‘ভালোবাসা দিবসের একদিনে ফুলের বিক্রি শত গুণ বেড়ে যায়’
বাংলাদেশে ফুল চাষ ও বিক্রি যারা শুরু করেছেন, তিনি সেই দুই একজনের মধ্যে আছেন। বাবুল প্রসাদ দশরথ ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। এই দেশে ফুল ব্যবসার শুরু কীভাবে হলো? চাষীদের সমস্যা, তাদের জন্য উদ্যোগ, সরকারের পদক্ষেপ-সবই বললেন তিনি ওমর শাহেদকে
এই ফুল বিপনন বাজারটি কবে শুরু হলো?
শাহবাগের এই পাইকারি ফুলের বাজারটি ১৯৯০ সালের প্রথম দিকের প্রথম সপ্তাহে গড়ে ওঠে। তখন থেকে ব্যবসাটি চলমান আছে। বাংলাদেশের মোট ২৩টি জেলায় বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষাবাদ হয়।
কোন, কোন জেলায়?
যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, বগুড়া, রংপুর, পঞ্চগড়, নাটোর, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম-এভাবে মোট ২৩টি জেলা। ফুলের ব্যবসায় এখন প্রায় ৩০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি ২০০৪ সালে রেজিষ্ট্রেশন লাভের পর থেকে ব্যবসায়ীদের কল্যাণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে এসেছে। যেহেতু আমাদের ক্ষমতার অত ব্যাপ্তি নেই, তারপরও ব্যবসায়ীরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা করে সংগঠনটি গড়ে তুলেছি। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি নামে আরেকটি সংগঠনের মাধ্যমে সারা দেশে আমাদের বিস্তার ঘটিয়েছি।
ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির মাধ্যমে কী, কী কাজ করেছেন?
ফুল ব্যবসায়ী ও চাষীদের জন্য ঋণ এবং চারার ব্যবস্থা করেছি। আগে তো আমরা দাদন দিয়ে ব্যবসাটি করতাম। প্রথমে যখন ফুলের চাষের কথা বললাম, চাষীরা ব্যবসা করতে ভয় পেত। ফুল তো পচনশীল দ্রব্য। এর জন্য তারা এর চাষাবাদ করতে চাইতো না। আমরাই প্রথম তাদেরকে দিয়ে ব্যবসাটি চালু করিয়েছি। আমরা তাদের কাছে গিয়ে, গিয়ে বোঝানো শুরু করলাম এবং শেষ পর্যন্ত তাদের বোঝাতে স্বক্ষম হলাম, এই ব্যবসাটি করুন। তাহলে আপনি লাভবান হবেন। ক্ষতিগ্রস্থ হবেন না। ফলে তারা এগিয়ে আসতে শুরু করলেন। এভাবেই বাংলাদেশে ফুলের ব্যবসার প্রচলন শুরু হয়েছে। এখনো চলমান আছে। কৃষিখাতে ফুল একটি খুব ভালো ব্যবসা। যেমন এক বিঘা জমিতে যদি কোনো কৃষক ধান চাষ করেন, ফসলটি থেকে হয়তো ৪ মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা লাভ হবে। কিন্তু এক বিঘা জমিতে কোনো চাষী যদি গাঁদা ফুলের চাষই করেন, তাহলে কমপক্ষে এক থেকে দেড় লাখ টাকার ফুল বিক্রি হবে। আয়ের সংখ্যাটি ১০ গুণ বেশি নয়?
শ্রম কেমন?
শ্রমটি ধানের মতোই। কৃষকের কাজই তো একটি-নিড়ানি দেওয়া, সার দেওয়া, চাষ দেওয়া, পানি দেওয়া, কীটনাশক দেওয়া। ধানেও তাই। ধান তো জমিতে রোপন করে রাখলে হবে না। পরিচর্যা করতে হবে।
ফুলের কী কোনো উপকারিতা আছে প্রকৃতিতে?
হাসির উপকারিতা আছে?
তা আছে। মন ভালো রাখে।
তাহলে ফুলেরও আছে। ফুল দেখতেও ভালো লাগে। কবি তো বলেছেন-জোটে যদি একটি পয়সা, খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি; দুটি যদি জোটে, তবে একটি দিয়ে ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী। বাজারে বিকায় ফল, তন্দুর; সে শুধু মেটায় পেটের ক্ষুধা, হৃদয়ের ক্ষুধা নাশে ফুল; দুনিয়া মাতে সেই তো সুধা। ফুল হলো হৃদয় ও প্রাণের ক্ষুধা; বেহেশতি বস্তু।
বাংলাদেশে প্রথমদিকে ফুল ব্যবসার কী অবস্থা ছিল?
