‘বিতর্কিতরা কোনোভাবেই মনোনয়ন পাবেন না’
মাহবুবউল আলম হানিফ। কুষ্টিয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ২০০৯ সালের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ১৮তম জাতীয় কাউন্সিলে প্রথম বারের মতো কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ লাভ করেন। পরবর্তীতে ২০১২, ২০১৬ ও ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ১৯, ২০ ও ২১তম কাউন্সিলেও তিনি যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদে পুনঃদায়িত্ব পান। ২০১০ সাল হতে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
সোমবার (৮ আগস্ট) ঢাকাপ্রকাশকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন দলের জাতীয় কাউন্সিল, চলামন বৈশ্বিক সংকট, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ নানান বিষয়ে। এ কথাও যে সব সংসদ সদস্য নানা কারণে বিতর্কিত হয়েছেন, বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, দলকে বিব্রত করেছেন, আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে তাদের কেউ কোনোভাবেই মনোনয়ন পাবেন না। আগামী নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সম্পর্ক এসব বিয়ষকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
মাহবুবউল আলম হানিফের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকাপ্রকাশ এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শাহজাহান মোল্লা। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—
ঢাকাপ্রকাশ: আগামী ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল। সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন মুখ আসবে কি-না? অনেক সময় বিতর্কিতরা দলে ঢুকে পড়ে এক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কি?
মাহবুবউল আলম হানিফ: আওয়ামী লীগে আদর্শের বাইরে থেকে কারো আসার কথা না। আওয়ামী লীগে সেই প্র্যাকটিস নেই। সাধারণ সম্পাদক নির্ধারণ করার দায়িত্ব কাউন্সিলরদের, অনেক সময় কাউন্সিলররা দলীয় সভানেত্রীর কাছে দায়িত্ব দিয়ে থাকেন। তখন দলীয় সভানেত্রী কাউন্সিলরদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। সাধারণ সম্পাদক কে হবেন? সময়ই বলে দেবে। সেটা নিয়ে কথা নেই।
তবে আমি মনে করি দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ সেভাবেই হওয়া উচিত। আমরা ৮১ সদস্যের কমিটি, এই ৮১ সদস্যের মধ্যে সকলেই যে দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড যথাযথভাবে পালন করতে পারছে তা নয়। যারা ভালো কাজ করেছে তাদের প্রমোশন হবে। যারা ভালো কাজ করতে পারে নাই তাদের বাদ দিয়েই নতুনদের জায়গা করে দিতে হবে। আমি মনে করি, গুরুত্বপূর্ণ পদে কিছু কিছু পরিবর্তন তো আসেই।
ঢাকাপ্রকাশ: বিগত দুটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে ছিল। এবার তারা ঘোষণা দিয়েছে এককভাবে নির্বাচন করবে, শোনা যাচ্ছে তারা বিএনপির সঙ্গেও ঐক্য করতে পারে। এতে কি আওয়ামী লীগ শঙ্কিত?
মাহবুবউল আলম হানিফ: আমরা মনে করি না আমাদের জোট থেকে কেউ চলে যাবে। তবে কোনো দল যদি মনে করে তাদের জনপ্রিয়তা যাচাই করার জন্য তারা নিজেরা এককভাবে নির্বাচন করতে চায় সেটাও করতে পারে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এ নিয়ে বেশি চিন্তিত নয়। কারণ আওয়ামী লীগ এদেশের সবচেয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক দল। জনগণের কাছের দল। এদেশের যা কিছু অর্জন; স্বাধীনতা থেকে শুরু উন্নয়ন অগ্রগতি সবই হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। এদেশের মানুষের আশা ভরসার জায়গা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং দলের সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার উপর আছে। মানুষের আস্থা যতদিন জননেত্রী শেখ হাসিনার উপর আছে, আওয়ামী লীগের উপর আছে, ততদিন আওয়ামী লীগের নির্বাচন নিয়ে কোনো ভাবনার বিষয় আছে বলে মনে করি না।
ঢাকাপ্রকাশ: আগামী নির্বাচনের আগে জোট সম্প্রসারণ হবে কি না?
মাহবুবউল আলম হানিফ: নির্বাচনী জোট করার ব্যাপারে আমাদের মতামত সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা আছে। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের দুয়ার সব সময় সবার জন্য খোলা। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে, স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী, যারা স্বাধীনতার মূল স্থপতি বা স্বাধীনতার মূল নায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আস্থাশীল বা যারা তাকে স্বীকার করে, মানে— এরকম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোনো রাজনৈতিক দল যদি আওয়ামী লীগের জোটে আসতে চায় অবশ্যই আসতে পারে। সেক্ষেত্রে আলোচনার পথ আমাদের সুগম আছে। দুয়ার খোলা আছে।
ঢাকাপ্রকাশ: রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে নির্দলীয় সরকার না হলে নির্বাচনে আসবে না? বিএনপি কি আসলে নির্বাচনে আসবে?
