তানিন এঁকেছেন হাজারো বইয়ের প্রচ্ছদ
দেশের সর্ব উত্তরের সীমান্ত বেষ্টিত জেলা পঞ্চগড়ের প্রচ্ছদ শিল্পী হাজ্জাজ তানিন। জেলা শহরের ধাক্কামারা এলাকায় নিজের বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন ছোট্ট একটি স্টু্ডিও। স্টুডিওতে রয়েছে নানা ধরনের বই, ছবি আঁকার সরঞ্জাম, গীটার, হারমোনিয়াম, ল্যাপটপসহ শিল্পের নানা সরঞ্জামাদি। এই স্টুডিওতে বসেই তিনি আঁকেন বইয়ের প্রচ্ছদ। স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ের শতাধিক লেখকের বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন তিনি। বইমেলা শুরুর কয়েকমাস আগে থেকেই তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন প্রচ্ছদ নির্মাণে। এ পর্যন্ত সহস্রাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন তানিন। ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইয়ের প্রচ্ছদ নির্মাণ করে প্রশংসিত হচ্ছেন তিনি। হাজ্জাজ তানিন প্রচ্ছদের সম্মানীতেই আয় করছেন প্রতিবছর কয়েক লাখ টাকা।
বাবা মোজাহেদুল আলম পাটোয়ারী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী আর মা হাবিবা আক্তার একজন গৃহিনী। উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করে বেশ কয়েকবছর ঢাকায় কাটান তিনি। পরে ঢাকা শহর যুতসই না হওয়ায় ছোটবেলার শহর পঞ্চগড়ে ফিরে আসেন এই শিল্পী। বাড়ি ফিরেই শুরু করেন গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজ। সেই সাথে শুরু করেন ছবি আঁকা ও বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকাও। ছবি আঁকার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও ছোটবেলা থেকেই চিত্রকলার প্রতি তার দুর্বলতা, ভালোলাগা ছিল অনেক বেশি। ছবি আঁকতেন নিয়মিত। গিটার বাজিয়ে গানও করেন নিয়মিত। এত কিছুর পাশাপাশি মঞ্চনাটকেও অভিনয় করেন। জেলা নাট্যদল ভূমিজের একজন নিয়মিত নাট্যকর্মী তিনি। নাট্যচর্চা করতে গিয়ে স্থানীয় লেখকসহ নানা গুণীজনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়। কাজের প্রশংসা আসতে থাকে।
২০১০ সাল থেকে স্থানীয় লিটল ম্যাগ, দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং সাহিত্য ম্যাগাজিনগুলোর প্রচ্ছদ নির্মাণ করা শুরু করেন হাজ্জাজ তানিন। বইয়ের প্রচ্ছদ করতে শুরু করেন স্থানীয় লেখকদের । মাত্র পাঁচ বছরে তিনি স্থানীয় ভাবে দুই হাজার পত্রিকা, ম্যাগাজিন এবং বইয়ের প্রচ্ছদ নির্মাণ করেন। স্থানীয় লেখকদের বইগুলো শোভা পেতে থাকে দেশের নানা প্রান্তে। শোভা পায় ২১শে বইমেলায়। ধীরে ধীরে হাজ্জাজ তানিন সারাদেশে পরিচিতি পেয়ে যান। ২০১৫ সাল থেকে তিনি জাতীয় ভাবে প্রচ্ছদ নির্মাণ শুরু করেন। ডাক আসে ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে। প্রচ্ছদের কাজে ব্যস্ততা বেড়ে যায়। প্রচ্ছদ নির্মাণের কাজটিকে পেশা হিসেবেই বেছে নেন তিনি। ২০২১ সালের বইমেলায় হাজ্জাজ তানিন দেড় শতাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ করেন। এবছর ২০২২ সালের বইমেলায় এ পর্যন্ত শতাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ নির্মাণ করেছেন। দেশের প্রথিতযশা লেখকদের বইয়ের প্রচ্ছদ নির্মাণ করে প্রশংসিত হয়েছেন। হাজ্জাজ তানিন ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রচ্ছদ করে থাকেন। তার প্রচ্ছদের বৈশিষ্টতা হচ্ছে নানা রংয়ের উপস্থিতি। তিনি মনে করেন বর্ণিল প্রচ্ছদ পাঠককে খুব বেশি আকৃষ্ট করে।
বেহুলা বাংলা, তাম্রলিপি, শিখা প্রকাশনী, পূর্বা প্রকাশনীসহ দেশ বরেণ্য বেশ কিছু প্রকাশনী সংস্থার সাথে কাজ করছেন তিনি।
হাজ্জাজ তানিন জানান, প্রচ্ছদ শিল্পের সাথে জড়িয়ে পড়বো এমনটা কখনোই ভাবিনি। নাট্যদল ভূমিজে থিয়েটার করতে গিয়ে নানা মানুষের সঙ্গ পেয়েছি। ভেবেছিলাম থিয়েটারের পাশাপাশি গান করবো, ছবি আঁকবো। স্থানীয় লেখকদের প্রেরণাই আমাকে প্রচ্ছদ শিল্পের মায়ায় আকৃষ্ট করেছে। প্রচ্ছদ এখন আমার সবসময়ের অনুসঙ্গ। পান্ডুলিপি, সিনপসিস পড়ে আর লেখক আর প্রকাশকের সাথে মতবিনিময়ের মাধ্যমে তিনি প্রচ্ছদ নির্মাণ করেন। স্থানীয় লেখকেরা আমার স্টুডিওতে আসেন। তাদের সাথে কথা বলে প্রচ্ছদ আঁকি। হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক বা মুঠোফোনে জেলার বাইরের লেখক বা প্রকাশকদের সাথে যোগাযোগ হয়। প্রচ্ছদ নির্মাণে ধরা বাঁধা সম্মানি নেই না। যে যার খুঁশি মতো সম্মানি দেন। তাতেই প্রতিবছর কয়েক লাখ টাকা আয় হয় আমার।
তরুণ এই প্রচ্ছদ শিল্পী আরো জানান, প্রচ্ছদ আঁকা আমার ভালই লাগে। প্রচ্ছদ নিয়েই আরও সামনে এগিয়ে যেতে চান তিনি।
পঞ্চগড় মকবুলার রহমান সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ্য এম দেলওয়ার হোসেন প্রধান জানান, হাজ্জাজ তানিন দীর্ঘদিন ধরে প্রচ্ছদ শিল্পের সাথে জড়িত। তার পরিচিতি দেশ ব্যাপি ছড়িয়েছে। তার শিল্পের কাজ সকলকে মুগ্ধ করে।
বেহুলা বাংলা প্রকাশনার কর্ণধার চন্দন চৌধুরী বলেন, হাজ্জাজ তানিন খুব সহজেই একটি বইয়ের প্রচ্ছদ কনসেপ্ট বুঝতে পারেন। তার প্রচ্ছদ পাঠকের মনকে উদ্দিপ্ত করে। রঙের ব্যবহার ভালো বোঝেন তিনি। এবারের বই মেলায় আমাদের প্রকাশনী সংস্থার ৫০টি বইয়ের প্রচ্ছদ নির্মাণ করেছেন তানিন। আশা করি আগামীতেও তার সাথে আমরা কাজ করবো।