‘স্টুডিওগুলো থেকে আমি আশাবাদ নিয়ে এসেছি’
দিদি, আশা করি ভালো স্বাস্থ্য ধরে রেখেছেন।
আমার বয়স বিবেচনায়, মনে করি, সম্পূর্ণভাবে ভালো আছি। অবশ্যই অসুস্থতাগুলো রয়েছে। শরীরটি দুবল তবে সৌভাগ্যবশত মনটি আগের মতোই আছে। আমার বয়সের বেশিরভাগ মানুষ হয় চলে গিয়েছেন নয়তো হুইল চেয়ারে।
এর কারণটি কী আপনি ছাড়া বিশ্বটি কল্পনা করা যায় না?
এমনভাবে বলার জন্য ধন্যবাদ। তবে কেউই অপরিহার্য নন। অনেক আলোর উৎস, আমার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ঐশ্বরিক প্রতিভা পেয়েছেন-বিজ্ঞানী, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক নেতা, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরা আছেন; এসেছেন আবার চলে গিয়েছেন। বিশ্বে মানুষ বাস করে চলেছে।
তবে আপনার সম্পদ কোনোদিন মরবে না। আজ থেকে এমনকি একশ বছর পরেও গানগুলো শোনা হতে থাকবে।
আমি এই বিষয়ে নিঃসন্দেহ নই। আজকের দিনগুলোতে তরুণ প্রজন্মের মনোযোগের দূরত্ব খুব কম। তারা শেষ পযন্ত অতীতে বসবাস করে না। এখন সঙ্গে, সঙ্গে থাকা ও পাওয়াদের যুগ। প্রত্যেকে মুহূর্তটির জন্য বাঁচতে চায়। আপনার মতো মানুষরা যেমন করছেন, তেমনি আগামী প্রজন্মের মধ্যে উত্তরাধিকার অর্থ বহন করার বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।
সব বন্ধুরা ও সঙ্গীতের সমসাময়িকরা চলে গিয়েছেন।
আমি কী তাদের অভাব বোধ করি? অবশ্যই তাদের জন্য কাতর হই। মোহাম্মেদ রাফি সাব, কিশোরদা (কিশোর কুমার), মুকেশ ভাইয়া ও মান্নাদা (মান্না দে)’র মতো সহকর্মীরা আমার জীবনের অপরিবতনীয় অংশ ছিলেন। প্রতিদিন তাদের কারো না কারো কাছে দৌড়ে যেতাম। সম্পকগুলো কেবল কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না। সঙ্গীত পরিচালক ও কবিরা-মদন ভাইয়া (মদন মোহন), নরেন্দ্র শর্মা-যাকে আমি ‘ড্যাডি’ ডাকতাম; চিত্রগুপ্ত সাব (চিত্রগুপ্ত শ্রীবস্তব) ও মাজরুহ সুলতানপুরী সাব আমার বাড়িতে নিয়মিত আসতে অভ্যস্ত ছিলেন। আমিও তাদের সবাইকে দেখতে যেতাম। আমরা তেমন ছিলাম-যাদের পরিবারিক বন্ধু বলে। এখন লোকেরা ভিডিও করে দেখাসাক্ষাৎ করে।
প্রিয় সঙ্গীত পরিচালকরা কারা?
এটি একটি বিপদজনক প্রশ্ন। কেননা, যদি কোনো নাম ভুলে যাই, তাহলে বিপদে পড়ব (হাসি)। তবে সত্যিকারভাবে শঙ্কর-যাইকৃষণ, সলীল চৌধুরী, এস. ডি. বর্মণ, আর. ডি. বর্মণ, লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল, চিত্রগুপ্ত ও আমার ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের গান গাওয়া উপভোগ করেছি। নামগুলো এজন্যই উল্লেখ করেছি, কারণ তাদের জন্য বেশি কাজ করেছি। অন্য যে পরিচালকদের জন্য কাজ করেছি, তারাও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের প্রতিটি সঙ্গীত পরিচালক ও গীতিকারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তারা তাদের গানগুলো আমাকে গাইতে গিয়েছেন। হৃদয়ের গভীর থেকে কথাটি বললাম। যদি রাজা মেহেদী আলী খান ‘লাগ যা গালে’ না লিখতেন ও মদন মোহন সুরটি কম্পোজ না করতেন, কীভাবে আমি গাইতাম?
‘লাগ যা গাল’র কথাই বলি-কীভাবে আপনি এর অবিনশ্বর জনপ্রিয়তা অন্য গানগুলোর চেয়ে বেশি হবে হিসেব করেছিলেন?
এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। কেন অন্যগুলোর চেয়ে কিছু গান অনেক জনপ্রিয় হলো? ‘ওহ কারণ তুই’ ছবিতে অরেকটি সুন্দর কম্পোজড গেয়েছি-‘গজল’। সেটি ‘জো হুমনে দাসতান আপনি শুনারে আপ কিউ রয়ে’, কিন্তু ‘লাগ যা গালে’ বছরের পর বছর ধরে আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছে। কেহনা মুশকিল হায় কে এক গানা ধোরছে সে জায়াদা লগন কো কিয়ন পছন্দ আতি হায় (তার হিন্দিতে বলা কথাটির অথ-কীভাবে অন্যগুলোর চেয়ে কিছু গান জনপ্রিয়তার দৌড়ে এগিয়ে গেল বলা কঠিন।)
আপনার জনপ্রিয় গানগুলো অনেক দূরে, বিস্তুতভাবে যাচ্ছে। মানুষ সেভাবে শুনছেন। তবে পছন্দ এমন কিছু গান আছে, যেগুলো প্রাপ্য পায়নি?
স্বীকৃতির ব্যাপারে আমি জানি না। নিজের প্রিয় গানগুলো জনপ্রিয় হয়েছে এমনটি আমার কাছে প্রয়োজনীয় নয়। হৃদয়নাথের সঙ্গীত পরিচালনা ‘মায়া মেমসাব’র গানগুলো ভালোবাসি। লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারোলের একটি কম্পোজিশন (সঙ্গীত রচনা) আছে, ‘ইয়ে রাত ভাই যা রাহি হায়’। ছবিটি মনে করতে পারছি না (সাও সাল বাদ)। গানটিতে আমি খুব আসক্ত। তেমন আরেকটি গান আছে-সাজ্জাদ হুসাইন সাবের কম্পোজ , ‘এ দিলরুবা নাজরিন মিলা’, ‘রুস্তম-সোহরাব’ ছবি থেকে নেওয়া। গানটি ভালোবাসি। সেভাবে খুব ভালোবাসি ওই গানগুলো, যেগুলো পন্ডিত রবি শঙ্কর হৃষিকেশ মুখার্জির ‘আনওয়াদা’ ছবিতে আমার জন্য পরিচালনা করেছিলেন। ফলে অনেক গান পড়ে আছে, অনেক কারণে।
প্রকাশিত হয়নি এমন কোনো গানের কথা মনে করতে পারেন?
কালিয়মের করা একটি সুন্দর কম্পোজিশন ছিল, নাম-‘ইয়ে হাসিন রাত’। এটি আমার ও ইয়েসউদাসের ডুয়েট। কোনোদিনও রেকর্ডিং করা হয়নি। নিজে মনে করি, কামাল আমরোহিকে ছবিটি (মাজনুন) স্থগিত করতে হয়েছে। এমন আরেকটি আছে। একটি অ্যালবাম আছে, কম্পোজিশনগুলো গুলাম মোহমেদের; ‘পাকিজা’র জন্য করা; ছবিটিতে একটি অ্যালবামের গানগুলো অলংকারের মতো যুক্ত করা হয়েছে। এই আরেকটি অ্যালবাম ছবিতে যুক্ত করা হয়নি। ‘পাকিজা’ ছবির অব্যবহৃত গানগুলোও খুব সুন্দর ছিল। ওই গানগুলো জনপ্রিয় হতে পারেনি, কেননা তারা ছবিটিতে ছিল না। মোহমেদ রাফি, কিশোর কুমার, আশা ভোঁসলে, মুকেশ ও মান্না দে-আমার এই সহকমীদের সবারই জোর করে মুক্তি দেওয়া হয়নি এমন গান আছে। সেগুলো কোথাও না কোথাও ঘুমিয়ে রয়েছে।
এত গান ব্যবহার হয়নি বলে দু:খ করেন?
