ইঁদুর ধরাই আনোয়ারের পেশা
পুব আকাশে যখন সূর্য উঁকি দেয় তখন সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে কোদাল, সাবোল ও লোহার কাঁচা নিয়ে ফসলি জমিতে কিংবা রাস্তার ধারে ধারে ইঁদুর ধরতে বের হন জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার ভট্টপলাশী গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। তিনি মাটির গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারেন ইঁদুর আছে কি না। তারপর কোদাল দিয়ে মাটির গর্ত থেকে টেনে আনেন ইঁদুর। তার নেশা ইঁদুর ধরে ফসল নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা।
সরজমিনে জানা যায়, আক্কেলপুরের আনোয়ার হোসেন ছিলেন রাখাল। পরিবারের বড় সন্তান তিনি। অভাবের সংসারে পেটভরে খাবার জুটত না। সেজন্য আনোয়ার অন্যের বাড়িতে রাখাল হিসেবে কাজ করেছিলেন। মাঠে মাঠে গরু চরানোর সময় ধান কাটা খোলা মাঠে খুঁজে বের করতেন ইঁদুরের গর্ত। পরে সেই গর্ত থেকে ইঁদুর ধরতেন এবং গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ করতেন। সেই ধান বিক্রি করে মোয়া কিনে খেতেন। এভাবেই গর্ত থেকে ইঁদুর সরিয়ে ধান সংগ্রহ করতে করতে ধান বের করার বিশেষ কৌশল রপ্ত করেন। তখন থেকে বয়স বাড়ার সঙ্গে দক্ষ হয়ে ওঠেন ইঁদুর নিধনে।
১৯৯৫ সাল থেকে ইঁদুর ধরা পেশায় নিয়োজিত আছেন আনোয়ার হোসেন। এভাবেই তার নেশা থেকে হয়ে ওঠে পেশা। সেই সঙ্গে তিনি নিজ জেলা ছেড়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় ইঁদুর নিধনের ওষুধও বিক্রি করেন। তার এমন ব্যতিক্রমী বিশেষ কায়দায শিখতে পাশের জেলা থেকে ছুটে আসে বিভিন্ন বয়সের মানুষ।
প্রতি বছর স্থানীয় কৃষি অফিসে ৫-৭ হাজার ইঁদুরের লেজ জমা দেন আনোয়ার। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৫ লাখ লেজ জমা দিয়েছেন। ইঁদুর নিধনে বিশেষ অবদান রাখায় তিনি ২০০৪ সালে জাতীয় পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে ১৪ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশনসহ পেয়েছিলেন আরও পুরস্কার। এখন ইঁদুর ধরতে জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে তার অনেক ডাক আসে। এর বিনিময়ে তাকে দেওয়া হয় চাল, খাবারসহ কিছু টাকা পয়সা।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রায় ২৮ বছর আগে রাখাল ছিলাম। অন্যের গরু মাঠে চরায়ে পেটের ভাত জোগাড় করতাম। পাশাপাশি ফসলি জমির পাশে গর্তের মধ্যে ধান সংগ্রহ করতাম। সেই ধান বিক্রি করে মোয়া কিনে খেতাম। ইঁদুর ধরে ধান বের করা ভালোই লাগত। ঘরের আসবাবপত্র, ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে ইঁদুর। বাড়ির কিংবা ক্ষেতের ইঁদুর মেরে বিনিময়ে পাই পান, চাল অথবা টাকা। তা দিয়েই দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে চলে তার সংসার। ইঁদুর মারার কারণে গ্রামের সবাই ইঁদুর আনোয়ার বলেই ডাকেন।‘
তিনি বলেন, কৃষকরা আমাকে ডেকে নিয়ে যান ইঁদুর ধরার জন্য। আমি কৃষকের ফসলের ক্ষেত ও বাড়ি থেকে ইঁদুর ধরে মৃত ইঁদুরের লেজ সংগ্রহ করি। এতে কৃষকরা খুশি হয়ে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বকশিশ দিয়ে থাকেন।’
ভট্টপলাশী গ্রামের বাসিন্দা ফেরদৌস মণ্ডল বলেন, দূর-দূরান্ত থেকে ডাক আসে ইঁদুর ধরার জন্য। যেকোনো ধরনের ফসলের ক্ষেত, বাড়ি কিংবা গাছের ইঁদুর ধরতে পারেন তিনি। এখন গ্রামের উৎসাহীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। ইঁদুর নিধনের মাধ্যমে ফসল রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন আনোয়ার।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত ফসলের ১৫ থেকে ২০ ভাগই চলে যায় ইঁদুরের পেটে। প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ফসল, আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র নষ্ট করে ইঁদুর। নানা উপায়েও যখন ক্ষতি থামানো যাচ্ছে না, তখন ইঁদুর নিধনের দারুন কৌশল রপ্ত করেছেন। প্রতি বছর ২ থেকে ৪ লাখ ইঁদুর নিধন করেন। যার করণে গত বছর এ জেলায় ৯০ হাজার টন ফসল রক্ষা করা গেছে। ফলে নেশা থেকে একসময় ইঁদুর ধরাই তার পেশা হয়ে দাঁড়ায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রাহেলা পারভীন জানান, আনোয়ার হোসেন প্রাকৃতিকভাবে ইঁদুর ধরার অনেক কৌশলও রপ্ত করেছেন। যার মাধ্যমে তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। এর আগে সর্বোচ্চ ইঁদুর নিধনের জন্য পুরস্কৃত হয়েছিলেন। আবারও সর্বোচ্চ ইঁদুর নিধন করতে পারলে পুরস্কার পাবেন।
এসএন