৭০ বছরেও নির্মাণ হয়নি শহিদ মিনার
আড়ালে থেকেই চলে গেলেন ভাষা সংগ্রামী আবদুল হাই তালুকদার
মাদারীপুরে লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেই চলে গেলেন ভাষা সংগ্রামী আবদুল হাই তালুকদার। বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময় অঞ্চলভিত্তিক মাদারীপুরে যারা ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, আবদুল হাই তালুকদার তাদেরই একজন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এই ছাত্রনেতা সম্পর্কে তেমন কোনো লেখালেখি হয়নি। প্রচারবিমুখ এই মানুষটির নাম আজও ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়নি।
আন্দোলনের উত্তাল দিনে আবদুল হাই তালুকদার ছিলেন মাদারীপুর সদর উপজেলার চরমুগরিয়া মার্চেন্টস উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী। চরমুগরিয়া মার্চেন্টস উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাদারীপুরে প্রথম ভাষা আন্দোলনের সুত্রপাত হয়। এই স্কুলের ছাত্ররা আন্দোলন শুরু না করলে অঞ্চলভিত্তিক মাদারীপুরে ভাষা আন্দোলন এতটা বেগবান হতো না। তাই চরমুগরিয়া মার্চেন্টস উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। ছাত্রদের সাথে প্রধান শিক্ষকসহ সকল শিক্ষক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন। আন্দোলন করে ছাত্র-শিক্ষকরা প্রশাসনের রোষানলে পড়েছিলেন। আর যে বিদ্যালয় থেকে মাদারীপুরে ভাষা আন্দোলনের সুত্রপাত হয়েছিলো; আজ দীর্ঘ ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই স্কুলে কোনো শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়নি।
তবে এবার আশার কথা শোনালেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল হামিদ। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে শহিদ মিনার নির্মাণের। ইতিমধ্যে স্থান নির্ধারণ ও নকশা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এ বছরই কাজ শুরু হবে; কিন্তু জীবদ্দশায় তার নিজ বিদ্যালয়ে একটি শহিদ মিনার দেখে যেতে পারলেন না ভাষা সংগ্রামী আবদুল হাই তালুকদার। গত বছর ১৮ জুলাই ৯০ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটির আহ্বানে ১৯৪৮ সালেই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মাদারীপুরে আন্দোলন শুরু হয়। ওই বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় চরমুগরিয়া মার্চেন্টস স্কুল মাঠে ছাত্রদের প্রথম প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। নেতৃত্ব দেন ৯ম ও ১০ শ্রেণির ছাত্ররা। ছাত্রদের সংগঠিত করেন সরদার আবুল ফজল, আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া, নির্মল সেন, আবদুল হাই তালুকদার, শৈলেন্দ্র চন্দ্র রায়, নিরোদ বিহারী গুহ, ডা. আবদুল হক।
সভায় সিদ্ধান্ত হয় প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল করার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ওই দিন বেলা ১১টায় প্রায় ৪০০ ছাত্র একটি মিছিল নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করতে করতে রাশিবাবু বাজারের স্টিমার ঘাট পর্যন্ত (রাশিবাবু বাজার বর্তমানে নদীভাঙ্গণে বিলীন) গিয়ে অবস্থান নেয়। সেখানেই প্রথম প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন চরমুগরিয়া মার্চেন্টস স্কুলের ছাত্র সরদার আবুল ফজল, আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া, আব্দুল লতিফ তায়ানী, সৈয়দ আলী, আবদুল হাই তালুকদার, নির্মল সেন, আবদুর রহমান তালুকদার, মতিয়ার রহমান মাস্টার, ফজলুর রহমান খান, ডা. আবদুল হক, শৈলেন্দ্র চন্দ্র রায়, নিরোদ বিহারী গুহ, সীতানাথ সাহা।
সমাবেশ শেষে ছাত্ররা পূনরায় মিছিল করতে করতে চরমুগরিয়া মার্চেন্টস স্কুলে ফিরে আসেন। এটাই ছিলো কেন্দ্রের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে মাদারীপুরে ভাষা আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত। ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ মাদারীপুর মহকুমা সদরসহ সর্বাত্বক ধর্মঘট পালিত হয়। ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’এর আহ্বানে মাদারীপুর, শিবচর, রাজৈর ও কালকিনির সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকরা ধর্মঘটে অংশ নেন। ধর্মঘট পালন করায় প্রশাসনের রোষানলে পড়তে হয় অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, আবদুল হাই তালুকদার ১৯৩১ সালে মাদারীপুর সদর উপজেলার চরমুগরিয়ার চরখাগদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবদুর রহিম তালুকদার এবং মাতার নাম সাজু বিবি। আবদুল হাই তালুকদার ১৯৩৮ সালে ৭ বছর বয়সে চরমুগরিয়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করে চরমুগরিয়া মার্চেন্টস উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ১৯৫২ সালে একই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৫৩ সালে মাদারীপুর সরকারি কলেজে (নাজিমউদ্দিন কলেজ) একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং একই কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। চরমুগরিয়া মার্চেন্টস উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সময় তিনি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন।
১৯৪৮ সালে আন্দোলনের শুরু থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত আবদুল হাই তালুকদার ভাষা আন্দেলনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। সকল মিছিল মিটিংয়ে তাঁর বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর ছিল উল্লে¬খ করার মতন। তিনি বক্তৃতা দিয়ে আন্দোলনের মাঠ গরম করে রাখতেন। টিনের চোঙ ফুঁকিয়ে বক্তৃতা দিয়ে সকলকে আকৃষ্ট করার মত সম্মোহনী শক্তি ছিল তার। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদমূখর হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা ও সাহস পেয়েছেন।
ভাষা সংগ্রামী আবদুল হাই তালুকদার’র ছেলে দুলাল তালুকদার বলেন, ‘মাদারীপুরে ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রথম সারির নেতাদের সাথে আমার পিতা সংগ্রাম করেছেন। ভাষা সৈনিক ডা. গোলাম মাওলা এবং ভাষা সৈনিক ও মাদারীপুর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মৌলভী আছমত আলী খান ছিলেন তার আদর্শ। আমার পিতা ছিলেন প্রচার বিমুখ। তিনি তার নিজের কথা কাউকে বলতেন না। দুঃখের বিষয় হলো, যে স্কুল থেকে এই অঞ্চলে ভাষা আন্দোলনের সুত্রপাত; সেই স্কুলে দীর্ঘ ৭০ বছরেও একটি শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়নি। মূল্যায়ন করা হয়নি আঞ্চলিক পর্যায়ের ভাষা সৈনিকদের।’
চরমুগরিয়া মার্চেন্টস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমি এই স্কুলে যোগদান করার পর শহিদ মিনার নির্মাণ করার প্রক্রিয়া শুরু করি। স্থান নির্ধারণসহ নকশাও চূড়ান্ত হয়ে গেছে। খুব শিগগিরই শহিদ মিনার নির্মাণ কাজ শুরু করা হবে।’
এসএ/