প্রথমে আমরা ৮-১০ জনে মিলে ব্যবসাটি শুরু করলাম। যশোরের শের আলী সরদারের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফুলের ব্যবসার শুরু হলো। তাকে ঢাকার মজনু মিয়া ফাইনান্স করেন। শের আলীর বাড়ি গদখালি। এভাবে চালু হলো। তারপর নূর হোসেন, মাজেদ সরদার, তারা সবাই একে, একে আস্তে, আস্তে এগিয়ে আসতে থাকেন। আমরা তো ফুল ব্যবসাটি অন্যের দেখাদেখি করি। হয়তো একটি লোক লাভবান হচ্ছেন, দেখে আমিও এগিয়ে গেলাম। এভাবেই তো প্রসার হয়েছে। যেভাবে আগে বিকাশের দোকান এক মাইল দূরে পাওয়া যেত, এখন প্রতিটি মোড়ে আছে। যখন কোনো মানুষ বেনিফিটেড হয়, তখন তো সে কাজ করবেই। তারপর আমরা সবার জন্য এই ফুলের ব্যবসাকে উন্মুক্ত রাখি। যেভাবে পারেন, তারা এই ফুলের ব্যবসা করতে লাগলেন।
বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি কীভাবে শুরু হলো?
বাংলাদেশে প্রথম বাণিজ্যিক ফুলের দোকান হলো মালঞ্চ পুস্প কেন্দ্র। এই ঢাকা ক্লাবের সামনে ছিল। এখন আর নেই। এরশাদ সাহেব দোকানটি বরাদ্দ ও চালু করে দিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের জায়গায়। স্বল্পমূল্যে তিনি লিজ দিয়েছিলেন। সেই থেকে ঢাকায় ফুলের ব্যবসা চলছে।
শাহবাগের এই জায়গাটি আপনারা কিভাবে পেলেন? আসলেন কীভাবে?
জাতীয় জাদুঘরের উল্টোদিকে ও শাহবাগ থানার পাশের এই জায়গাটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। যখন ফুলের ব্যবসা চালু হলো...মানুষ তো তার গন্তব্য খুঁজে নেয়, মালঞ্চ চালুর পর কাছাকাছি আমাদের মাল (ফুল) আসা আরম্ভ করলো। আস্তে, আস্তে মানুষের মধ্যে ফুলের ব্যবহার শুরু হলো ও দিনে, দিনে বাড়তে লাগলো। গণমাধ্যমগুলোর কল্যাণে...এই ভ্যালেন্টাইন ডে তো আগে বাঙালি জানতো না। এক সময় বাংলাদেশের কোনো লোক জানতো না ভ্যালেন্টাইন ডে বলে একটি দিবস আছে। ফুলের কল্যাণে তারা এই দিনটি পালন করছেন।
পরিত্যক্ত জায়গাটিতে আপনারা কীভাবে কাজ করতেন?
একটি রাস্তার ধারে আমরা কাজ করতাম। ফুল বানাতাম, এনে রাখতাম ও বিক্রি করতাম। মালা বানাতাম নানা ধরণের। পরে আমরা সংগঠিত হয়ে একটি সংগঠন গড়ে তুললাম। সেটি আমাদের এই ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড।
তখন অসুবিধা কী, কী ছিল?
রোদে, বৃষ্টিতে ভিজে ফুল নষ্ট হয়ে যেত। পুলিশ একটু গ্যাদারিং দেখলে তাড়িয়ে দিত। সেগুলো ওভারকাম করে এই পর্যন্ত এসেছি।
দাদন দিয়ে যে ব্যবসা শুরু করলেন-এখন তো বাংলাদেশের ২৩টি জেলায় এবং যশোরের গদখালিসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক আকারে ফুলের চাষ হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে প্লাস্টিকের ফুল নয়, সত্যিকারের-আসল ফুল। মানুষের মধ্যে ভালোবাসা, সহমর্মিতা এবং অনুভূতির জন্ম দিয়েছে এই ফুল, ফুলের ব্যবসা। সেই সংগ্রাম?
