ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২১
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
তিনজনই দেখতে পায় বাথরুমের দরজা খুলে মেয়েটি বের হয়েছে। ভেজা কাপড় হাতে। গায়ে জড়ানো তোয়ালে। ওদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে একছুটে কাছে আসে কুকড়ি। অঞ্জনকে বলে, গোসল করে খুব আরাম পাচ্ছি।
– হাতের কাপড়গুলো বারান্দায় শুকাতে দিয়ে আয়। চল, আমি তোর সঙ্গে যাচ্ছি। তোর জামা শুকাতে দিয়ে এই বাড়ির সবকিছু তোকে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখাব।
দু’জনে চলে গেলে খালিদা বলে, কী বুঝলে?
– আমরা একটি সন্তান চেয়েছিলাম। আল্লাহ আমাদের জন্য একটি সন্তান পাঠিয়েছেন।
– আমিও তাই ভেবেছি।
– ভাবতেই হবে। নইলে এমন ঘটনা আজকেই ঘটল কেন আমাদের জীবনে।
– তা ঠিক, অঞ্জন তো আর জেনেশুনে ওকে আনেনি। কতদিন রাখতে পারব কে জানে।
– ওর মা যদি মারা যায় তাহলে ও আর কোথায় যাবে। আমরাই ওকে পালব। মেধাবী মেয়ে।
লেখাপড়া শেখালে–
– ওকেও আমরা ডাক্তার বানাব।
– ভালোই হবে। দেখা যাক ও কতদূর এগোতে পারে। আমাদের যত্ন থেকে ও বঞ্চিত হবে না।
– আমি মনে করব ও গত রাতে আমার গর্ভে এসেছিল।
– আমিও তাই মনে করব। এই ভাবনা আমাদের আনন্দে তোলপাড় করে তুলবে।
তোজাম্মেল খালিদার হাত টেনে নিজের বুকে চেপে ধরে।
– শুধু এইটুকু? চুমু দাও।
– হলো না। অঞ্জন আর কুকড়ি আসছে।
– আমি মেয়েটির একটি নতুন নাম রাখব।
– হ্যাঁ, এটা ডাক নাম। একটা ভালো নাম রাখতে হবে স্কুলের জন্য।
অঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে সায় দেয়।
– মাগো তুমি ওর জীবনটা অন্যরকম করে দাও। আমি তোমাদের মা-বাবা ডাকতে বলিনি। ও নিজে নিজেই ডেকেছে।
– আমারও মনে হচ্ছে মেয়েটি অন্য ধরনের মেয়ে। পথশিশু হলেও বোকা-হাবা না।
– আমাদের গেস্টরুমে ওর ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আয়রে কুকড়ি।
– আমি ভাত খাব।
– এখানে বস কুকড়ি। আমি তোর জন্য ভাত আনছি।
অঞ্জন ওকে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে দেয়। খালিদা প্লেটে করে ভাত-তরকারি এনে টেবিলে রাখে। কুকড়ি সঙ্গে সঙ্গে খেতে শুরু করে।
প্রথম লোকমা গিলে বলে, হা-হা মা, মাগো – ।
– এই চুপ কর। আস্তে আস্তে খা। আমি তোর সামনে বসে থাকব। খেয়েদেয়ে ঘুমাবি রে মেয়ে। আজ থেকে তোকে আমরা আনজুম বলে ডাকব। তোর নতুন নাম।
– আনজুম, আনজুম– নতুন নাম নিয়ে চেঁচামেচি করে কুকড়ি। দ্রুত প্লেটের ভাত শেষ করে থালার মধ্যে হাত ধুয়ে ছুটে তোজাম্মেলের কাছে যায়।
– বাবা বাবা আমার নতুন নাম হয়েছে। আজ থেকে আমি আনজুম, আনজুম।
– আয়, আমার কোলে আয়। তোর ভালো নাম হবে আঞ্জুমান আরা খাতুন। এই নামে স্কুলে ভর্তি করাব তোকে। তোর মাকে বলব আমাদের কাছে রেখে তোকে লেখাপড়া শেখাতে।
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি আপনাদের কাছে থাকব। স্কুলে যাব। আমার মাকে ভাত দিয়ে আসব। মা রোজ ভাত খেতে পাবে। মাকে যেন আর ভিক্ষা করতে না হয়।
খালিদা মনে মনে ভাবে, পথশিশুরা কত কি যে শিখতে পারে। ও আমার সামনে একটি দৃষ্টান্ত। কত কথা যে শিখেছে ও।
সন্ধ্যায় অঞ্জন ওকে নিয়ে দোকানে যায়। তিন-চারটে জামা কিনে দেয়। বাড়িতে এসে জড়িয়ে ধরে খালিদাকে।
– মাগো, আজকে আমার খুশির দিন।
– আয়, হালুয়া আর কমলা খাবি। খুশির দিন পালন করি।
রান্নাঘরে খালিদার কাছে বসে হালুয়া কমলা খেয়ে বসে থাকে। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর অঞ্জন দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, কালকে তোর জন্য বই কিনে আনব। পড়ালেখা শিখবি।
– কে শিখাবে আমাকে?
