সুনামগঞ্জে ইটের উপর শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুতলা মসজিদ
মুসলিম স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম পাগলার রায়পুর বড় মসজিদ। জ্যোৎস্নার শহরখ্যাত সুনামগঞ্জে মহাশিং নদীর তীরে শত বছর ধরে রাজকীয় মহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক এ মসজিদটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোনো ধরনের রডের ব্যবহার ছাড়া চুন সুড়কি দিয়ে সম্পূর্ণ ইটের উপর নির্মিত দুতলাবিশিষ্ট মসজিদ।
প্রায় ৬৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও বারান্দাসহ ২৫ ফুট প্রস্থের গম্বুজসহ মোট উচ্চতা ৪০ ফুট ও ছয়টি স্তম্ভের উপর ছয়টি মিনার রয়েছে মসজিদটিতে। তিনটি বিশাল গম্বুজ এবং ছোট আকারে আরও ১২টি মিনার রয়েছে। শত বছরের পুরনো দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি নিমিষেই যে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদটির নির্মাণশৈলী দেখতে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন পর্যটক। বছরজুড়েই স্থানীয় দর্শনার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বিভিন্ন বয়সী মানুষের থাকে আনাগোনা। মসজিদের নিপুণ কারুকাজ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভ্রমণপিপাসুদের মনের তৃষ্ণা মেটায়।
মসজিদের ভিতরের দৃশ্য আরও বেশ নান্দনিক। মসজিদের ফ্লোর ও তার আশপাশের কারুকার্য আপরূপ, মিহরাব অংশে জমকালো পাথর কেঁটে আকর্ষণীয় নকশা করা হয়েছে। এ মসজিদে ব্যবহৃত পাথর একমাত্র তাজমহলে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও মসজিদটিতে শুভা পেয়েছে ইতালি ও ইংল্যান্ডের কারুকার্যখচিত টাইলস। প্রবেশদ্বারে পাথরখচিত খিলান মসজিদটিকে বেশ দৃষ্টিনন্দন করে তোলেছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হল মসজিদের ছাদের ঢালাইয়ে রড ব্যবহার করা হয়নি, ছাদের ঢালাইয়ে রেলের স্লিপার ব্যবহারে করা হয়েছে। মসজিদের দুতলার মেঝেতে দূর্লভ শ্বেতপাথর ও তার চারপাশে ব্লকে দেয়া ব্ল্যাক স্টোন বা কালোপাথর আরও বেশ দূর্লভ। ছাদ ও গম্বুজের চারপাশে পাথর খোদাই করা পাতার নকশা ঐতিহ্যের জানান দেয়। এপাথরগুলো ভারতের জয়পুর থেকে আনা হয়েছে। মসজিদে নামাজের মূল স্থান দুতলায়। নামাজের সময় একটা তাপমাত্রাবান্ধব অনুভূতি পান মুসল্লিরা। মসজিদের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ইবাদতে মুসল্লিদের হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটায়।
মসজিদ কমিটি ও স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ৫ আশ্বিন। প্রায় দশ বছর যাবৎ চলে মসজিদটির নির্মাণকাজ। এই মসজিদটির নির্মাণকাজে মূল মিস্ত্রি ও শ্রমিক ছিলেন ব্রিটিশ রাজের শহর কলকাতা ও দিল্লির। মসজিদের ভূমিকম্প নিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে ভূমি খনন করে মজবুত পাতের উপর ভিত নির্মিত। বড় মাপের ভূমিকম্পেও এখন পর্যন্ত মসজিদটিতে কোনো ধরনের ফাটল ধরাতে পারেনি। নির্মাণের পর মসজিদের বড় ধরনের কোনো সংস্কারও করতে হয়নি। কেবল প্রায় পঁচিশ বছর আগে মূল গম্বুজের এক জায়গায় লিকেজ হয়েছিলো। তখন বেশ সতর্কতার সঙ্গে সংস্কার কাজ করা হয়েছে, যাতে কোনরূপ পরিবর্তন না ঘটে মূল গঠনে।
সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম পাগলা গ্রামের ইয়াসিন মির্জা ও তাঁর ভাই ইউসুফ মির্জা মিলে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। তারা দুইভাই ছিলেন ধর্মপরায়ণ। ছিলেন বিশাল ভূপতির মালিকও। ইয়াসিন মির্জা ও ইউসুফ মির্জার পিতা আদিল হাজীও ছিলেন বেশ ধার্মিক। আদিল হাজী পায়ে হেঁটে হজ্বপালনকারী হিসেবে সবার কাছে ছিলেন পরিচিত। ধর্মপ্রতি তার অগাধ মনোনিবেশ থেকে নিজ বাড়িতে টিনশেড একটি মসজিদ করেন। তখনকার সময়ে অত্র এলাকায় এটিই ছিল একমাত্র মসজিদ। এই মসজিদে আশপাশের গ্রামের মানুষজনসহ দূর-দূরান্ত থেকে মুসুল্লি নামাজ পড়তেন। বংশ পরম্পরাগত ঐতিহ্যের সূত্র ধরেই ইয়াসিন মির্জা ও ইউসুফ মির্জার মসজিদ নির্মাণের স্বপ্ন জাগে। যে স্থাপত্য- নকশা তাদের হৃদয়পটে এঁকেছিলেন, তাতে মসজিদের নিচতলায় হিফজখানা আর উপরের তলায় নামাজের স্থান।
ঢাকা থেকে আসা পর্যটক মাহফুজ হাসান বলেন, এই মসজিদের কথা লোকমুখে শুনেছি বহুবার, পূর্বে কখনও দেখা হয়নি। তাই মসজিদের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে আমরা বন্ধুরা মোটরবাইক চালয়ে ঢাকার মোহাম্মাদপুর থেকে আসছি। ঐতিহাসিক মসজিদ দেখতে এসে অভিভূত হয়েছি। মসজিদে নামাজ আদায় করে হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটাতে পেরেছি আমরা।
মসজিদের উদ্যোক্তা ইয়াসিন মির্জার প্রপৌত্র ও বর্তমান মসজিদ কমিটির ক্যাশিয়ার এবং ( ভারপ্রাপ্ত ) সহ-সভাপতি মনজুর হায়দার ঢাকা প্রকাশ-কে বলেন, এই মসজিদটি সম্পূর্ণ ইটের উপর চুন সুড়কি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ছাদের ঢালাইয়ে রডের ব্যবহার করা হয়নি, রেলের স্লিপার ব্যবহারে করা হয়েছে তখনকার সময়ের টেকনোলজিটা এরকম ছিলো।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন ঢাকা প্রকাশ-কে বলেন, এই মসজিদ সম্পর্কে আমরা গ্রামবাসীর কথা শুনবো। পরে আমরা দেখবোন মসজিদটি যদি প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের আওতায় আনার মত হয়, তাহলে মসজিদটি অবশ্যই প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের আওতায় আনা হবে।