রূপকের জন্য একুশেতে সাস্টে বইমেলা
মুজিবুর রহমান রূপক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (সাস্ট)’র ক্যান্সারে আক্রান্ত ছাত্র। তার জন্য সাহায্যের অংশ হিসেবে বইমেলা করলেন বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। লিখেছেন ও ছবি দিয়েছেন নুরুল ইসলাম রুদ্র
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ব্যানার বানাতে বিরাম ছিল না কয়েকদিন আগে থেকে প্রেসগুলোর। ফলে ব্যানারে ভুল হতেই পারে। সেটিই ঘটলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (সাস্ট)’র লোকপ্রশাসনের ছাত্র মুজিবুর রহমানের কপালে। তবে তার কপাল খুবই মন্দ। এই ভুলে কিছুই আসে, যায় না। বন্ধুরা তাকে চেনে ডাকনাম ‘রূপক’ হিসেবে। কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে রূপকের শরীর ফুলে গিয়েছে। খুবই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে বাংলাদেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত নামকরা-সাস্টের এই মেধাবী ছাত্র। ফলে তাকে সাহায্যের জন্য যে ব্যানারটি তারা পকেটের খরচ বাঁচিয়ে, চা, নাস্তার টাকা থেকে সরিয়ে করেছিলেন, সেটিতে ভুল এসে গেল ২০১১-২০১২ শিক্ষাবর্ষ। কিন্তু আবেগের কাছে, ভালোবাসার ভুবনে ভুলের মূল্য নেই। সেটি নিয়েই তারা করে ফেললেন অনন্য এক মানবিক আয়োজন। ২১ ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জেগে থাকে, সারাদিন তাদের ও বাইরের মানুষের পদচারণাতে মুখর থাকে। মধ্যবিত্ত পরিবারের চিকিৎসা খরচ যোগাতে আর না পারা, হিমশিম খেয়ে যাওয়া রূপকের মা-বাবার পাশে দাঁড়ালেন সাস্টের সবাই। বন্ধু ও সহপাঠীরা অর্জুন তলায় এই বইমেলা করলেন অনন্য উদ্যোগে। তারা চারপাশে বাঁশ গেড়ে দিলেন একে, অন্যকে সাহায্য করে। এরপর হল থেকে নিয়ে এলেন কটি টেবিল, চেয়ার। সেগুলো পাশাপাশি সাজিয়ে রাখলেন। ওপরে রাখলেন নিজেদের জমানো বইগুলো। মাথার ওপরে নারকেলের পাতার ছাউনি দিলেন খুব ভালোভাবে। রোদ উঠেছে, সেই রোদ তাদের গায়ে, মুখে এসে লাগছে। পুরো শরীরে ভর করেছে। পেছনে রূপকের সাহায্যের জন্য একটি বড় কালো ব্যানার। প্রতিটি টেবিল, চেয়ারের স্টল আবার সুতো দিয়ে আলাদা করেছেন। মাথার ওপরের ছাউনিটিও বাঁশ আর নারকেলের পাতায় বেঁধেছেন এই পাটের সুতো দিয়ে। বইগুলোর মধ্যে আছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক, বাংলাদেশের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কম্পিউটার প্রযুক্তির অগ্রনায়ক, বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক ও জনপ্রিয়তম কলাম লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের অনেকগুলো বই। একটি হলো তার অত্যন্ত জনপ্রিয় কলামের বই-‘সাধাসিধে কথা’, অন্যটি হলো তার বড় ভাই এই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয়, আধুনিক ধারার সবচেয়ে বড় সাহিত্যক হুমায়ূন আহমেদের প্রেমের বিখ্যাত উপন্যাস ‘বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল’। এগুলো তাদের গবের ও ভালোবাসার। টিউশনি, আড্ডার খরচ বাঁচিয়ে, মায়ের কাছ থেকে চেয়ে কিনেছেন একটির পর একটি নভেল। কদিন ধরেই তারা ব্যস্ত ছিলেন রূপককে বাঁচাতে। একদল ব্যানার, আরেকদল চেয়ার-টেবিল, জায়গার যোগাড়যন্ত্রে ব্যস্ত। তবে সবচেয়ে কষ্ট হয়েছে তাদের যারা উপন্যাসগুলো জোগাড় করেছেন। আশপাশ থেকে, বন্ধুদের কাছ থেকে চেয়ে, অনুরোধ করে, স্বেচ্ছায় বেশিরভাগ পেয়ে অন্তত দুইশ বই নিয়ে এসেছেন তারা রূপকের জন্য। সেগুলো এখানে স্টল করে সাজিয়েছেন কটিতে। এই বইগুলোর সবই একুশের বইমেলার মতো সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সেরা লেখক, অত্যন্ত গর্বের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর যেভাবে অটোগ্রাফ দিয়ে মেলার উপচে পড়া ভীড়ে বিক্রি করেন, পাঠক বাড়ান, কিশোরদের ভুবনে আলো ছড়ান; বাংলাদেশের মনন গড়ে দেন-তার মতো করে বিক্রি করেছেন। দিনভর সাস্টের শহীদ মিনারে, ক্যাম্পাসে বেড়াতে ও শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন সবাই। এই ছাত্র, ছাত্রী, অধ্যাপক, অধ্যাপিকা, কর্মকর্তা, কর্মচারী, বাইরের মানুষদের কাছে পুরোনো, নতুন ঝাঁ চকচকে মলাটের, চিরকালের ভালোবাসার বইগুলো ন্যায্য দামে বিক্রি করেছেন তারা। সকাল থেকে শুরু হওয়া বিকেল পর্যন্ত ‘রূপককে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন’ শিরোনামের বইমেলাতে বিক্রি করেছেন। সব টাকাই ওর ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যয় করা হবে। এছাড়াও তার নামে একটি চিকিৎসা সহায়তা ফান্ড গড়েছেন তারা। সেখানে চাঁদা তোলা হচ্ছে, যে যা পারছেন দিচ্ছেন। ডাক্তার বলেছেন চিকিৎসায় রূপকের জন্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা লাগবে। ফলে মেলা, সাহায্য সংগ্রহ, চাঁদা, কনসার্ট ইত্যাদিতে অসহায় পরিবারটিকে সাহায্য করতে নেমেছেন সাস্টের বন্ধুরা। আরো অনেক গল্পের নায়কের মতো এভাবে রূপক বেঁচে যাবে। ভালো থাকবে। আপনিও সাহায্য করতে পারেন-বিকাশে ০১৬৮১০২৩২৩০, রকেটে ০১৭২৮৬০৮০৩৭, নগদে ০১৭২৮৬০৮০৩৭ সাহায্য পাঠিয়ে।
ওএস।