ভারতের ‘ডিসকো কিং’
ভারত ও বাংলাদেশের, নানা ভুবনের মানুষের কাছে জনপ্রিয়। বিখ্যাত এই ভারতীয় গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালক-বাপ্পি লাহিড়ি। জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে। জন্মেছেন ১৯৫২ সালের ২৭ নভেম্বর। তারা বাঙালি ব্রাক্ষ্মণ পরিবার। বাপ্পির বাবা অপরেশ লাহিড়ি ছিলেন বিখ্যাত বাঙালি শিল্পী। মা বনশ্রী লাহিড়িও ছিলেন শিল্পী। তারা খুব গান গাইতেন। মা ভালো সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। ক্লাসিক্যাল ও শ্যামাসঙ্গীতে খুব পারদর্শী। ফলে ছেলেকে তারা গানের প্রতিটি শাখাতেই নিজের হাতে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি তাদের একমাত্র সন্তান ছিলেন। খুব ছোট থেকে বাপ্পি লাহিড়ি স্বপ্ন দেখতেন-নাম কামাবেন, জাতীয়ভাবেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিখ্যাত হবেন।
মোটে তিন বছর বয়সে তবলা শেখা শুরু করন। অল্পবয়সেই পেশাদার ও দক্ষ শিল্পীর মতো তবলা বাজিয়ে নিজের মধ্যে বড় শিল্পী হবার লক্ষণগুলো প্রকাশ করেছেন। বাপ্পি লাহিড়ি বিবাহিত-স্ত্রী চিত্রাণী লাহিড়ি। তাদের দুটি সন্তান। একটি ছেলে ও মেয়ে। ছেলেটি বড়-বাপ্পা লাহিড়ি, মেয়ের রেমা লাহিড়ি। গানের প্রতি ভালোবাসা, সঙ্গীতের প্রেম পুরো পরিবারে ছড়িয়ে দিয়েছেন বাপ্পি। স্ত্রীও একটি শিল্পী পরিবারের মেয়ে বলে সুবিধা হয়েছে। তাদের অনেকে গানবাজনা করেন। রেমা বাবার মতো খুব চমৎকার গান করেন। উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার সঙ্গীতের তীক্ষ্মবোধ পেয়েছেন ছেলে বাপ্পা। বাবাকে অনুসরণ করে হিন্দি সিনেমা শিল্পে যোগ দিয়েছেন। বাপ্পা লাহিড়ি বলিউডে সঙ্গীত পরিচালক।
বাপ্পি লাহিড়ি অন্য কারো সঙ্গে মেলে না-এমন একটি স্টাইল গড়ে তুলেছেন। গানের ক্ষেত্রেও স্টাইলটি বাপ্পির নিজের তৈরি। পূব ও পশ্চিমের গানের ধারাগুলোকে নিখুঁতভাবে মিশিয়েছেন। তার পোশাকআশাকের স্টাইলও অনন্য। তার সংগ্রহে ছিল পাঞ্জাবি আদলের ভারতের ঐতিহ্যবাহী কুর্তা ও শেরওয়ানিগুলো। সেগুলো সবসময় পরতেন। কালো তার প্রিয় রঙ ছিল। তিনি তার পোশাকের আলমারিতে আরো সাজিয়ে রেখেছিলেন ওয়েস্টান স্যুট, শাট এবং ব্লেজারগুলো। বিভিন্ন ধরণের গহনা পরতে ভালোবাসতেন। এগুলো সবই তার জীবনকে গানের মতো প্রতিনিধিত্ব করে গিয়েছে। সারা ভারতে এবং আরো সব দেশে, এমনকি বাংলাদেশের বাংলা ভাষার মানুষের কাছে মুম্বাইয়ের এই নামকরা গায়ক চোখে পড়তেন স্বর্ণের গহনা পরা, গলায় চশমা পরা বলে।
বাংলা ছবিতে গেয়ে সিনেমার প্লেব্যাক শুরুর সুযোগ লাভ করেছিলেন বাপ্পি। ছবিটির নাম ‘দাদু’। বেরিয়েছিল টালিগঞ্জে, ১৯৭২ সালে। তখন বাপ্পি লাহিড়ির বয়স মোটে ১৯। যে ছবিটির মাধ্যমে তিনি হিন্দি ভুবনে সঙ্গীত পরিচালনার জীবন শুরু করেছেন, সেটির নাম ‘নানহা শিকারী’। বেরিয়েছিল ১৯৭৩ সালে। তখন তার ২০ বছর। বলিউডে তাকে যে ছবিটি স্থায়ীত্ব দান করেছে, সেটি তানহির হাসানের ছবি, ১৯৭৫ সালে মুক্তি পেয়েছে, নাম ‘ঝাকমি’। ছবিটিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন ও একজন প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে বলিউডে যাত্রা করেছেন। তাকে এই ছবিটি খ্যাতি ও সুনাম লাভ করিয়ে দিয়েছে। হিন্দি ছবির ভুবনে একটি নতুন বাপ্পি লাহিড়ি যুগের সূচনা করেছে। নিজের গানের শক্তিতে, সুরের জাদুতে এরপর থেকে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন তিনি। বাপ্পির ‘চলতে চলতে’ ও ‘সুরাকশা’ ছবি দুটি অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তাকে সম্মানের শীর্ষে নিয়ে এসেছে। এত অল্প সময়ে এত বড় সাফল্য আর কোনো সঙ্গীত পরিচালক তার মতো কম বয়সে পাননি বলিউডে।
গায়ক, সঙ্গীত পরিচালক বাপ্পি লাহিড়ি ভারতে ডিসকো বিটের জনক। তার মন ভালো করে দেওয়া, ছন্দময় ও স্পন্দনময় সঙ্গীত ও সুরগুলো দশকের পর দশক ধরে ভারত এবং নানা দেশের সঙ্গীত ও সুর প্রেমীদের নাচিয়ে চলেছে। তিনি ডিসকো বিটের একক জনক হিসেবে পুরো ভারতেও জনপ্রিয় এবং পরিচিত ছিলেন। ভারতে তাকে ‘ডিসকো কিং’ হিসেবে ডাকা হতো। অন্যান্য দেশে তিনি ছিলেন ‘ভারতের ডিসকো কিং’। ১৯৮০’র দশকে তার বিখ্যাত ও জনপ্রিয় সিনেমা ‘ডিসকো ডান্সার’ ছবিটির কারণে সবচেয়ে জনপ্রিয় সঙ্গীত পরিচালকের আসনে বসে গিয়েছেন। যারা এই ছবির গানগুলো শুনেছেন তারা তার গলাটি ভুলতে পারবেন না।
নিজেকে বারবার ভেঙেছেন, গড়েছেন। তাকে মনে রাখতে হবে, পুরোপুরি বিনোদন দান করতে আসা একজন গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে, যিনি নিজেকে সুপারস্টার করেছিলেন। খুব ভালো পারকাশন বাজাতে পারতেন বাপ্পি লাহিড়ি। কেবল একজন নামকরা গায়ক ছিলেন না, বাপ্পি লাহিড়ি হিন্দি সিনেমার ভুবনের কিংবদন্তীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গেয়েছেনও। মোহামেদ রাফি ও কিশোর কুমারের সঙ্গে ডুয়েটগুলোর জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে রইবেন। ভারতের দুই বিখ্যাত গায়িকা বোন লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলের সঙ্গেও অনেক কাজ করেছেন তিনি। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে বলিউডে এনেছেন ভিজয় বেনডিক্ট ও স্মরণ প্রভাকরকে। আলিশা চিনাই ও উষা উত্থুপের নাম কামাবার পথটি গড়ে দিয়েছেন সঙ্গীত পরিচালনায়।
১৯৯০’র বছরগুলোতেও হিন্দি গানের ভুবনে রাজত্ব করে গিয়েছেন তিনি প্রকাশ মেহরার প্রযোজনায় ‘দালাল’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করে। নায়ক ছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। ছবিটির ‘গুটুর গুটুর’ গানটি খুব হিট করেছে। এই ছবিতেও তিনি বাকিগুলোর মতো গেয়েছেন। পরের দশকটিতেও আগের মতোই সাধারণ মানুষের মধ্যে বাপ্পি লাহিড়ির জনপ্রিয়তা প্রবাহমান ছিল। তার অ্যালবাম-‘বাপ্পি ম্যাজিক-দি অ্যাশলি বাপ্পা মিক্স’ সুপারহিট হয়েছে। তার ‘গোরি হায় কল্যায়ান’ ও ‘জিমি জিমি’ গান দুটি সিনেমায় বেরুনোর পর প্রবল ধুমধামের সৃষ্টি করেছে। ‘জিমি জিমি’ গেয়েছেন তিনি মিঠুনের কন্ঠে। ২০০৫ সালে তিনি ‘ম্যায় গান্ধিকো নাহিন মারা’ ছবিতে পরিচালক জুনু বড়ুয়ার জন্য কাজ করে খ্যাতি লাভ করেছেন।
