দুশ্চিন্তার ভাঁজ গদখালীর ফুল চাষিদের কপালে
উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন যশোরের গদখালীর ফুল চাষিরা। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সবচেয়ে বেশি ফুল বিক্রি হয় যশোরের গদখালীতে। কিন্তু করোনা বিধি নিষেধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবছরও লোকসানে পড়তে হচ্ছে তাদের। যেখানে করোনা কালের আগে দৈনিক কোটি টাকার ফুল বিক্রি হতো, তা এখন নেই বললেই চলে। গত বছরের শেষ দিকে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলে আশা জেগেছিল চাষিদের মনে। প্রত্যাশা ছিল গত দুই বছরের লোকশান এবার কাটিয়ে উঠতে পারবেন। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও ছিলো। কিন্তু গত মাস থেকে করোনা পরিস্থিতি আবার উদ্বেগজনক হারে বাড়ায় দুশ্চিন্তার ভাঁজ গদখালীর ফুল চাষিদের।
গদখালীর ফুলচাষি শফিয়ার রহমান জানান, মহামারি করোনা ও আম্পান ঘূর্ণিঝড়ের কারণে টানা দুই বছরের মন্দাভাব কাটিয়ে তিন বিঘা জমিতে গোলাপ ও দেড় বিঘা জমিতে গাঁদা ফুলের চাষ করেছেন । আসছে পয়লা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের জন্য উৎপাদিত ফুল বিক্রি করে গত দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেবেন তিনি। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর মুখে হঠাৎ করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট অমিক্রন বিস্তারে কারণে সরকার বিধি-নিষেধ জারি করেছে। এতে চিন্তায় পড়েছেন তিনি। করোনার বিধি-নিষেধে ইতোমধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় কমতে শুরু করেছে ফুলের দাম। এমন পরিস্থিতিতে সামনের দিবসগুলোতে ফুল বিক্রি নিয়ে সংশয়ে আছেন এই ফুল চাষি।
হাড়িখালি গ্রামের ফুল চাষি রুবেল হোসেন জানান, করোনা আর আম্পানে লণ্ডভণ্ড হওয়া ফুল ক্ষেত রক্ষায় ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে নুতন করে আবাদ শুরু করেছি। আশা করেছিলাম, সামনের দিবসে ভালো দামে ফুলগুলো বিক্রি করতে পারলে ঋণ শোধ করতে পারবো। কিন্তু জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে এসেছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট অমিক্রন। ফুলের ভরা মৌসুমে সরকার সকল অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ায় ফুলের দাম কমে গেছে। ফুল বেচাকেনায় ভাটা পড়ে তাহলে পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী-পানিসারা ইউনিয়নে হাজারো একর জমিতে বছরজুড়ে উৎপাদন হচ্ছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুল। পথের দুই ধারে গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্ল্যাডিওলাস, গাঁদা, জারবেরা ফুলের ক্ষেত। লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি আর সাদা রঙের এক বিস্তীর্ণ বিছানা যেন বিছিয়ে রেখেছে। এ দৃশ্যে চোখ জুড়ানোর পাশাপাশি জুড়িয়ে যায় হৃদয়ও। দেশে উৎপাদিত ফুলের ৬০ ভাগ যোগান হয় এখান থেকে।
গদখালীর টাওয়া গ্রামের কৃষক নিমাজ উদ্দিন বলেন, করোনার কারণে গত বছর বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও পয়লা ফাল্গুনে কোনো উৎসব না হওয়ায় ফুল বিক্রি করতে পারিনি। তবে গেল বছরের সেপ্টেম্বর থেকে করোনা স্বাভাবিক হওয়ায় ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফুল বেচাকেনা ছিলো ভালো। এবারও ভালোবাসা দিবস ও পয়লা ফাল্গুনে অমিক্রন হানা দিয়েছে। কত টাকার ফুল বিক্রি হবে এ বছর, তা নিয়ে শঙ্কায় আছি। কারণ, চলমান করোনা পরিস্থিতিতে দেশে বিয়েসহ সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান কমেছে। উৎসব আয়োজনও সীমিত হয়ে পড়েছে।
গদখালী বাজারে ফুল ব্যবসায়ী আব্দুস সামাদ জানান, বর্তমানে ফুলের বাজার খুব খারাপ। লকডাউন না দিলেও করোনা আতংকে ফুল বেচাকেনা কম। বর্তমানে বাজারে প্রতি হাজার গাঁদা ফুল বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা। যা এক মাস আগে ছিলো ৮০০-৯০০ টাকা দরে। একেকটি গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ৬ টাকা, যা আগে বিক্রি হয়েছে ৭-৮ টাকায়। রজনীগন্ধা একেকটি স্টিক বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫ থেকে ৬ টাকায়, যা আগে ছিল ৭-১০ টাকায়। রঙিন গ্ল্যাডিউলাস প্রতিটি মান ভেদে বিক্রি হচ্ছে ৪-৫ টাকায়, যা আগে ছিল ৯-১২ টাকায়। জারবেরা বিক্রি হচ্ছে ৪- ৬টাকায়, যা আগে দাম ছিল ৮-১০ টাকায়। ফুল বাঁধার জন্য কামিনীর পাতা বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ টাকা আঁটি, যা আগে ছিল ৫০-৬০ টাকা। জিপসির আঁটি বিক্রি হয়েছে ২০-৩০ টাকা। যা আগে বিক্রি হতো ৩০-৪৫ টাকায়।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার্স সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, ফুলের ব্যবসা মূলত বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক। গত দুই বছর করোনায় লকডাউনের কারণে ফুল বিক্রি করতে না পেরে পথে বসতে হয় চাষিদের। কেউ আবার ফুলের আবাদ ছেড়ে অন্য ফসলের আবাদ শুরু করেছিলেন। করোনার প্রকোপ কিছুটা কমায় ঋণ নিয়ে অনেকেই নতুন করে শুরু করে ফুলের আবাদ। নতুন ভ্যারিয়েন্ট অমিক্রনের কারণে সামনের দুই দিবসে ফুল বিক্রি করতে না পারলে নিঃস্ব হতে হবে চাষিদের।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুবাষ বসু জানান, চলতি বছর ঝিকরগাছার গদখালি ও পানিসারা ৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ফুল চাষ হয়েছে। করোনাকাল কাটিয়ে উঠে এখানকার কৃষকরা অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। ফুলের উৎপাদন, চাহিদা ও দাম সবই বেশ ভালো ছিলো এবার। আসন্ন দুটি দিবসে করোনার বিধি নিষেধ থাকলে ফুল চাষিদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাবে আরও।
এমএমজে/