ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য হলো বইয়ের ভুবন
সাহারা মরুভূমির গভীরে, উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকান দেশ মৌরিতানিয়া। তাতে ঘুমিয়ে আছে মরুদ্যানের শহর চিংগেটি। বহু পুরোনো মরু শহর, জন্ম ১১ শতক। আঁকা, বাঁকা সড়কগুলো ও বহু পুরোনো ট্রান্স-সাহারান বাণিজ্যপথগুলোর জোরে আজও বেঁচে আছে মরুর বুকে। ৮ থেকে ১৭ শতক পর্যন্ত সাহারা মরুভূমির ভেতরের সাহারান আফ্রিকা ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন শহরের মধ্যে বাণিজ্য চলতো এই পথগুলো দিয়ে উটের গাড়িতে। ক্যামেল কারাভান নামে উটের এই মরু কাফেলার জন্য বিখ্যাত মরুভূমিটি। যেগুলোতে তারা স্বর্ণসময়ে নানা ধরণের পণ্যদ্রব্যাদি পুরো উত্তর আফ্রিকা জুড়ে আনা-নেওয়া করতেন। নানা ধরণের বাণিজ্যের সঙ্গে আরব বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ পান্ডুলিপিগুলো এখানে বিনিময় হতো, কেনা-বেচা চলতো। এভাবে তারা চিংগেটিকে পরিণত করেছিলেন একটি জ্ঞান আহরণের কেন্দ্রে। বহু পুরোনো বাণিজ্য পথকে আশপাশের অধিবাসীরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিলে সাংস্কৃতিক উন্নয়নের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো এখন, তাদের মাধ্যমে বিরাট একটি পুরোনো হাতে লেখা পান্ডুলিপির সংগ্রহশালা তৈরি হয়েছে। মৌরিতানিয়া থেকে সেগুলো ছড়িয়ে গিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। এই লেখার ভুবনের ভাষা আরবি। আরবের দেশে, দেশে সেগুলো বিদ্বানদের হাতে পৌছেছে। এখন আর সেই ঐতিহাসিক ট্রান্স-সাহারান বাণিজ্য পথটি নেই। তবে বিশাল সাহারা মরুভূমি আজো আছে। সে তার যৌবনের গর্ব ধরে রেখেছে এই চিংগেটি শহরে। শহরটির পরিচয়ের একটি অংশ হলো পান্ডুলিপিগুলো। সেগুলো তার দেশ মৌরিতানিয়ার উন্নত সাংস্কৃতিক সম্পদের পরিচয় বহন করে চলেছে। তবে নানা কারণে এখন তারা ঝুঁকিতে। তেমনই একটির মালিক সাইফ আহমেদ মাহমুদ। তিনি তার পুরোনো পরিবারের আহমেদ মেহমুদ পারিবারিক গ্রন্থাগার (আহমেদ মেহমুদ ফ্যামেলি লাইব্রেরি)’র স্বতাধিকারী। তাদের পারিবারিক সংগ্রহশালাটির জন্ম ১৬৯৯ সালে। এখন তাতে আছে মোট ৭শর বেশি পান্ডুলিপি, সবই হাতে লেখা। অত্যন্ত উন্নত এই গ্রন্থাগারটি যে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মালিক, সেটি পুরো আরব বিশ্ব থেকে সংগ্রহ করা। পান্ডুলিপিগুলোর মধ্যে আছে ধর্ম, গণিত, সাহিত্য ও জ্যোর্তিবিদ্যার অনেক, অনেক বই। তিনি বলেছেন, ‘আমারই নয়, পুরো চিংগেটি শহরে আছে অনেক বই, বিপুল পান্ডুলিপি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো পান্ডুলিপিগুলো আমাদের ধর্মীয় সম্পদ নিয়ে লেখা।’ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাঁচটি পশ্চিম আফ্রিকান দেশের রাষ্ট্রপতি ও তাদের সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক ফ্রান্স একমত হয়েছেন, মৌরিতানিয়ার অংশ ছিল এককালে, সেই সাহেল অঞ্চলে ইসলামী চরমপন্থীদের বিপক্ষে যুদ্ধ পরিচালনা বন্ধ করে দেবেন। সাহেল অঞ্চলটি আফ্রিকাতে সাহারা থেকে উত্তর-দক্ষিণে। এই নেতারা আরো একমত হয়েছেন অধিক শক্তিশালী করবেন একটি আঞ্চলিক অস্ত্রশক্তি জি৫ সাহেল বাহিনীকে, যেটি ২০১৭ সালে