ওই সময় আমাদের তো অনেক কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমাদের কোনো ফুল ব্যবসায়ী ও চাষী ইনভেস্টমেন্ট করার সময় কনফার্ম ছিলেন না যে রিটার্ন আসবে। এখন তো আমাদের শতভাগ রিটার্ন আসে। আসবে না কেন? বিশ্বে অনেক দেশ আছে ফুল ব্যবসায়ের জন্য বিখ্যাত। যেমন নেদারল্যান্ড। তাদের রাজস্ব আয়ের ৬০ ভাগ তারা আয় করেন ফুল আমদানী ও রপ্তানি থেকে। তাদের ফুল অকশন মার্কেটের যে বিমানবন্দর, আমাদের শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের মতো চারটির সমান। প্রতিদিন সেখানে ১শ ৩০টি বিমানে ফুল আসছে ও বিদেশে যাচ্ছে। তাদের এই ফুল খাতটি কত বড় এবার চিন্তা করেন। তাদের দেশের আভ্যন্তরীণ বাজারটি হলো প্রায় ১৫শ কোটি টাকার। ফুল বেচা-কিনির এই টাকার অংক তো কম নয়।
আপনারা কি বিদেশে রপ্তানি করতে পারেন?
কিছু করি। আমাদের অনেক ল্যাকিংস আছে। মূলধনের অভাব আছে। প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের অভাব আছে। অগানিক চাষের দক্ষতা ও ফুল চাষের সুযোগগুলো নেই। আমরা পলিশিয়েট করতে পারছি না। পলিশিয়েট না করলে বিরূপ প্রকৃতিতে-এই যে কদিন আগে বৃষ্টি হয়ে অমাদের অনেক ফুল নষ্ট হয়ে গেল; এমন হয়। যদি পলিশিয়েট থাকতো, তাহলে ফুলটি নষ্ট হতো না।
পলিশিয়েট কি?
একরকম পলিথিন দিয়ে বাগানের ওপর আচ্ছাদন দেওয়া থাকে। একটি ঘর বানানো থাকে গ্রিন হাউজ ধরণের। সেটি বাগানের আবহাওয়ার তামপাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ফুলকে ফোটানো হয় সম্পূর্ণরূপে। যেভাবে দেখবেন-বিদেশী শসা সব এক মাপের হয়। টমোটোও এক ধরণের হয়, ক্যাপশিকামও তাই। কিন্তু আমাদের দেশে এক একটি পণ্য যেমন ফুল এক, এক ধরণের হয়। এর কারণ, কৃষিজাত পণ্য তৈরির প্রযুক্তিতে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আধুনিক বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে আমরা তেমন জ্ঞাত নই, ফুল সেক্টরে আরো অনেক কম জ্ঞাত। কারণ বাংলাদেশে এই পর্যন্ত মোটে ৪ থেকে ৫ জন ফুল বিজ্ঞানী আছেন। আমাদের ফুল বিজ্ঞানীর অনেক অভাব আছে। প্রযুক্তির অভাব আছে। আমাদের পরিবহণের সমস্যা আছে। ফুলকে ছোট বাচ্চার মতো বহন করতে হয়। কিন্তু আমরা তো গরু-গাধার মতো বেঁধে নিয়ে আসি। ফুলের কোয়ালিটি বা গুণ ও মান নষ্ট হয় তাতে। সেলফ লাইফ নষ্ট হয়ে যায়, কমে আসে। একটি ফুল ৫ দিন টিকতো, সেটি তিন দিন থাকে। ফুলের যত্ন নিতেই হবে। কাটার পর থেকে হারভেস্টিং করতে হয়। আমাদের হারভেস্ট ম্যানেজমেন্ট মেনটেইন করতে হবে। উন্নত প্যাকিং ম্যাটেলিয়ালস থাকতে হবে। আমাদের রিপার ভ্যান থাকতে হবে।
রিপার ভ্যান কী?
এসি গাড়ি, যে গাড়িতে ফুল পরিবহন করা হয়।
আপনাদের কী এমন কোনো গাড়ি আছে?
নেই, তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধীনে কটি আছে। সেগুলো লাগসই প্রযুক্তির নয়, ভাড়ায়ও পোষায় না। ফলে আমরা ব্যবহার করি না।
তারা কী আপনাদের সহযোগিতা করেন?
সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন, কিন্তু কিছু বিধিনিষেধ ও অসুবিধা তো সবসময় আছে। তারপরও তারা আমাদের জন্য কাজ করছেন। যেমন-তাদের একটি ফি থাকে। সেটি দিলে আমাদের আর পোষায় না দেখি। ফি বিভিন্ন আকারের ভ্যানের ওপর ও মালামাল পরিবহনের মাত্রার ওপর নির্ভর করে। কোনো নির্দিষ্ট রেট নেই। তাদের বিভিন্ন সাইজের ও বিভিন্ন মডেলের গাড়ির ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন ফি থাকে। ভাড়ার গাড়িতে কয়দিন ইনভেস্ট করা সম্ভব? নিজের একটি থাকলে বছরের পর বছর চালানো যায়। ভাড়া নিয়ে চললে খরচ তো বেশি হয়। সেগুলো নেবার মতো সঙ্গতিও নেই আমাদের, দেশের চাষীদের। তারা যে জনে, জনে রিপার ভ্যান কিনবে সেটিও সম্ভব নয়। একটি রিপার ভ্যানের দাম দেড় কোটি টাকা। আমাদের ছোট্ট সংগঠনের পক্ষে কীভাবে কেনা সম্ভব?
সরকারী সহযোগিতা পেয়েছেন?
সরকারী, বেসরকারী, বিদেশী দাতা সংস্থা আছেন; তারা যদি সাহায্য করেন তাহলে সম্ভব। এনজিওরা আমাদের সাহায্য করেন। ইউএসএইড আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। তারা গদখালিতে আমাদের একটি কোল্ড স্টোরেজ করে দিয়েছেন। সেখানে আমাদের বীজ সংরক্ষণাগার আছে। গেডিং, শোডিং সেন্টার আছে। মানে সেখানে ফুলের মান ভাগ করে রাখার উপায় আছে। সব ফুল তো এক টাইপের হয় না। বিদেশে দেখবেন যে, তারা পুরো কার্যক্রমটি অটোমেটিক করেন। ফুলগুলো কেটে মেশিনে রেখে দিচ্ছেন। এক, এক মাপের ফুল একেক দিকে পড়ছে। ছোট লেন্থের ফুল এক দিকে পড়ছে। একটি ফুলে পোকা আছে, সেটি মেশিন ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে।
এখানে?
এখানে তো আমরা হাতে কাজ করি। মেয়েদেরকে দিয়ে করাই। ফলে আমাদের গেডিং, শোডিং ঠিক মতো হয় না। তারপরে আমাদের প্যাকিং ম্যাটেরিয়ালসের সহজলভ্যতা নেই।
তারা কোথায় আপনাদের কোল্ড স্টোরেজ করে দিয়েছেন?
গ্রামের নাম পানিসারা-গদখালি, ঝিকড়গাছা, যশোর। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা, আমাদের কোনো বীজ সংরক্ষণাগার নেই। আমরা যেকোনো কোল্ড স্টোরেজে বীজ রাখলে দেখা গেল, আলুর সঙ্গে রাখতে হচ্ছে। আমাদের প্রয়োজন ছয়মাস রাখা, কিন্তু আলু তিনমাস পর বের করা শুরু করেছে, বীজ সংরক্ষণাগারের তাপমাত্রা ওঠানামা করছে; তাতে আমাদের ফুলের বীজগুলো পচে গেল। আমরা তাদেরকে কিছু বলতেও পারছি না। কারণ আমাদের জন্য তারা এত বড় প্রজেক্ট করেননি। আবার আমাদের তো লাখ, লাখ বস্তা বীজ নেই। এমন অনেক সমস্যা আছে। সেগুলো ওভারকাম করতে চেষ্টা করছি। ইউএসএইড বীজ সংরক্ষণাগারে যাবার জন্য প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তা করে দিয়েছে। তারা আমাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন। প্রযুক্তিগত ও হাতেকলমে সব ফুলের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। বিদেশ ট্যুরের ব্যবস্থা করছেন, যাতে আমরা বাইরের দেশগুলোতে গিয়ে দেখে আসতে পারি, তারা কীভাবে ফুলের চাষ করেন, কীভাবে প্যাকিং ম্যাটেলিয়ালসের কাজগুলো করেন। আমাদের দেশের ফুলচাষীদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য তারা কাজ করছেন।
সেই কোল্ড স্টোরেজে আপনাদের কত ফুলচাষী ও শ্রমিক আছেন?
