বসদের যেসব ভুলে চলে যান যোগ্য কর্মীরা
একটা সময় ছিল অফিসের বস মানেই গুরুজন স্থানীয় মনে করা হতো। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে অনেক ধারণা। পাল্টেছে মানুষের মানসিকতা ও যাপিত জীবনের নানা ধরন। এখন অনেক অফিসের বস কর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেন। আবার কর্মীরাও একইভাবে সাড়া দেন বা অনেকে নিজে থেকেই সুসম্পর্ক তৈরি করেন নিজের কর্মদক্ষতার মাধ্যমে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না থাকলেও কাজের স্বার্থে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরি। কারণ কর্মীদের কারো সঙ্গে বসের তিক্ত সম্পর্ক হলে পতনের শুরু হয়। একই সঙ্গে ওই বসও কর্মীদের মনোযোগ ও প্রতিশ্রুতি হারাতে বসেন।
তবে সব সময় যে কর্মদক্ষতা বা নিষ্ঠার মাধ্যমে সুসম্পক তৈরি হয় তা নয়। কখনো কখনো ব্যতিক্রমও দেখা যায়। অদক্ষ, অসৎ, ফাঁকিবাজ কর্মীও অনেক সময় বসের প্রিয় পাত্রে পরিণত হন। এতে প্রতিষ্ঠানের উপর নেতিবাচক প্রভাব খুব বেশি পড়ে। কাজের স্পৃহা হারিয়ে ফেলেন দক্ষ ও সৎ কর্মীরা। কখনো কখনো প্রতিষ্ঠান ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠোনে চলেও যান ভালো কর্মীরা। মোট কথা একজন খারাপ স্বভাবের বসের কারণে কর্মী ও প্রতিষ্ঠান উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আসুন জেনে নেওয়া যাক বসদের যেসব ভুলের কারণে যোগ্য কর্মীরা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যান।
* দক্ষ কর্মীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে পাওনাটাও অন্যদের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত। নয়তো মেধা বা প্রতিভার অবমূল্যায়ন করা হবে। কিন্তু যখন তারা আর সবার মতোই বিবেচিত হন, তখন চলে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়।
* বস কোনো কর্মীকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ নাও করতে পারেন। তবে তার কাজের মূল্যায়ন অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু সেটি বিপরীতও হয়- যেমন ব্যক্তিগত অপছন্দের কারণে পদোন্নতিতে সেই কর্মীর নামও তিনি লেখেননি। অথচ যার সঙ্গে বসের খুব ভালো সম্পর্ক, তিনি ফাঁকিবাজ বা অদক্ষ হলেও দেখা যায় তার নাম ঠিকই আছে পদোন্নতির তালিকায়। এটা যখন কোনো দক্ষ কর্মী বুঝতে পারেন, তখন তিনি সুযোগ খুঁজতে থাকেন। কারণ দক্ষ ও পরিশ্রমী কর্মীরা কিছুটা বেশি পাওয়ার দাবি রাখেন। কিন্তু অনেক সময়ই বসরা তাদের এড়িয়ে ভুল মানুষকে পদন্নোতি দেন। এতে যোগ্য কর্মীদের মাঝে হতাশা চলে আসে। তারা কাজের স্বীকৃতি পেতে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যান।
* দৈনন্দিন অসন্তোষের একটা প্রতিকূল প্রভাব পড়ে সার্বিক উৎপাদনশীলতার উপর। বসদের খারাপ আচরণের কারণে অবশেষে ভালো কর্মীদের প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যেতে হয়। রুঢ়তা, অহেতুক দোষ দেওয়া, ব্যঙ্গ করা ও প্রতিহিংসা নিয়ে খেলা করার কারণে কর্মীদের উদ্বেগ বাড়তে থাকে। বসদের বিরক্তিকর ও খারাপ আচরণ একটি ভালো কাজের পরিবেশের অন্তরায়।
* বসের কাজ হলো কর্মীদের কর্মক্ষমতা বাড়ানো। তাদের নতুন নতুন কাজে উৎসাহ দেওয়া। প্রতি মাসে কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। নিজের মতো করে কর্মীদের যোগ্য করে তোলা। অথচ কিছু কিছু বস আছেন যারা শুধু কর্মীদের ভুল খুঁজে বেড়ান। তাদের মাথায় সারাক্ষণ ছাঁটাইয়ের চিন্তা ঘোরে। কিন্তু এসব কর্মীকে গ্রুমিং করাও যে বসের দায়িত্ব, সেটা তিনি ভুলে যান। তার সঙ্গে কাজ করলে কিছু শেখা যাবে না, এটা বুঝতে পেরেই যোগ্য কর্মীরা চাকরি ছেড়ে দেন।
* লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে জবাবদিহির ক্ষেত্রে অনেক সময় বসরা কর্মীর উপর দোষ চাপিয়ে দেন। তাদের বিশ্বস্ততা, দক্ষতা, যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ অনৈতিক আচরণ কোনো কর্মীর কাছেই গ্রহণযোগ্য হয় না।
*মনোযোগী ও দক্ষ কর্মীরা যে কাজেই হাত দেন, সেখানেই ভালো ফলাফল আসে। সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো সৃষ্টিশীল কর্মীদের এ অসাধারণ গুণের কদর করে। কিন্তু উল্টো সৃজনশীল কর্মীকে হেয়প্রতিপন্ন করা প্রতিষ্ঠানগুলো কোনোদিনও দাঁড়াতে পারেনি। কারণ সৃজনশীল কর্মীকে হেয় প্রতিপন্ন করলে কাজে তাদের বিতৃষ্ণা চলে আসে। যেসব প্রতিষ্ঠানের বস এ ধরনের উল্টো কাজে পারদর্শী সেসব প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যত ততোই অন্ধকার।
* দক্ষ কর্মীরা যতটুকু কাজ করেন তা গুণগত মানসম্পন্ন হয়। এ কারণে বসরা তাদের দিয়ে সব সময় বাড়তি কাজ করিয়ে নিতে চান। যেকোনো বিশেষ কাজের জন্য তাকেই বাছাই করা হয়। কিন্তু তাকে যদি সেই কাজের জন্য অনুকূল পরিবেশ না দেওয়া হয় এবং কাজ আদায় করতে চান, তখন দক্ষতাই কর্মীদের কাছে শাস্তি হয়ে দাঁড়ায়। এক গবেষণায় বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে বাড়তি প্রতি ঘণ্টার কাজে উৎপাদনশীলতা কমতে থাকে। কাজেই দক্ষদের দিয়ে বেশি বেশি কাজ করিয়ে লাভ নেই।
* যেসব বস কর্মীদের ভালো-মন্দ বাছ-বিচার করেন না সেসব প্রতিষ্ঠানে বস ও কর্মীদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকে না। যেসব বস কর্মীদের সফলতায় আনন্দিত হন না অথবা সমস্যা সমাধানের পথ দেখাতে এগিয়ে আসেন না, তাদের অধীনে কোনো কর্মীই কাজ করতে চান না। দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীরা সাধারণত আত্মবিশ্বাসী হয় এবং তোষামোদের ধার ধারে না। তাই অনেক বস তাদের অপছন্দ করেন। শুধু তাই নয়, কিছু কিছু কর্মী থাকেন কাজ কম করেন কিন্তু বসের সান্নিধ্যে থাকেন বেশি এবং কাজের চেয়ে দেখনদারি করেন বেশি। বসরা কাজের মূল্যায়ন না করে মুখের কথা বা চটকদারিটাই দেখেন। এক্ষেত্রে নিরবে কাজ করে যাওয়া দক্ষ কর্মীরা কর্মবিমুখ হন। এতে ক্ষতিটা প্রতিষ্ঠানেরই বেশি হয়।
* ভালো কর্মীদের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে অনেক বসই নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। কিন্তু মুখের কথা শেষ অবধি কথাই থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে বসদের ওপর আস্থা হারান তারা। অবিশ্বস্ত বসের অধীনে নিরাপদবোধ করেন না কোনো কর্মী।
*প্রত্যেক কর্মীর নিজস্ব পছন্দ ও প্রয়োজন রয়েছে। এগুলো বসের কাছে নিগৃহীত হলে কর্মীদের অহংবোধে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের উৎপাদনশীলতা কমতে থাকে। যারা সব নিয়ম পালন করেও আবেগ লালনে বাধাপ্রাপ্ত হন, তাদের কাছে কাজের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
* প্রত্যেক কর্মীর কর্মক্ষমতার সীমা রয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় প্রাথমিক লক্ষ্য না দিয়ে বসরা অস্বাভাবিক লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেন। আর তা অর্জনে কর্মীদের সুস্থ ও স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া জরুরি মনে হয় কর্মীর কাছে। কর্মীদের বিনোদন বা সামান্য আরাম আয়েশের সুযোগ না দিয়ে অতিরিক্ত কাজ আদায়ের মানসিকতা ধারণ করেন অনেক বসই। এটি কর্মীদের ক্লান্তি বাড়িয়ে দেয় এবং উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়।
এসএন