ভারতের দাবার বিস্ময় ‘প্রাগ’
‘প্রাগ’ নামে দাবার ভুবনের মহাবিস্ময় রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ। ইতিহাসের চতুথ কম বয়সের গ্রান্ড মাস্টার। হারিয়ে দিয়েছেন কদিন আগে বিশ্বচ্যাম্পিন ম্যানগাস কার্লসেনকে। দাবার এই প্রতিভার শুরু কীভাবে? একটি দাবা পরিবারের গল্পে স্বাগতম...
জন্মেছেন তিনি ২০০৫ সালের ১০ আগষ্ট। একটি দাবারু পরিবারে। মোটে পাঁচ বছর বয়সে খুব ভালোভাবে দাবা খেলা শিখে গিয়েছেন তাই রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ। তাকে দাবা খেলা শিখিয়েছেন বড় বোন ভেশালি রমেশবাবু। তিনিও একজন দারুণ নারী দাবারু।
ভেশালি তাদের চেন্নাইয়ের বিখ্যাত দাবারু। অনুধ্ব ১২ ও ১৪ দাবায় মেয়েদের তরুণ দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। ২০১৬ সালে হয়েছেন নারী আন্তজাতিক দাবা খেলোয়াড়। সেবার তিনি ভারতের দ্বিতীয় সেরা নারী দাবারু ও আন্তজাতিক মাস্টার দাবারুদের মধ্যে ১২তম নারী ছিলেন। ২০১৮ সালের ১৩ আগষ্ট তার ও ভারতের নারী দাবারুদের জন্য অনন্য একটি দিন ছিল। সেদিন আর. ভেশালি নামে বিখ্যাত এই খেলোয়াড় গ্রান্ড মাস্টার হয়েছেন। প্রতিযোগিতাটি হয়েছিল লাটভিয়ার রিগার দি রিগা টেকনিক্যাল ইউনিভাসিটিতে। তখন ভেশালির বয়স মোটে ১৭ বছর। এই প্রতিযোগিতাতেই তিন মাস আগে তার আদরের ছোট ভাইটি ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়সের দাবারু হিসেবে গ্রান্ড মাস্টার হয়েছে। তারও কোচ আর. বি. রমেশ। তিনি তখন বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, সে তার এই তৃতীয় নমটি সুন্দরভাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে লাভ করেছে।’ তিনি কম সময়ের মধ্যে তার ছাত্রীটি যে সম্মাননাটির জন্য স্কোর করে চলেছে, সেটি খেয়াল করেছেন। তবে বলেছেন, ‘তাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে যাতে ২৫শ রেটিং লাভ করে ছেলেদের গ্রান্ড মাস্টার হতে পারে। সেজন্য তাকে প্রতিযোগিতাগুলোতে ভালোভাবে অংশ নিতে হবে ও ভালো খেলোয়াড়দের হারাতে হবে।’
তখন তার এই ভাইয়ের বয়স মোটে ১২ বছর। ভারতের সবচেয়ে কম বয়সের গ্রান্ড মাস্টার হয়েছে সে মোটে ১২ বছর বয়সে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে তিনি তার প্রথম গ্রান্ড মাস্টার নম জয় করেছেন ওয়াল্ড জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে। এরপর হারকালিয়ন ফিশার মেমোরিয়াল গ্রান্ড মাস্টার টুনামেন্টে জয়ের মাধ্যমে দ্বিতীয় নমটি লাভ করেছেন। তার আগে ইউক্রেনের সারগেই কারজাকিন ১২ বছর ৩ মাস বয়সে বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে গ্রান্ড মাস্টার হয়েছেন, ২০০২ সালে।