অনুতাপ বা দু:খ করার জন্য কোনো সময়ই আমার ছিল না। আমরা তো একটি রেকডিং স্টুডিও থেকে আরেকটিতে কাজের জন্য ছুটে গিয়েছি। আমার যে গানটি একবার রেকর্ড হয়ে গিয়েছে, সেটি কখনো শুনতে পারিনি। ফলে কোনটি ব্যবহার করা হয়েছে ও কোনটি ব্যবহার করতে পারেননি, সেসব জানার কোনো উপায় ছিল না। সেই দিনগুলোতে যদি কোনো গান ছবিতে ব্যবহার করা হতো না, সেটি যেমন প্রাপ্য, পেত না। লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলালের মিলন ছবিতে একটি সুন্দর কম্পোজিশনের কথা মনে পড়ছে, যেটি ছবিটি থেকে কেটে ফেলা হয়েছিল। গানটি-‘আজ দিল পে কই ঝর চলতে নাহিন।’ তাদের কম্পোজ করা অনেকগুলো গানের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয়গুলোর একটি। আমি খুশি যে, মহান মদন মোহনের কম্পোজ করা কিছু অব্যবহৃত গান যশ চোপরা ব্যবহার করেছেন। মদন ভাইয়ার ছেলে সঞ্জীব কোহশি, যে আমার কাছে ছেলের মতো; যশজিকে অনুরোধ করেছিল, তারা মদন ভাইয়ার কটি অব্যবহৃত কম্পোজিশন ‘ভির-জারা’তে ব্যবহার করতে পারেন। সেভাবে এই ভালোবাসাময় মেলোডিগুলো রক্ষা পেয়েছে। গানগুলোর মধ্যে আছে ছবিটির ‘তেরে লিয়ে’ ও ‘তুম পাস আয়ে রাহে হো’। না হলে তারা বিস্তৃতিতে তলিয়ে যেতে পারত।
৯২ বছর বয়সে, আপনি কী যৌবনকালকে মিস করেন?
ম্যায় আপকো সাচ বাতাওন (আমার কী আপনাকে সত্যিটি বলা উচিত)? বয়সকে আমি মোটেও অনুভব করি না। এখনো যৌবনকে অনুভব করি। নিজের অসুবিধাগুলোর ওজনে কখনো আমি পড়ে যাইনি। প্রত্যেককে তার জীবনের সমস্যাগুলো নিয়ে থাকতে হয়। এমনকী যখন যুবতী ছিলাম ও সংগ্রাম করে যাচ্ছিলাম, তখনো স্টুডিওগুলো থেকে আমি ভালো বোধ ও আশাবাদ নিয়ে এসেছি। কিশোরদা ও মুকেশ ভাইয়ার মতো সংগ্রামীদের নিয়ে কুস্তি করেছি। সারাটি দিন যখন না খেয়ে থাকতাম আমি, তখনো আমার জীবনে আনন্দ এসেছে। পার্সে কোনো টাকা নেই, কিন্তু সেই সময়গুলোতেও আমার মনে কেবল আশাই ছিল। ভবিষ্যত কেমন কঠিন হবে আমি দেখতে পারছি, সেই সময়গুলোতেও সবসময় একটি ভালো আগামীর জন্য আমার বিশ্বাস ছিল।
রেকর্ডিংয়ের সময় একবার গরমে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন?
একে ভুলভাবে অনুমান করে বছরের বছর বলা হচ্ছে-সলীলদা (চৌধুরী)’র সঙ্গে একটি গান রেকর্ডিং করার সময় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। অ্যায়সা কুচ নাহিন। অবশ্যই তার গানগুলো খুব জটিল ছিল আমার ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের কম্পোজ করা গানগুলোর চেয়ে। তবে আমার বাবা (দ্বীননাথ মঙ্গেশকর)’র আর্শীবাদের কারণে রেকর্ডিং স্টুডিওগুলোর যেকোনো সমস্যা মোকাবেলায় আমি দাঁড়িয়ে গিয়েছি। না, সেই দুর্ঘটনাটিতে সলীলদার সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে যাইনি। এটি নওশাদ সাবের সঙ্গে ঘটেছে। আমরা একটি গান দীর্ঘ গরমের দুপুরে রেকড করছিলাম। আপনি জানেন, মুম্বাই গরমকালে কেমন হয়ে পড়ে। সেই দিনগুলোতে রেকর্ডিং স্টুডিওগুলোর কোনোটিতেই এয়ার কন্ডিশনার ছিল না। চূড়ান্ত রেকর্ডিংয়ের সময় আওয়াজ যেন না হয়, সেজন্য সিলিং ফ্যানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হতো। ব্যাস, মে বেহুশ হু গায়ি (তাই অজ্ঞান হয়ে গেলাম আমি)।
মনে করতে পারেন কোনো নিদিষ্ট ঘটনা যেটি আপনার সঙ্গে ইচ্ছা করে করা হয়েছে?