গদখালির সেই কোল্ড স্টোরেজ এখনো চালু হয়নি। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ফুলের মান নিয়ন্ত্রণের কিছু কাজ বাকি আছে। দুই-একমাসের মধ্যে হয়তো চালু হয়ে যাবে। সেটি চালু হলে সেই স্টোরেজে ৮ থেকে ১০ জন লোকের বেশির তো কর্মসংস্থান হবে না। তবে উপকৃত হবেন কাছাকাছি জেলাগুলোতে যারা থাকেন ও পুরো বাংলাদেশের মানুষ। ১৫ থেকে ২০ হাজার ফুলচাষীর উপকার হবে। একজন চাষীর সঙ্গে ২০ জন লোক এমনিতেই জড়িত থাকেন। বাগানে কাজ করছেন ১০ জন ফুল শ্রমিক। ফুলগুলো কাটছেন ৫ জন শ্রমিক। ভ্যানে সেগুলো এগিয়ে দিচ্ছেন আরো ৫ জন। ফুলগুলো বাঁধাই ও যত্ন করছেন বাকি ৫ জন। ২০ হাজার লোকের সঙ্গে আরো ৫ থেকে ৮ গুণ লোক কাজ করেন। ফলে এই পরিমাণ লোক মোট উপকারভোগী হবেন।
আপনাদের মূল সমস্যা?
আমাদের আর্থিক সমস্যাটিই সবচেয়ে বড়। কারণ একটি জমিতে পলিশিয়েট করতে গেলে খরচ হয় ১৫ লাখ টাকা। আমরা জনে, জনে তো আর করতে পারবো না। এই কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, পলিশিয়েট আমদানি করতে গেলে অনেক বড় অংকের টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। প্লাস্টিক আইটেম তো, সব জায়গায় সহজলভ্যও নয়। কাস্টমস ডিউটি বেশি পড়ে যায়। আমাদের দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকও নেই। একটি মোবাইল বানাবেন, প্রযুক্তিগত বিদ্যা তো আপনার জানা থাকতে হবে। আমাদের যে শেড বানাবে, তেমন এক্সপার্ট লোক নেই। আমরা কিছু শেড করেছি, ওখান থেকে দেখে এসে। নিজেরা শ্রম ও বুদ্ধি দিয়ে যতটুকু পেরেছি শেড তৈরি করেছি।
ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির মাধ্যমে কী, কী কাজ হয়েছে?
আগে ফুল পাঠিয়ে চাষীরা পরের বার চাষের টাকা অনেকদিনেও পেত না। প্রথমবার চাষের জন্যই টাকা পেত না। এজন্য আমরা তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে দাদন ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে টাকা দেবার নিশ্চয়তা দিতাম। তারা ফুলগুলো এরপর চাষ করে পাঠাতো। তারা ফুল পাঠিয়ে যেন টাকা ঠিকমতো পায়, আমরা সেটি এভাবে কন্টিনিউ করে দিয়েছি। এখন তো তাদের প্রতিদিন টাকার জন্য আসতে হয় না। উল্টো প্রতিদিনের টাকা তাদের কাছে প্রতিদিন চলে যায়। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত চাষীরা আজকে ফুল পাঠিয়ে একমাস পর টাকা পেত। কিন্ত এখন প্রতিদিনের টাকা তারা প্রতিদিন পেয়ে যাচ্ছে।
এখনো কী দাদন ব্যবসাতে লগ্নি হয়?
কিছুটা হয়, যেসব চাষীর আর্থিক অসঙ্গতি আছে। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে অনেক চাষী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তারা কোথা থেকে টাকা পাবে?
দাদন ব্যবসায়ীরা কোন এলাকার?
দাদন তো দাদন ব্যবসা আর সেই ব্যবসায়ী তো দাদন ব্যবসায়ী। যেমন আমি একজন ফুল ব্যবসায়ী। আমার এখানে একটি দোকান আছে (অতুল ইন্টারন্যাশনাল, ১০ ভাসানী রোড, ফুল মাকেট, শাহবাগ ঢাকা)। একজন চাষী বললো, ভাই, আমি ফুল চাষ করতে পারছি না, আমাকে কিছু টাকা দিন। দিয়ে দিলাম। কেন দিলাম? তার ফুলগুলো বিক্রি করে হয়তো শতকরা ৫ টাকা কমিশন রাখব। কিন্তু সে যদি নিজে কাজগুলো করতে যায়, তাহলে খরচ বেশি হবে।
ব্যাংক ঋণের বিষয়ে আপনারা চেষ্টা করেছেন?
