পাখিদের বন্ধু ‘অভয়ারণ্য’
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছে, গাছে অনেক জাতের পাখির বাস। লেকে আসে অতিথি পাখির দল। তাদের জন্য সংগঠন কাজ করছে অভয়ারণ্য’। লিখেছেন ও ছবি তুলেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রায়হান মাহবুব
কুয়াশার চাদর ভেদ করে মিষ্টি রোদের কিরণ ছড়াচ্ছে প্রভাতের রবি। জানালার ফাঁক দিয়ে কিরণের আভায় ধীরে, ধীরে আলোকিত হচ্ছে হল রুমের চারপাশ। বাইরের পাখির কলকাকলির মধুর শব্দ শোনা যাচ্ছে কিন্তু কম্বলের নিচে অলস ঘুমে আচ্ছন্ন প্রাণটি তো জাগতেই চায় না। এমন সময় জানালায় কিচিরমিচির শব্দ শুনে চোখ থেকে বিদায় নিল ঘুম। পরম আদরে কেউ যেন সুরে, সুরে বলছে, ‘চোখ খুলে দেখ। দিগন্ত তোমায় ডাকছে।’ ঘুম ছেড়ে জানালার পাশে তাকাতেই দেখলাম, এ তো আর কেউ নয়, আমার পড়শি-রঙ বেরঙের পাখিরা। ওরা আমায় ডাকছে।
ঠিক এভাবেই পাখিদের কলকাকলিতে ঘুম ভাঙছে আমরা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রী, শিক্ষকদের। বাংলাদেশে প্রচুর গাছ কেটে ফেলায় প্রকৃতি থেকে বিলুপ্তপ্রায় অনেক পাখি। এমন অনেকের আবাসস্থল এই ক্যাম্পাস। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর আশপাশে, পাশের এলাকার গাছগাছালি, মেহগনি বনটি ও হলগুলোর জানালার কার্নিশগুলোতে ঘর বাঁধে পাখিরা। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে মোট ২৫ প্রজাতির পাখি । ওদের মধ্যে চড়ুই, ঘুঘু, শালিক, বুলবুলি, দোয়েল, কাঠঠোকরা, বামুন শালিক ও গোবরে শালিক নিয়মিত। সকাল হলেই তাদের সবার কিচিরমিচিরে মুখরিত হয় হলগুলো। ঘুম থেকে উঠে পাখিদের খুনসুটি দেখে অলস সময় পার করি আমরা সবাই। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গাছের ফলফলাদি খেয়ে জীবনধারণ করে এই পাখিরা। অনেক সময় শিক্ষার্থীরাও আহার দেই পাখিদের। এভাবেই ছাত্র, ছাত্রীসহ সবার প্রতিবেশী হয়ে উঠেছে মন ভোলানো পাখির দল।
পাখিদের নিয়ে অনেক গল্প, অনেক কথামালা আছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদ্দাম হলের আবাসিক ছাত্র ইমরান খান বললেন, ‘পাখিদের সঙ্গে প্রতিবেশীর মতো আমরা বসবাস করছি। সারাদিন ওরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যায় তাদের কলকাকলিতেই আমরা হল রুমে ফিরি।’
কেবল বাংলাদেশী পাখি নয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাসা বেঁধেছে পরিযায়ীরা। শীতের তীব্রতা যখন বেড়েছে, সুদুর সাইবেরিয়া থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকে প্রতি বছরের মতো আশ্রয় নিয়েছে তারা। ঝাঁকে, ঝাঁকে আসা এই অসম্ভব সুন্দর পাখিরাও আমাদের দেশের পাখিদের মতো। তবে তারা এই ক্যাম্পাসের সুন্দরের ভুবনে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। এই মৌসুমে আমাদের লেকে সবচেয়ে বেশি দেখা মিলছে গিরিয়া হাঁস ও পাতি সারলির।
পাখিদের জন্য অনেক কাজ আছে আমাদের। ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর ‘অভয়ারণ্য’ নামের একটি পাখিপ্রেমী সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়েছে। তারা ২০১৯ ‘২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র, ছাত্রী। ‘অভয়ারণ্য’ সভাপতি ইশতিয়াক ফেরদৌস ইমন বলেছেন, ‘আমাদের কাজ পাখিদের অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা ও ক্যাম্পাসে সুস্থ-সাংস্কৃতিক চর্চা করা‘। এজন্য সংগঠনটির সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছে, গাছে প্রায় ১শটি মাটির মটকা (হাড়ি) কিনে ঝুলিয়ে দিয়েছেন। সেগুলোতে পাখিরা বাসা বেঁধে থাকছে। এখানে, সেখানে পড়ে থাকা ময়লা, বাতিল প্লাস্টিকের পানির বোতল, জর্দার কৌটা, প্লাস্টিকের বাক্স কুড়িয়ে এনেছেন। সেগুলো পাখিদের পানি ও পোকামাকড় রাখার পাত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। লেকের পশ্চিম পাশটিতে পাখিরা বেশি থাকে বলে সেখানে মটকাগুলো রেখে, ওদের খাবার বেশি সরবরাহ করে অভয়ারণ্য জায়গাটির নাম রেখেছে 'পাখি চত্বর' । ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে পাখি চত্বরটির স্বীকৃতি দিয়েছেন। তারা নিয়মিতভাবে চত্বরে পাখিদের খাদ্যের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
ইশতিয়াক ফেরদৌস ইমন জানিয়েছেন ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পাখিদের জন্য মানব সচেতনতামূলক পোস্টারিং করব। তাতে মোবাইল ফোনের রেডিয়েশনে পাখিদের যে ক্ষতি হয়, সেটিও থাকবে।’ অভয়ারণ্য জানিয়েছে, তারা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠবিড়ালীদের নিয়েও কাজ করছেন। ক্যাম্পাসটির কুকুর ও বিড়ালের হাতে মানুষসহ অন্য কোনো প্রাণী যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হন, সেজন্য ওগুলোকে ভ্যাক্সিনেশন দেবারও পরিকল্পনা আছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের পাশের বিরাট পুকুরটি সংরক্ষণ করতেও কাজ করবেন।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে। তাতে অনেকগুলো বিরাট ভবন তৈরি করা হচ্ছে। এই কাজে তিন, চারটি বন কেটে ফেলা হয়েছে। ফলে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি ও পরিবেশে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই বনগুলোতে শত, শত পাখির চিরকালের আবাস ছিল। তারা বাসা হারিয়ে মারা পড়েছে। বেঁচে থাকা পাখিরা খাবারের অভাবে ভুগছে। পাখিগুলো চরম আবাস সঙ্কটেও রয়েছে। এই অন্যায় কেন করা হলো? আমাদের লেকে ঘুরতে আসা পরিযায়ী পাখিদের নিয়মিতভাবে ঢিল মারে ও শিকার করে বহিরাগত বখাটেদের দল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও ভূগোল বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ইনজামুল হক বলেছেন, “করোনাভাইরাসের আক্রমণে আমরা পাখি নিয়ে কাজ করতে পারিনি। তবে এই বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমরা ক্যাম্পাস পরিস্কার কার্যক্রমসহ কিছু কাজ করেছি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছগুলোর জাতের তালিকা আমরা তৈরি করেছি। ক্যাম্পাসের পাখি সংরক্ষণ নিয়ে আমাদের দীঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম রয়েছে। ‘অভয়ারণ্য’ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা-ভাবনা রয়েছে।”
ওএস।