এই ছিল সবচেয়ে সুমধুর সহযোগিতা
লতা মঙ্গেশকর-একটিই কন্ঠ স্বর্গ থেকে নেমে আসা। মদন মোহন জাদু করতে পারতেন এই কনঠেকে, তার সুরগুলো কন্ঠটি থেকেই তো শব্দ হয়ে ঝরতো। যখন তারা হাত মেলাতেন, সৌভাগ্যক্রমে, প্রায়ই ফলাফল হতো নিছক জাদু। লতা ও মদন একত্রে হিন্দি সিনেমাকে সবসময়ের সবচেয়ে ভালো কটি গান উপহার দিয়েছেন। বিপুলভাবে সফল তাদের সহযোগিতা; এমনটি ভারতীয় সিনেমাগুলোর কোনোটিতেই সাধারণত হয় না। কারো মধ্যেও নয়-সঙ্গীত পরিচালক কী গায়ক, গায়িকা। সাধারণত সঙ্গীত পরিচালকেরা তাদের সেরাটি প্রিয় কন্ঠটির জন্য জমা করে রাখেন। যদিও আজকাল ঘন, ঘন হচ্ছে। এখন এমন একটি সময়, যখন গান ও সুর এবং গীতটি যতটুকু অপরিহার্য হবার কথা, সেভাবে ছবিতে ব্যবহার হচ্ছে না। তবে এই ভারতীয় সিনেমাতেই-প্রধানত এবং মূলত হিন্দি ছবিগুলোতে অতি কার্যকর মেলবন্ধন নওশাদ-মোহাম্মেদ রাফি, আর.ডি. বর্মণ-কিশোর কুমার, ও.পি. নাইআর-আশা ভোঁসলে, ইলায়ারাজা-এস.পি. বালাসুব্রাহামানইয়াম, এম.এস.বিশ্বনাথন-পি. সুশীলা. এম.এস বাবুরাজ-এস. জানকী, জি দেবারাজন-ইয়েসুদাস, রাভেনধারণ-ইয়েসুদাস ও এ. আর. রহমান-হরিহরণের মধ্যে আছে। তবে লতা মঙ্গেশকর ও মদন মোহনের মধ্যে যেমন সুরসৃষ্টি করা ধারাবাহিক সহযোগিতা পাওয়া গিয়েছে, তেমনটি খুব কমই হিন্দি ছবিগুলোতে হয়েছে, এখনো তাই হচ্ছে।
তাদের স্টাইক রেট এত বেশি যে, একমাত্র তুলনা ব্রাডম্যান বা শচীনের ব্যাটিংয়ে। তাদের গানগুলো থেকে কোনো পছন্দের তালিকা করারই প্রয়োজন নেই। কেবল একটি গান বেছে নিলেই হলো, ডুবে যাবেন সুর ও কন্ঠের অপূর্ব ভুবনে।
শুরু করতে পারেন, ‘তাক লাগ যা গালে...তে। সম্ভবত তাদের জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে সেরা। এমন সার্বজনীন রূপ লাভ করেছে ভালোবাসা ও সুরের জাদুতে, খুব বেশি গান স্বয়ং লতাও নেই। যেকোনো সঙ্গীত পরিচালকের জন্য এমন গৌরব অনন্য-২২ লাখ বার গানটি ইউটিউবে ২০১০ সালে তুলে দেবার পর দেখা হয়েছে। যদিও সবার জানা, লতা মঙ্গেশকর আকর্ষণীয় ছিলেন না দেখতে। তাতেই এই। নিজেকে নিয়ে বড়াই কোনোদিনও করেননি ভারতের বলিউডের গানের রাণী। কেবল দিয়ে গিয়েছেন তিনি। এও সবার জানা। এবার আরো চমকে দেবার মতো তথ্যটি-যে ছবির গানটি, বেরিয়েছিল ১৯৬৪ সালে। নামটি ‘ওহ কারণ তুই?’ ইউটিউবে আসার আগে বহু, বহু বছর; ছেলেকে বুড়ো বানিয়ে দেওয়ার সময়কাল ধরে মানুষের মন, সিনেমা হল, রেডিও ও ক্যাসেটে বেজে চলেছে। ফলে আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দেবার প্রতিযোগিতা তাকে করে যেতে হয়েছে গায়িকার মতোই। গানের সুরগুলো খুঁজে, খুঁজে সুন্দরের উদাহরণ হিসেবে মানুষ লাভ করেছেন। যেভাবে রাণী গেয়েছেন...শুরু থেকেই তিনি হামিং বা গুণ, গুণ করেছেন, গানের ভেতরেই শ্রোতাকে বরশি দিয়ে জীবনের দিকে টেনে নিয়ে এসেছেন। গানটির মধুরতম বিষয় হলো, পুরোটাতেই অনন্যতা তুলে এনেছেন তারা। এগুলো মদন মোহন ও লতা মঙ্গেশকর তাদের কাজে এনে দিয়েছেন। তাহলে এটিই কী তাদের সেরা? সম্ভবত নয়। একটি হলো আরো পুরোনো ছবি ‘জাহান আরা’র ‘ওহ চুপ রাহে তো’, আরেকটি গজল’র ‘নাগমা ও শের কি’। অনায়াসে, সঙ্গে, সঙ্গে মনের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে ঢুকে পড়ে। মহান যৌথ সৃষ্টির মধ্যে কটি-‘নয়ন মে বাদরা (মেরা ছায়া)’, ‘আপ কি নাজরন নে (আনফাদাহ)’, ‘মেরি রি ও বাইয়ান না ধারো (দস্তক)’, ‘নায়না বারষে (ওহ কারণ তুই), ইউন হাসরাতুন কে (আদালত)’ ও ‘তেরি আনকারণ কি সিবা (চেরাগ)’।
তারপরও সঙ্গীত ইতিহাসের জন্য দুর্ভাগ্য, অবিশ্বাস্য প্রতিভার বিচ্ছুরণ তৈরি করা গানগুলোর কোনোটিই মদন মোহনকে জীবদ্দশায় সাফল্য এনে দিতে পারেনি। তিনি পয়সার মুখ দেখতে পারেননি তাদের দিয়ে। এমনকী জীবনে ভালোভাবে, যথেষ্ট সমাদৃতও হতে পারেননি। কাজ করতে পারেননি অনেকগুলো বড় বাজেটের ছবিতে, বড় সিনেমাগুলোও তার কাছে খুব আসেনি।
দিন শেষে মদন মোহনের কপালে দামী ও জনপ্রিয় পুরস্কারগুলো জোটেনি। হিন্দি ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের প্রিয়তম এই অপরজন মদন মোহন-১৯২৪-১৯৭৫ সাল; এসব নিয়ে যথেষ্ট তিক্ত অভিজ্ঞতা পেয়েছেন । তারপরও এই গানগুলোর ভেতরে নিজের সঙ্গীত জীবন ও প্রতিভা নিয়ে সান্তনা খুঁজে পেয়েছেন। কাজ করে গিয়েছেন এজন্য, যখন আমি লতার মঙ্গেশকরের সঙ্গে জাদু তৈরি করতে বসব, এই ভুবন ও সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে দশকের পর দশক গানের আনন্দ নিয়ে আসবে ওরা কথা, কন্ঠ ও সৃষ্টিশীলতায়।
(দি হিন্দু থেকে)