দুই, একটি ব্যাংক এখন এগিয়ে এসেছে। কৃষি মন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দিক নির্দেশনায় আইএফআইসি, প্রাইম ব্যাংক এগিয়ে এসেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই তো ফুলকে বেশি লাইক করেন। তিনি অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে ও কৃষিমন্ত্রী একজন কৃষিবিদ; তিনি তো কৃষি বোঝেন-এই জন্য তার আগ্রহ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আছে। তিনি বোঝেন সমস্যাগুলো কোথায় ও সমাধান কীভাবে সম্ভব?
আইএফআইসি ব্যাংক আপনাদের ঋণ দেয়?
তারা আমাদের লোন দেন। ৪-৫ বছর আগে, প্রথমে আইএফআইসি ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে আমরা প্রায় ১ হাজার লোককে ১ লাখ টাকা করে দিয়েছিলাম। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির মাধ্যমে প্রাইম ব্যাংক সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা চাষীপ্রতি লোন দেয়। মাত্র ৪ থেকে ৫ মাস হলো এই লোন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। শখানেক চাষী নিয়েছে। যাদের প্রয়োজন নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি কেন করতে হলো?
দেখেন, বাংলাদেশে অনেকগুলো সমিতি আছে। ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি, শাহবাগ বটতলা ছিন্নমূল ব্যবসায়ী সমিতি, আগারগাঁও ফুল ব্যবসায়ী সমিতি, গোলাপ গ্রাম ফুল ব্যবসায়ী সমিতি, যশোর, গদখালি ব্যবসায়ী সমিতি, ঝিনাইদহ ফুল ব্যবসায়ী সমিতি। সরকার কার সঙ্গে যোগাযোগ করবে? একটি সংগঠনের দরকার। সবাই যদি কথা বলে তাহলে কার কথা শুনবেন তারা? তাহলে কিন্তু বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। এজন্য সরকারের নিদেশে একটি সেন্ট্রাল কমিটি গঠনের প্রয়োজন ছিল। দাতা সংস্থারাও চেয়েছেন, আপনারা একটি প্ল্যাটফর্মে আসেন, একজনে বলেন। সব জায়গার সমস্যাগুলো গুছিয়ে এনে একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে সরকারের কাছে বলেন। তাতে সরকারের আস্থা অর্জন করতে পারবেন ও তাদের বুঝতে সুবিধা হবে যে, এদের কাছে বললে এরা কাজ করতে পারবে। এই অনুভূতি থেকে আমরা ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি তৈরি করেছি।
এখন এখানে কত লোক আছেন?
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সদস্য মোট ১২ হাজার। তারা ফুল চাষী ও ব্যবসায়ী। আমাদের একজিকিউটিভ কমিটির মেম্বার হলো ৫১ জন।
কী, কী অর্জন আছে?
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি হওয়ার পরেই কিন্তু ওই কোল্ড স্টোরেজটি হলো। আমরা দীর্ঘদিনের যোগাযোগ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে এটি করিয়েছি। দেশে পাঁচটি অ্যাসেম্বল সেন্টার হয়েছে। সেন্টারগুলোতে চাষীরা ফুলগুলো কেটে নিয়ে রাখবেন ও বাছাই করবেন। এগুলো থেকেই প্যাকিং ম্যাটেরিয়াল দিয়ে প্যাক করে চূড়ান্তভাবে রেডি করে পাঠাবেন-ঢাকাসহ সারা দেশে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেতে ছয় ঘন্টা লাগে। এই সময়ের হিসাবগুলো ফুলের রাখতে হয়। সাভারের গোলাপ গ্রামে একটি সেন্টার হয়েছে, গদখালিতে দুটি হয়েছে, ঝিনাইদহতে একটি ও চুয়াডাঙ্গাতে একটি হয়েছে। আমরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সেন্টারগুলো একটি প্ল্যাটফর্মে থাকায় করতে পেরেছি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আমাদের জন্য গাবতলীতে একটি হোলসেল মার্কেট করে দিচ্ছে। এটি আমাদের মূল সমস্যা পাইকারি স্থায়ী বাজারের অভাব মেটাবে। কারওয়ানবাজার গাবতলীর যে জায়গায় স্থানান্তরিত হবে, সেই রাস্তার ঠিক উল্টো পাশে, বেড়িবাঁধের কাছে এক একর জমিতে ফুলের পাইকারি সরকারী মার্কেটটি তৈরি হচ্ছে। কাজ চলছে। তিনতলা ভবন হবে। মোট ৩শ ফুলের দোকান হবে। প্রদর্শনী ব্যবস্থা থাকবে। বিদেশে রপ্তানির জন্যই তো সেখানে কোল্ড চেইন ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইউরোপে গেলে তাদের অনেক কয়ারি আছে। তারা কোয়ালিটি চান, অগানিক ফুল চান। সাধারণ কিটনাশক দিয়ে ফুল চাষ করলে তারা নেবেন না। ফুলের জন্য ও প্রাণীকুলের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো ফুল নেবেন না।
বাংলাদেশের ফুলের তো অনেক বৈচিত্র্য?