মাহবুবউল আলম হানিফ: নির্বাচনে কোনো দল আসবে, কি আসবে না; সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনও হয়নি। কারণ নির্বাচনের এখনও প্রায় দেড় বছর বাকি আছে। সাধারণত নির্বাচনের দেড়-দুই বছর আগে কোনো রাজনৈতিক দলই নির্বাচনের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবস্থায় থাকে না, মানসিকতায় থাকে না। আমরা মনে করি, বিএনপির এখনও সেই সময় হয়ত আসেনি। এখন নির্বাচন সংক্রান্ত যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলছে এটা আসলে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার জন্যই তারা রাজনৈতিক কথা বার্তা বলছে। এটা কোনো সিদ্ধান্ত নয়। অতএব যে বিষয়টি সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচনার মধ্যে নেই; সেটা নিয়ে কথা বলা যৌক্তিক নয়। তবে আমরা একটা বিষয় খুব পরিষ্কারভাবেই বিশ্বাস করি যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণেই হবে। সব দলই নির্বাচনে অংশ নেবে এবং সেটা আমরাও চাই। আমাদের প্রত্যাশা সব দলের অংশ নিক। তাদের জনপ্রিয়তা যাচাই করুক।
ঢাকাপ্রকাশ: বিএনপি তো বলছে নির্দলীয় সরকার না হলে তারা নির্বাচনে আসবে না। নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা কি ফিরে আসবে?
মাহবুবউল আলম হানিফ: নির্দলীয় বা এই ধরনের কোনো সরকার আসার সুযোগ নেই। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী পথ চলতে হবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সংবিধান অনুযায়ী হবে। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে সেই নির্বাচন যাতে অবাধ সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ হয় বা একেবারে ত্রুটিমুক্ত হয় সেই ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে বর্তমান সরকার সব রকম সহায়তা করবে।
ঢাকাপ্রকাশ: সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক সংকট চলছে, যেটা সারা বিশ্বেই চলছে। বর্তমান অবস্থায় আওয়ামী লীগ কি ভাবছে? আগামী নির্বাচনে এর কোনো নেতিবাচকভাবে প্রভাব পড়বে কি না?
মাহবুবউল আলম হানিফ: না। সংকট তো সারা পৃথিবীতেই কোনো না কোনো সময় আসে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে হঠাৎ সংকট সৃষ্টি হয়। সেই সংকট কেটেও যায়। সংকট কখনো স্থায়ী হয় না। সংকট সাময়িক সময়ের জন্য হয়, কেটেও যায়। এই আমাদের দেশেই যদি একটু পেছন ফিরে তাকাই দেখব এই বছরের শুরুর দিকে হঠাৎ করে সয়াবিন তেল নিয়ে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ছিল না? এমনকি সোয়াবিন তেল আর পাওয়া যাবে না দেখে মানুষ এমনভাবে কেনাকাটা করল কারও মুরগির খামারে তেল পাওয়া যায়, খাটের নিচে তেল পাওয়া যায়; এমন একটা অবস্থা ছিল। দামও ছিল ঊর্ধ্বমুখী। সাধারণ মানুষ আর কিনতে পারবে না এরকম আশঙ্কা ছিল। ব্যাপক লেখালেখি আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। এখন কিন্তু সয়াবিন তেলের দাম কমে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে এসেছে। সয়াবিনের তেলের সংকট কিন্তু এখন আর মানুষের কাছে নেই, সেটা ভুলে গেছে। ঠিক এই মুহূর্তে যেমন ডিজেল বা পেট্রোলের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে সংকটের কারণে। আমার বিশ্বাস এই সংকট কেটে যাবে। এটাও হয়ত স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে।
ঢাকাপ্রকাশ: চলমান সংকট আগামী ভোটে কোনো চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে কি না?
মাহবুবউল আলম হানিফ: রাষ্ট্রের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যাওয়ার পথে ছোট খাটো অনেক সংকট আসে। এই সংকট কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আর এই সংকট যদি দীর্ঘস্থায়ী না হয় তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সুযোগ থাকে না। কোনো সংকট যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তখনই তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আমরা আশা করছি এই সংকট সেপ্টম্বরের শেষে বা অক্টোবরের মধ্যে কেটে যাবে। সংকট কেটে গেলে মানুষের মন থেকে মুছে যেতে বেশি সময় লাগবে না।
ঢাকাপ্রকাশ: আওয়ামী লীগের কিছু সংসদ সদস্যের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে দল বিব্রত কি না? আগামী নির্বাচনে বিতর্কিতরা বাদ পড়বে কি না?
মাহবুবউল আলম হানিফ: অবশ্যই। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবে যিনি মনোনয়ন পাবেন তার আমলনামার উপর ভিত্তি করেই পেতে হবে। আমাদের সকলের কর্মকাণ্ড বিচার বিশ্লেষণ করে এলাকায় সার্বিক দিক দিয়ে যারা গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি বা যাদের বিরুদ্ধে কোনো বিতর্কিত অভিযোগ নেই, অনৈতিকতার অভিযোগ নেই, এরকম ভালো গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচিত হবে। যারা বর্তমান সংসদ সদস্য হিসেবে আছেন এবং সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে নানা ধরনের বিতর্কিতমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন বা বিতর্ক সৃষ্টি করছেন যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকবে তাদের মনোনায়ন পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কমে যাবে।
ঢাকাপ্রকাশ: দীর্ঘক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুবউল আলম হানিফ: আপনাকে ও ঢাকাপ্রকাশ’এর পাঠকসহ সবাইকে ধন্যবাদ।
এনএইচবি/আরএ/