ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২০
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
অঞ্জন একটি রিকশা নিয়ে উঠে পড়ে। মেডিকেল কলেজ থেকে দোয়েল চত্বর পেরিয়ে সামনে এগোলে কুকড়ি হাততালি দিতে দিতে বলে, কী সুন্দর পাখি। আমি বড় হলে পাখি পুষব। আমি অনেক পাখি পুষব।
– পাখি পুষে কী করবি কুকড়ি?
– জানি না। বলতে পারব না।
কথা শেষ করে ও অঞ্জনের বুকে মাথা রাখে। অঞ্জন ওর মাথায় হাত দিয়ে রাখে। রিকশা দ্রুত এগোয়। কুকড়ি মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক তাকায়। শহর দেখার আনন্দে অভিভূত হয়ে থাকে। একসময় বাড়ির কাছে এসে থামে রিকশা।
খালিদা আর তোজাম্মেল বিছানা ছেড়েছে। দু’জন দু’জনের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। উপভোগের মাত্রায় ভিন্ন প্রত্যাশা দু’জনকে প্রভাবিত করে। তোজাম্মেল বলে, মনে করো, সন্তান আসবে। খালিদা হঠাৎ করে উচ্ছ্বসিত হতে পারে না। ও ধরে নিয়েছে আসবে না। আসলে তো আগেই আসত। সন্তানের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যৌনমিলন করলেই সন্তান আসবে এমন আশাবাদ মনে রাখা ঠিক না। তাহলে দুঃখ বেশি হবে। কিন্তু তোজাম্মেলকে কিছু বলে না। চুপ করে থাকে।
–কী হলো তুমি এমন চুপসে গেছ কেন? বিছানায় তো অনেক সুন্দর ছিলে।
– যদি সন্তান না আসে এই ভাবনায় চুপসে গেছি।
– থাক, এসব আর ভাবতে হবে না।
তখন দরজায় বেল বাজায় অঞ্জন। একটু আগে ও কুকড়িকে জারুল ফুলগাছ দেখিয়েছে। বলেছে, দেখো কী সুন্দর ফুল ফুটেছে।
কুকড়ি হাসতে হাসতে বলেছে, এমন গাছ আমি অনেক দেখেছি রাস্তায়। কী সুন্দর ফুল ফুটে থাকে গাছে। আমি কখনও ফুল ছিঁড়ি না। ফুল ছিঁড়লে মা রেগে যায়।
– হ্যাঁ, ফুল ছেঁড়া উচিত না। ফুল গাছে থাকাই সুন্দর।
তখন দরজা খোলে খালিদা। কুকড়িকে দেখে বিস্ময়ে বলে, কী রে বাবা, এই বাচ্চাটি কে?
– বাচ্চাটি পথশিশু মা। এই মাকে সালাম কর।
কুকড়ি উপুড় হয়ে খালিদার পায়ের ওপর মাথা ঠেকায়। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি তোমাকে মা ডাকব। তুমি আমার মা।
– বাব্বা, মেয়েটি তো খুব চালু।
অঞ্জন হাসতে হাসতে বলে, ও চালু না মা। ও মেধাবী।
– তোরা ঘরে আয়।
ওরা ঘরে ঢুকলে খালিদা দরজা বন্ধ করে। শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে তোজাম্মেল। অঞ্জন ওকে বলে, বাবাকে সালাম কর।
কুকড়ি একই রকম ভঙ্গিতে বলে, তোমাকে আমি বাবা ডাকব। তুমি আমার বাবা।
বাবার পা জড়িয়ে ধরে রাখে ও।
– আয় মা, আমার কোলে আয়।
– না, আমি কোলে চড়ব না। আমার গা ময়লা।
– অঞ্জন ওকে বাথরুমে নিয়ে যা। গোসল করুক।
– বাবা-মা আমি তোমাদের বলি আমি ওকে বাড়িতে রাখব কয়দিন।
– হ্যাঁ, থাকবে। যতদিন থাকতে চায় ততদিন থাকবে। কি রে থাকবি তো কুকড়ি?
– হ্যাঁ, মা থাকব। আদর চাই, ভাত চাই।
অঞ্জন হো-হো করে হাসে। খালিদা-তোজাম্মেলও হাসিমুখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
– তোকে আমরা সব দেব রে সোনা-মেয়ে।
– বাবা, বাবা, তুমি আমার আপন বাবা। আমি আর কাউকে বাবা ডাকিনি।
ও ছুটে এসে পায়ের ওপর গড়িয়ে পড়ে। তোজাম্মেল ওকে দু’হাতে ধরে বলে, ওর কাপড়-চোপড় নোংরা। বাথরুমে নিয়ে যা গোসল করতে দে।
– আয় তোকে বাথরুমে ঢোকাই। আমার তোয়ালে তোকে দেব। গোসল করে ওটা পরে থাকবি। আর জামা ধুয়ে দিবি। বাথরুমে সাবান আছে। পারবি না?
– পারব।
– মা ওকে একটা-দুটো জামা কিনে দিতে হবে।
– আমি টাকা দেব। তুই ওকে সামনের দোকানে নিয়ে যাস।
– হ্যাঁ, ঠিক আছে। এই চল। বাথরুমে ঢোক।
অঞ্জন ওকে বাথরুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা টেনে দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢোকে। খালিদা আর তোজাম্মেল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। দু’জনের অনুভবে একই রকম মাত্রা আঁচড় কাটে। তোজাম্মেল বলে, চলো ঘরে গিয়ে বসি।
– কী বলবে আমি জানি।
খালিদা মৃদু হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
– তোমার হাসিতে একই ভাবনা ফুটে উঠেছে।
দু’জনে হাসতে হাসতে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসে। বাবা-মাকে বসতে দেখে অঞ্জন এসে বসে। তারপর কুকড়িকে কীভাবে আনল সে ঘটনা বাবা-মাকে খুলে বলে। দু’জনে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করে একটানা শুনে যায়। শেষে বলে, হাসপাতালে ওর মায়ের যে অবস্থা দেখে এলামা মনে হচ্ছে বাঁচবে কিনা বোঝা গেল না। জ্ঞান হারিয়ে বিছানায় পড়ে আছেন।
– খোঁজ রাখিস। জ্ঞান ফিরলে মেয়েটাকে দেখতে চাইতে পারে।
– ঠিক বলেছ মা। আমি কলেজে গিয়ে খোঁজ রাখব। রোজই একবার দেখতে যাব।
চলবে....
এসএ/