শুরু হয়েছিল। তাতে আছেন মালি, বুরকিনা ফাসো, চাঁদ, নাইজার ও মৌরিতানিয়ার যোদ্ধারা। এই দেশগুলো ফরাসী বাহিনীর সঙ্গে মিলে কাজ করছে। এসব নানা কারণে এখন আর আগের মতো পর্যটকের পা পড়ে না চেংগেটিতে। ফলে তারা সবাই বিপদে পড়েছেন। যে প্রবাহ ছিল পর্যটকদের, সেটি প্রায় বন্ধ হয়েছিল। তবে এখন আবার তারা ফিরছেন বলে খুশি হয়ে জানিয়েছেন মাহমুদ। আরো জানিয়েছেন, ‘একসময় সামান্য বিপদে পড়েছিল আমাদের শহর পর্যটকদের দ্বারা। এটি আফ্রিকার বুদ্ধি, শান্তি, প্রশান্তি, শান্তিপূর্ণ অবস্থার একটি কোণ। তবে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের মারাত্মক বিপদ হয়েছে। ১৯৯৫ সালে আবার সামান্য আশার আলো দেখেছি, যখন থেকে আমরা পর্যটকদের স্বাগত জানাতে শুরু করলাম। তবে একসময় আবার পর্যটনে আমাদের হায়, হায় অবস্থা যুক্ত হলো যখন তাদের আগমন বন্ধ করে দেওয়া হলো। এরপর তো এই বিপদ সারা বিশ্বের-কোভিড ১৯ রোগ ছড়ালো। তবে এই বছর পযটন খাত থেকে আমরা আবার সামান্য আহরণ করতে পেরেছি। আমরা আশাবাদী ও ভবিষ্যতের দিকে সবাই চেয়ে আছি।’ তাদের একজন ফরাসি পর্যটক গিয়েম ইউএন জানিয়েছেন, এই দেশটি সম্পকে আরো অনেক বেশি জানতে তিনি খুব আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছেন। আরো বলেছেন, ‘এই কারণেই আমি বন্ধুদের সঙ্গে এসেছি এবং আমরা এই গ্রন্থাগারটিতে যেতে চেয়েছি, সেটি মৌরিতানিয়ার খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে। সেখানে গিয়ে আমরা অনেক কিছু জানতে পেরেছি।’ শহরের আরেকটি ঐতিহাসিক গ্রন্থাগার আছে হাবত পরিবারের। তাদের গ্রন্থাগারটি ১৪শর বেশি পান্ডুলিপিতে বোঝাই। ‘দি হাবত লাইব্রেরি’তে সবচেয়ে পুরোনো হাতে লেখা পান্ডুলিপিটি ১১ শতকে লেখা। কান্না ও ভালোবাসায় তারা পুরো গ্রন্থাগারকে বাঁচিয়ে রেখেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এখন তার মালিক আহমেদ ওদুদ হাবত। জানিয়েছেন তিনি, ‘পাত্রগুলোতে আমরা পাউডার রাখতে শুরু করেছিলাম, গামলাগুলোতে পাশে রেখে পানিতে ভর্তি করেছি, যাতে পান্ডুলিপিগুলোকে উইপোকা ও পোকামাকড়ের হাতে নষ্ট হয়ে না যায়। তবে তিন মাস আগে আমরা সূর্যের আলোতে সবগুলো পান্ডুলিপিকে রাখতে বাইরে বের করেছি। তাদের পোকাগুলোর হাত থেকে বাঁচাতে আমরা সূর্যের আলোতে বইগুলোর ভেতরে লবনও দিয়েছি।’ তাদের জন্য সুবিধা হয়ে আছে পাশের ইডেন হোটেল। তারা প্রতিটি অতিথিকে তাদের ঘরে একটি নির্বাচিত বইয়ের সংগ্রহশালা পড়ার সুযোগ অতিথিসেবায় যোগ করেছেন। হোটেলের ম্যানেজার ও ইডেন পরিবারের একজন আলী ইডেন বলেছেন, ‘যে বইগুলো তাদের ঘরে, ঘরে আছে, সেগুলো পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হচ্ছে। কেননা বইয়ের পাতাগুলোই তাদের চেংগেটির জীবনের একটি বিরাট শিক্ষা হবে। তারাও এই কাজগুলোকে খুব সানন্দে গ্রহণ করছেন। যখন ভেতরের পাঠোদ্ধার করতে পারেন, বইগুলো খুব সম্মান লাভ করে। ফিরে এসে ঘুমানোর আগে তারা সাধারণত বইগুলো পড়তে শুরু করেন এবং বইগুলোকে পাশে রেখে তারা বিশ্রাম গ্রহণ করেন।’ তবে সবচেয়ে উত্তেজক ও আনন্দের খবর হলো, এই বইয়ের পান্ডুলিপিগুলোর সুবাদে ইউসেকোর ওয়াল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে চেংগেটিকে, ১৯৯৬ সালে।