ডাক নাম ‘প্রাগ’ নামে দাবার দুনিয়াতে পরিচিত এই ছেলেটিকে বিবেচনা করা হয় দাবার ইতিহাসের সবচেয়ে উন্নয়নশীল ও আগামীদের সবচেয়ে ভালো তারকাদের একজন। একেবারে অল্প বয়স থেকে তিনি দারুণ ভালো খেলে চলেছেন। দাবার ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সের আন্তজাতিক তারকা বা ইন্টারন্যাশনাল চেস মাস্টার হয়েছেন ২০১৬ সালে। তখন তার বয়স মোটে ১০ বছর। তার খেলা দেখে তখন থেকেই অনেক অভিজ্ঞ খেলোয়াড় ভবিষ্যতবাণী করেছেন, একদিন তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবেন। তারপর মোটে ১২ বছর, ১০ মাস, ১৩ দিন বয়সে বছর বয়সে দাবার সবচেয়ে বড় গ্রান্ড মাস্টার খেতাবটি জয় করেছেন প্রাগ। তখন থেকে আজও তিনি দাবার ইতিহাসের চতুথ সবচেয়ে কম বয়সে গ্রান্ড মাস্টার খেতাব জয় করা খেলোয়াড়।
তাদের বাড়ি ভারতের চেন্নাইতে। তার বাবাও একজন নামকরা দাবা খেলোয়াড়। নাম ভাইশালি রমেশবাবু। তিনি দুইবার ভারতের তরুণ দাবা চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। প্রাগের মা নাগাল²ী ও বাবা তাদের গ্রান্ড মাস্টার দুই ভাই, বোনের মধ্যে প্রথমে ভেশালিকে দাবা খেলা শিখিয়েছেন, যাতে দীঘসময় ধরে টিভির সামনে বসে না থাকে। তবে বোনের দাবা খেলা খুব দ্রুতই ছোটভাই প্রাগের কল্পনার জগতে ঢুকে পড়লো। তাদের বাবা রমেশবাবুর ক্যারিয়ারটি আটকে গিয়েছে পোলিও রোগে। ফলে তার স্ত্রী টুনামেন্টগুলোতে নিয়ে গিয়েছেন, ভালোমন্দ দেখেছেন। আর দুজনেই একই প্রতিযোগিতাতে অংশ নিচ্ছে বলে মায়ের কষ্ট কমেছে, ভালো লেগেছে। একত্রে তারা নানা বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন, হোটেল রুমগুলোতে ভালো ও সেরা সঙ্গী জোটে দুই ভাই, বোনের। এভাবে এগিয়েছেন তারা।
তাদের জীবনের গল্প বলেছেন বাবা রমেশবাবু, ‘যখন প্রজ্ঞানন্দ খেলাটি শিখতে শুরু করলো, ততদিনে আমার স্ত্রী বড় মেয়ে ভিশালির সঙ্গে নানা জায়গাতে সফর করে চলেছে। ফলে আমাদের প্রথম সমস্যা ছিল কীভাবে তাদের দুজনের শিডিউলগুলোকে আমরা ম্যানেজ করবো। যখন ছেলেরও দাবার প্রতি আগ্রহ টের পেলাম, তাদের খেলার শিডিউল এক করতে আমরা জোর করতে পারলাম।’ তারা থাকেন চেন্নাইয়ের একটি শহরতলী পাডিতে। রমেশবাবুর পুরো পরিবারটি তাদের উপস্থিতি ছেলেমেয়েদের দাবার ক্যারিয়ার ও সেগুলোর শিডিউলে কেন্দ্রীভূত করেছেন। প্রজ্ঞানন্দ একজন উচ্চাকাংখী দাবারু। তবে প্রতিযোগিতাগুলোতে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকেনি। তারপরও তার বাবা ছেলেকে নিয়ে খুশি। তিনি হাসতে, হাসতে বলেছেন, ‘যেকোনো কিছুর চেয়ে আমার ছেলে খেলতে বেশি ভালোবাসে বলে খেলোয়াড় হিসেবে আমার মনে হয়। খেলার ফলাফল তার পক্ষে এলো কিনা তাতে খুব বেশি কিছু প্রাগের আসে, যায় না।’ প্রাগের কোচ হলেন ভারতের গ্রান্ড মাস্টার রামাচন্দন রমেশ। কোচের ভাষ্য হলো-‘আরো বেশি স্পন্সরের সমথন পেলে তার ক্যারিয়ারটিকে উচ্চতম স্তরে সে বেশিদিন রাখতে পারবে।’ এই কোচ তাকে ভালোভাবে গড়ে দিতে অ্যাকাডেমিতে তাদের নিয়ে দলগত আলোচনা করেছেন। জানিয়েছেন, আমরা প্রজ্ঞানন্দের মাধ্যমে খুব কম কয়েকটি ব্যক্তিগত সেশনের আয়োজন করতে পেরেছি। একা তাকে দিয়ে সেশন চালানো খুব কঠিন। আর তাকে নিয়ে বলবো, সে খুবই মনোযোগী এবং গ্রান্ড মাস্টার হবার অনেক আগে থেকেই সে একজন গ্রান্ড মাস্টারের মতো খেলে চলেছে। যখন সে প্রথম আমার কাছে এসেছিল, তখনই একটি বিশেষ শিশু ও-আমি জানতাম। আমি অনেক মেধাবী শিশুর সঙ্গে কাজ করেছি তবে প্রাগ সবসময়ই আলাদা হয়েছে। একজন খেলোয়াড় হিসেবে নিজের শক্তিগুলোর বিষয়ে সবসময়ই ওয়াকিবহাল এবং সবচেয়ে কঠিন শ্রমটি সে স্বেচ্ছায় দেয়। যে কোনো অবস্থায় আক্রমণে বেরিয়ে পড়ে। এটি একটি দুলভ গুণ যেটি দাবারুদের মধ্যে দেখা যায়। অ্যাকাডেমিতে তিনি কেবল তাদের জয় লাভের দিকে নিয়ে যাননি, হেরে যাবার পরও নিজের ছাত্র, ছাত্রীদের নিয়ে কাজ করে চলেছেন তিনি। তাদের পরাজয়গুলোকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়া, সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসা ও ভুলে যাওয়া শিখিয়েছেন। আরো শক্তিশালী হিসেবে ফিরে আসার শিক্ষা দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আপনার পক্ষে সম্ভব সবচেয়ে কঠিন কাজগুলো করে গিয়েও আপনি হারতে থাকতে পারেন। ফলে তখন আপনার করণীয় একমাত্র হলো সঠিক আচরণটি করে যাওয়া। আমাদের প্রজ্ঞানন্দের মধ্যে এই চমৎকার গুণটি আছে। সে তার সুযোগগুলোর বিষয়ে অত্যন্ত প্রয়োগবাদী। সে আরো জানে যে, সবকিছুকে, সবসময় সে জিততে পারবে না। এটি তাকে গ্রান্ড মাস্টারের নম লাভের পথে হারতে থাকার সময়গুলোতেও প্রেষণা যুগিয়ে গিয়েছে। কখনো সে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে না। নিজেকে এই শিক্ষা খুব ভালোভাবে দিয়েছে প্রজ্ঞানন্দ।’ খেলাটির প্রতি ভালোবাসা থেকে ছোটবেলা থেকেই সে ক্লাস ও পরীক্ষা বাদে অন্যসময়গুলোতে প্রশিক্ষণ ও খেলায় অংশ নিতে টুনামেন্টগুলোতে গিয়েছে। বিদ্যালয়ের খাবারের অবসরে যে সময়গুলোতে তাকে প্রতিযোগিতাতে অংশ নিতে হয়েছে, এর বিনিময়ে কোচ অ্যাকাডেমিতে তাদের জন্য মজা ও আনন্দের মাধ্যমে সবকিছু করতে চেষ্টা করেছেন। প্রজ্ঞানন্দের মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করতে একটি নতুন টিটি টেবিল একটু উঁচুতে স্থাপন করেছেন। কেবল তখনই তার এই ছাত্র ও অন্যদের কাছে চলে আসে টেবিলটি যখন তারা লুকিয়ে পড়তে চায়। কার পাকিংয়ের জায়গাগুলোতে তারা খেলে। একেবারে ছোট থেকে তৈরি করা এই ছাত্রের বিষয়ে কোচ বলেছেন, আমার এই ছেলেটির সবচেয়ে আকষণীয় ও দেখার মতো দিক হলো তার পরিপক্কতা। তার যেকোনো বসয়ে বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের পক্ষে অচিন্তনীয় কাজ করেছে প্রজ্ঞানন্দ। তবে এই অবিশ্বাস্য এই খেলোয়াড়ের দাবী, সে তার বাবা যা করতে পারতেন সেগুলোই তিনি করে চলেছেন। বলেছেন, তার পরিপক্কতাগুলোই কেবল আমার মাধ্যমে খেলাটিতে আছে। তবে অন্যসব শিশুদের মতো ছোটবেলায় তিনি কাটুন দেখতে ভালোবাসতেন। ছোট সাইকেলে পা চালিয়ে ঘুরতেন। যখন তিনি বাড়িতে থাকতেন।