অন্য সঙ্গীত পরিচালকদের জন্য গাওয়া শুরু করেন বাপ্পি লাহিড়ি ২০০৬ সালে। শুরুটি করেছিলেন ‘বম্বাই নগরিয়া’ গানে, কাজ করেছেন তাতে ভিশাল-শেখরের অধীনে। ছবির নাম ‘ট্যাক্সি নাম্বার ৯২১১’। সিনেমাটি বেরুনোর সঙ্গে, সঙ্গে গানটি হিট করেছে। মনি রত্নমের ছবি ‘গুরু’র মূল গানটিই তার, সুপারহিট হয়েছে। এখানে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন এ. আর. রহমান। এভাবে ভারতের হিন্দি ছবির বড় পর্দাগুলো জিতে নিয়ে টেলিভিশনের রিয়ালিটি শোগুলোর দিকে মনোযোগ দিয়েছেন তিনি।
বাপ্পি লাহিড়ি নামের সুপারস্টারকে কটি হিন্দি ও বাংলা সুপারহিট বাদে, আমাদের দেশের দর্শকরা চেনেন; সেটি টিভি শোগুলোর কারণেই। ২০০৬ সালে এই ভুবনে কাজ শুরু করেছেন তিনি। তখন জি টিভির জনপ্রিয় শো “সা রে গা মা পা লি’চ্যাম্পস”-এ, অলকা ইয়াগনিক ও অভিজিতের সঙ্গে সহ-বিচারক তিনি। দর্শক নন্দিত বিচারক ছিলেন জি টিভির ‘সা রে গা মা পা চ্যালেঞ্জ ২০০৭’ রিয়ালিটি শোতে। তাতে আরো বিচারক ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক-হিমেশ রেশমিয়া, ইসমাঈল দরবার ও ভিশাল-শেখর। বিনোদন চ্যানেল সনি এন্টারটেইনমেন্ট টেলিভিশনের ‘কে ফর কিশোর’ রিয়ালিটিতে কিশোর কুমারের মতো চুল নিয়ে উপস্থিত হয়েও নাম কুড়িয়েছেন বিখ্যাত গায়ক, পরিচালক। কেবল ভারতেই নয়, সারা বিশ্বজুড়ে ও বাংলাদেশের দর্শকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বাপ্পি লাহিড়ির রিয়ালিটি শোগুলো। এগুলোতে তিনি তার গানের মেধা ও গলা নিয়ে হাজির হয়েছেন। নিজেকে সম্মানিত করেছেন।
২০১৬ সালের শেষ দিকে তিনি কাজ করলেন আরেক ভুবনে। চলে গেলেন হলিউডে। ওয়াল্ট ডিজনির হিট থ্রিডি কম্পিউটার অ্যানিমেটেড-কাল্পনিক অভিযানের ছবি, ‘মোনা’র ভারতীয় ভাষার সংস্করণে ‘টামাটা’ চরিত্রে কন্ঠদান করেছেন। টামাটা হলো একটি কাঁকড়া। তার সিনাইয়ের জমানো ধনগুলো নেবার ঝোঁক আছে। ছবিটির সিনাই গানটির হিন্দি সংস্করণ ‘সোনা’ তিনি গাইলেন ও সঙ্গীত পরিচালনা করলেন। তিনি বলেছেন, ‘এই ছবিকে সহযোগিতা করতে পারা আমার জন্য বিরাট সম্মানের। সবসময় আমি নতুন কোনো দিকের প্রতি গিয়েছি, খুঁজে চলেছি। এই প্রথম কোনো অ্যানিমেটেড চরিত্রের জন্য কন্ঠ দান করলাম। তারপরও খুব ভালো লেগেছে। কারণ টামাটা খুব আমার মত। আমি মনে করি, আমার প্রতি স্রষ্টার এই দান মানুষজন উপভোগ করবেন। এটি আমার একটি স্বর্ণ স্মৃতি।’
তিনি উপস্থিত হয়েছেন রামরতনের গান ‘ইয়ে হাই ডান্স বার’-এ। বাপ্পি লাহিড়ি হিন্দি চলচ্চিত্রে তার সারাজীবনের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ফিল্মফেয়ারের ৬৩তম সম্মাননা পদক প্রদান অনুষ্ঠানে ‘আজীবন সম্মাননা’ লাভ করেছেন, ২০১৪ সালে। এ বছর তিনি রাজনীতিতে এসেছেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন।
গানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বাধাগুলো অতিক্রম করতে সারাজীবন বাপ্পি লাহিড়ি কাজ করেছেন। আরেকবার সুপারহিট অ্যালবাম দিয়ে ইতিহাস গড়তে চেয়েছেন তারপর। নাম ‘মাই লাভ’। অ্যালবামটি ভালো চলেছে। ভারতে তিনি ‘ডিসকো কিং’, অন্যরকমের পোশাক-আশাকের জন্য খ্যাতি লাভ করেছেন। অনেকগুলো সুপারহিট গানের গায়ক ছিলেন। হিন্দি সিনেমার ভুবনে একজন আন্তরিক এবং প্রিয় গানের তারকা হিসেবেও বিখ্যাত ছিলেন।
(ইংরেজি থেকে অনুবাদ)