অনেক বৈচিত্র্যময় ফুল আমাদের দেশে ফোটে। সেগুলোকে প্রকৃতি সহনশীল মাত্রায় চাষাবাদ ও রপ্তানিযোগ্য করে নিয়েই তাদের কাছে পাঠাতে হবে। গাবতলীতে সেজন্য সেমিনার হল থাকবে। বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য বিদেশ থেকে প্রশিক্ষকরা আসবেন, তারা প্রশিক্ষণ দিয়ে যাবেন। আমাদের শেখার আরো অনেক বাকি আছে। এখন আমাদের কেবল তো শুরু হলো।
এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী আপনাদের কখনো কোনো সহযোগিতা করেছেন?
না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরাসহ সবাই আমাদের ফুল কেনেন।
আর কোনো অসুবিধা?
বাংলাদেশে খুচরা ফুল বিক্রির কোনো জায়গা নেই। এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উল্টোদিকে আমাদের ২১টি দোকান করে দেওয়া হচ্ছে।
মহিলা ফুল শ্রমিকদের জন্য আপনাদের কোনো উদ্যোগ আছে?
অবশ্যই আছে। মহিলারা যেন সুন্দরভাবে তাদের ফুলগুলো রাখতে পারেন, সে ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছি। আমাদের এই মাকেটের পাশেই তারা কাজ করেন। তারা তো দোকান করেন না, ফুলের মালা গাঁথেন, ভালোভাবে ফুলটি বানান। ভোরে আসেন, কারো অধীনে কাজ করে সকালে চলে যান। তাদের ইউএসএইড ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সারা দেশে কয়েকটি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। জীবনমান উন্নয়নের জন্য আমরা অনেকবার সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছি। সেজন্য কাজ চলছে। তাদের বিভিন্ন ব্যবসায়ী মজুরি দেন। একজন মহিলা দিনে গড়ে ৭-৮ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকাও রোজগার করছেন। তারা ভোর চারটা থেকে আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত কাজ করে চলে যান।
বাংলাদেশে কত ধরণের ফুল বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানি হয়?
আমাদের ফুলের তো অভাব নেই। তবে বাণিজ্যিকভাবে গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, লিলি, জারবেরা ইত্যাদি বিক্রি হয়। আমাদের দেশের যেসব ফুল আছে, সেগুলোর কোনো বাণিজ্যিক মূল্য এখনো তৈরি হয়নি।
ভ্যালেন্টাইন ডে’তে ফুল বিক্রি কেমন বাড়ে?
এই ভালোবাসা দিবসের একদিনে ফুলের বিক্রি শত গুণ বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটিতে আপনি কবে থেকে সভাপতি?
আমি এবার নির্বাচিত হলাম। ২৩ জানুয়ারি ২০২২ সালে হয়েছি, আমার মেয়াদ ২০২৩ সাল পযন্ত আছে। আমি সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে শুরু করে এই পর্যন্ত সভাপতি আছি। আমাদের তো দুই বছর পর, পর বদলাতে হয়। পর, পর দুইবার থাকতে পারি। পরে অন্য কাউকে কাউন্সিলের মাধ্যমে দিতে হয়। আমি পাঁচবার সভাপতি হয়েছি।
(১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২; শাহবাগ, ঢাকা)