গ্রান্ড মাস্টার রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ তার দাবা জীবনের জীবনের আদশ মানেন বিশ্বনাথন আনন্দ ও ম্যানগাস কার্লসেনকে। তবে এই ১৬ বছরের কিশোর দাবার ভুবনের বিস্ময় দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ম্যানগাস কার্লসেনকে স্তব্ধ করে দিলেন। ‘দি এলারথিংস মাস্টার’ নামের বিশ্বসেরা দাবাড়দের ১২ রাউন্ডের অনলাইন প্রতিযোগিতাতে তাকে হারিয়ে দিয়েছেন তিনি। ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সালে আয়োজনটি হয়েছে। প্রাগ মিথ্যে প্রমাণ করেছেন তার বয়সকে, ঠান্ডা ও পূণ মনোযোগী এবং গুছিয়ে খেলে বলে তার খুব সুনাম আছে। যে ভুলগুলো কার্লসেন করে গিয়েছেন, সেগুলোরই সুবিধা গ্রহণ করে ভারতের তরুণ তারকা তাকে হারিয়ে দিয়েছেন।
কার্লসেন সম্পকে একটি তথ্যই যথেষ্ট-তিনি টানা পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। যখন তিনি প্রাগের সঙ্গে খেলায় ফিরে আসার যুদ্ধে নেমেছেন, একবারও তাকে সুযোগ দেননি প্রজ্ঞানন্দ। ফলে নিজের খেলা শুরুই করতে পারেননি কালসেন। ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলে অত্যন্ত দ্রুতগতির দাবার এই প্রতিযোগিতায় স্বাভাবিকভাবে জিতেছেন তিনি। তাতে লাভ করেছেন একটি বিশ্ববিখ্যাত জয়। ২০১৩ সালে দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার পর সবচেয়ে কম বয়সের খেলোয়াড় হিসেবে তাকে হারিয়ে দিলেন প্রাগ। এই নরওয়েজিয়ানের বিপক্ষে জেতা ইতিহাসের তৃতীয় ভারতীয় তিনি। তবে জয়ের অনুভূতি খুব অল্পে জানালেন-‘আমি খুবই খুশি।’ কীভাবে উদযাপন করবেন-এই প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘আমার মনে হয় এখন আমার কেবল ঘুমাতে বিছানায় যাওয়া প্রয়োজন।’ তারপর বলেছেন, ‘এখন ঘুমানোর সময় চলে এসেছে, আমার মনে হয়, এই রাত আড়াইটায় আমার সকালের খাবার খেতে যাওয়া উচিত নয়।’ তাকে দাবা খেলা শেখানো কোচ আর.বি. রমেশ বলেছেন, ‘আমরা আশা করি, যদি এটি ঘটে তাহলে মহৎ কম হয়েছে। আর যদি না হয়ে থাকে, তাহলেও ভালো।’ দিনে গড়ে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা অনুশীলন করেন তার ছাত্র প্রাগ।
প্রাগের জয়ে বিশ্বনাথন আনন্দ টুইটারে লিখেছেন, আমি আমাদের প্রতিভাগুলোর জন্য সবসময় গব অনুভব করি।’ প্রাগকে বলেছেন, ‘আজ তোমার খুব ভালো একটি দিন।’ ভারতের কিংবদন্তী ক্রিকেট তারকা, ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো ব্যাটসম্যানদের একজন শচীন টেন্ডুলকারও প্রাগকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘প্রাগের জন্য আমাদের কী অসাধারণ অনুভূতি হলো। ১৬ বছর বয়সেই অভিজ্ঞদের মধ্যে সেরা ও সবচেয়ে গোছানো-দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনকে হারিয়ে দিলো। কালো ঘুঁটিগুলো নিয়ে এই জয় আসলে জাদুর মতো।’ আরো লিখেছেন ক্রিকেট বিস্ময়, ‘আগামী দিনের একটি বড় ও সফল দাবার ক্যারিয়ারের জন্য আমি তোমাকে সবচেয়ে ভালোভাবে আশীবাদ করছি। তুমি ভারতকে গবিত করেছো।'