সত্যিকারভাবে আমার কিছু মজার ঘটনা আছে। মনে করতে পারি, উমা দেবী (উমা দেবী খাতরি)’র সঙ্গে একটি ডুয়েট রেকর্ডিং করছিলাম, তিনি পরে নারী কৌতুকাভিনত্রী তুন তুন নামে পরিচিত হয়েছিলেন (এটি তার সিনেমা নাম, ২০০৩ সালের নভেম্বরে মারা গিয়েছেন)। উমা দেবী তখন একজন গায়িকা হিসেবে খাতি-পেতি ধরণের পেছন দিকের ছিলেন, ফলে পরে একজন অভিনেত্রী হয়েছে। তো আমরা সেখানে ছিলাম, দুইজনে একত্রে একটি মাইক্রোফোনে গাইছিলাম। পরে জানলাম, ডুয়েট থেকে একটি মাইক্রোফোনের কন্ঠ রেকর্ড হয়েছে। আমি একটি দুর্বল, ক্ষুদে বালিকা, তিনি শারিরীক কারণে মাইক্রোফোনের সামনে ভয়াবহভাবে উপস্থিত। আমাকে একটি টুল দেওয়া হলো দাঁড়াতে, যেহেতু মাইক্রোফোনটিতে পৌঁছাতে আমার সমস্যা হচ্ছিল। আমি আমার লাইনগুলো গাইলাম। এরপর উমা দেবী মাইক্রোফোনটির সামনে গাইতে এলেন। তিনি কনুইতে ধাক্কা দিলেন, মাটিতে পড়ে গেলাম (উচ্চস্বরে হেসে ফেললেন)।
কার সঙ্গে রেকর্ডিং সবচেয়ে উপভোগ করেছেন?
কিশোরদা। তার সঙ্গে রেকর্ডিং করা পুরো সেশনটি মজা ও খেলার মাধ্যমে কাটানোর মতো। তিনি আমাকে এত বেশি হাসাতে পারতেন যে, খুব কমই গাইতে পারতাম। আমার তাই তাকে থামিয়ে দিতে হতো। বলতাম, কিশোরদা পেহলে গানা, পাহির মাস্তি (কিশোরদা প্রথমে গান পরে আনন্দ)। বিশেষভাবে সমস্যা হতো যখন আমরা দুঃখের দ্বৈত গান গাইতাম। দু:খের মধ্যে, আমার চোখ দুটি হাসতে, হাসতে পানিতে ভরে যেত।
এটি বলা হয়, রেকর্ডিংয়ে যুক্ত বাঘা মানুষরা আপনি যখন মদন মোহনের ‘হের’ গানটি ‘হের রাঞ্জা’ ছবিতে ও এস. ডি. বর্মণের ‘তুম মুঝছে দীর চাহলে জানা না’ ‘ইশক পার ঝোর নাহিন’ ছবিতে গেয়েছেন, সবাই কেঁদেছেন?
এই কথাটি সত্য। আমাকে বাদ দিয়ে তারা সবাই এই গান দুটির সময় কাঁদছিলেন। আমি কখনো কাঁদিনি এমনকি যখন সবচেয়ে বিষন্ন গানগুলো গেয়েছি। আমি কান্নার চেয়ে সবসময় হাসাকে পছন্দ করেছি। ঈশ্বর সবসময় দয়ালু থেকেছেন আমার প্রতি। ফলে আমাকে জীবনে কোনোদিনও কান্নার মতো কারণ দেননি তিনি। আমি জানি, যখন নিজের বাবা ও মাকে হারালাম তখন আমি সবচেয়ে বেশি কেঁদেছি।
সিনেমাতে কোন বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কোনোদিনও কাজ করতে পারেননি?
ও.পি. নাইয়ার। আমার বোন আশার কণ্ঠ তার পরিচালনার স্টাইলের বেশি উপযুক্ত।
কোনো প্রিয় ভাবনা?
আমাকে ৭০ বছরের বেশি সময়কাল ধরে শুনে যাওয়ার জন্য শ্রোতাদের কোনোভাবে যথেষ্ট ধন্যবাদ দিতে পারিনি। কীভাবে সময়টি উড়ে চলে গেল আমি জানিও না। ওয়াক্ত ক্যায়সে নিকলা গানা পাতা হি নাহিন চালা। আবার যদি সেই দিনগুলোতে বাস করার কোনো উপায় থাকত, আমি কোনোকিছুই বদলাম না। এমনকী উমা দেবীর সঙ্গে গাইতে গিয়ে টুল থেকে পড়ে যাওয়াও।
(৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, মুম্বাই)
ফাস্টপোস্ট অনলাইনের ইংরেজি থেকে অনুবাদ।