোথাও তাকাবে না।
– সিদ্ধান্ত কি একতরফা হলো?
– ভালো লাগার সিদ্ধান্ত প্রথমে একতরফাই হয়। তারপর গাঢ় হয় দু’জনের মিলিত সিদ্ধান্ত। এবার তোমার কথা বল?
– আমি গাঢ় করেছি সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তে কোনো ফুটো হবে না।
– ওহ, হুররে। এসো হাত মেলাই।
অমিয়া হাত বাড়িয়ে দেয়। অঞ্জন হাত জড়িয়ে ধরে বলে, ভালোবাসি তোমাকে।
– আমিও ভালোবাসি তোমাকে। চলো এখান থেকে বেরিয়ে যাই।
– চলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় অঞ্জন।
– কোথায় যাব আমরা? অমিয়া প্রশ্ন করে।
– কোথাও যাব না। আজকে যে যার বাড়িতে যাব। আজকের বাড়ি প্রেমের আকাশ।
– শুধু আজকের কেন? প্রেমের আকাশ আমৃত্যু থাকবে আমাদের জীবনে।
– ওহ, দারুণ! তোমার ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধতার সমুদ্রে পৌঁছে দিল। অমিয়া আমাদের জীবন ভালোবাসার স্রোতে বহমান থাকবে। চলো তোমাকে একটি রিকশায় উঠিয়ে দেই।
রাস্তায় এসে দাঁড়ালে একজন পথশিশুর কাছ থেকে একগুচ্ছ লাল গোলাপ কিনে তুলে দেয় অমিয়ার হাতে। বলে, বাড়িতে নিয়ে পড়ার টেবিলে রেখো।
– ভালোবাসা, ভালোবাসা।
অমিয়া নাকের কাছে ফুল ধরে মৃদু স্বরে বলতে থাকে। তারপর দুটো গোলাপ আলাদা করে অঞ্জনের শার্টের বুক-পকেটে ঢুকিয়ে দেয়। মৃদুস্বরে বলে, এটাই দু’জনের কিংবদন্তি।
রিকশাওয়ালা জোরে জোরে বলে, আপনেরা যাবেন, না আমি চলে যাব।
– তোমার দাঁড়াতে অসুবিধা কি? কেউ তো তোমাকে ডাকেনি।
ক্রুদ্ধ কণ্ঠে কথা বলে অঞ্জন।
– ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।
– এই দাঁড়াও।
অমিয়া ফুলের গোছা নিয়ে রিকশায় ওঠে। একটি গোলাপ অঞ্জনের হাতে দিয়ে বলে, এভাবে জীবনভর প্রস্ফুটিত থাকবে প্রেমের গোলাপ।
অঞ্জন কিছু বলার আগে রিকশাওয়ালা রিকশা চালাতে শুরু করে। অঞ্জন রিকশা না ডেকে হাঁটতে শুরু করে। ও হেঁটে বাড়িতে যাবে। ওর বুকের ভেতরে প্রেমের আনন্দধারা গড়াচ্ছে।
চলবে....
এসএ/