– মা শেখাবে। বাবা তো অফিসে চলে যাবে। মায়ের সঙ্গে তুই সারাদিন থাকবি বাড়িতে।
– হ্যাঁ থাকব থাকব। মায়ের আঁচল ধরে থাকব।
– শুধু আঁচল ধরে থাকতে হবে না। পড়া শিখবি।
কথা বলে না কুকড়ি। খালিদার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অঞ্জন আর কিছু না বলে সরে যায়।
তোজাম্মেল এসে বলে, চা খাওয়াও গো।
– বসো, চা-নাশতা নিয়ে আসছি।
– আমাদের কাজের মেয়েটিকে কয়দিনের ছুটি দিয়েছ?
– পাঁচ দিনের। আর দুই দিন পরে আসবে কাজরি। তোজাম্মেল গিয়ে টেবিলে বসে। ছুটে আসে কুকড়ি।
– বাবা, বাবা আজ থেকে আমি তোমাদের কাছে আনজুম। তুমি আমাকে আনজুম বলে ডাকো– ।
– ওরে আনজুম, আনজুম। রোদ-বৃষ্টির ভালোবাসায় তুই অনেক বড় হয়ে উঠবি। আনজুম মা রে, আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে যায়। এভাবে সংসারে স্থিত হয় আনজুম।
পরদিন অঞ্জন কলেজে ঢোকার আগে হাসপাতালে যায় হালিমা খাতুনকে দেখতে। গিয়েই খবরটা পায় যে, সকাল ৬টায় হালিমা খাতুন মারা গেছেন। নার্সরা অঞ্জনকে বলে, লাশের ব্যবস্থা করতে।
– ঠিক আছে, আমি ওনাকে আজিমপুর কবরস্থানে নিয়ে যাব। তার আগে আমি তার মেয়েটিকে নিয়ে আসি।
– ও কোথায় আছে?
– আমি একটা সিএনজি নিয়ে যাব আর আসব।
– তাড়াতাড়ি আসবেন। দেরি করবেন না।
অঞ্জন দ্রুত নেমে আসে হাসপাতাল থেকে। বাড়িতে পৌঁছালে বাবা-মা ওকে দেখে অবাক হয়। কি রে এসেছিস কেন?
– আনজুমকে নিয়ে যাব হাসপাতালে, ওর মা মারা গেছে।
– মারা যাওয়ার খবর এখনই ওকে বলিস না। কাঁদতে শুরু করবে।
– বাবা আমাকে কিছু টাকা দাও। লাশ আমাকে দাফন করার জন্য নিয়ে যেতে হবে।
– তা করতে হবে। তুই দাঁড়া, আমি টাকা দিচ্ছি। আজিমপুর কবরস্থানে নিয়ে যাস।
তোজাম্মেল টাকা এনে ছেলের হাতে দেয়। অঞ্জন আনজুমকে বলে, আমার সঙ্গে হাসপাতালে চল। মাকে দেখবি।
– না, আমি হাসপাতালে যাব না। মা যেদিন ভালো হবে সেদিন যাব।
খালিদা ওকে টেনে ধরে বলে, তুই আমার কাছে থাক। অঞ্জন তুই চলে যা।
অঞ্জন ফিরে আসে হাসপাতালে। অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়ে আসে কবরস্থানে। হালিমা খাতুনের মুখের দিকে তাকিয়ে বিহ্বল হয়ে যায়। কত অল্প সময়ে কত বিশাল একটি ঘটনা ঘটে গেল ওর জীবনে। অপরিচিত একজন নারীর দাফনের দায়িত্ব নিতে হলো ওকে। কুকড়ি অসুস্থ মাকে দেখতে চায়নি। একবার দেখে যে অভিজ্ঞতা পেয়েছে দ্বিতীয়বার তার মুখোমুখি হতে চায়নি মেয়েটি। ও জানল না যে, মাকে আর কোনো দিন দেখা হবে না। অঞ্জন অ্যাম্বুলেন্স থেকে লাশ নামিয়ে দাফন করার জায়গায় নিয়ে যায়। ওরা গোসল করিয়ে কাফনের কাপড় পরিয়ে দেবে।
কবর খোঁড়ার জন্য কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। ওর কিছু করার নেই এখানে। শুধু খরচের টাকা দিতে হবে। ও কবরস্থানের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে কবরগুলো দেখে। এখানে ভাষা আন্দোলনের শহীদ বরকতের কবর আছে। একটু পরে দেখতে পায় হালিমা খাতুনের জন্য কবর খোঁড়া শেষ হয়েছে। ও কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কবরে নামানো হলে ও নিজেও কবরের ওপরে মাটি ছড়িয়ে দেবে। তারপর চলে যাবে।
চলবে....
এসএ/