পাখিরাই দুলালের সন্তান
নাটোরের সিংড়া উপজেলার জোড়মল্লিকা গ্রামের কাচু প্রমাণিকের ছেলে দুলাল হোসেন। পেশায় ঝাঁলমুড়ি বিক্রেতা। সারাদিন ওই ঝাঁলমুড়ি বিক্রি করে যা আয় করেন তা দিয়েই চলে তার সংসার। স্ত্রী, এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে তার সুখের সংসার। তার নেই কোনো উচ্চাকাঙ্খা। নেই কোনো অভিযোগ। শখ বলতে বনের পাখিদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। প্রতিদিন তাকে পাখিদের সঙ্গে কথা বলতেই হবে। তাদের আদর করে ডেকে খাবার খাওয়াতে হবেই। আর এ কারণে এলাকার মানুষের কাছে তিনি পাখিপ্রেমী হিসেবেই পরিচিত।
স্থানীয়দের দাবি, প্রতিদিন সকাল-বিকাল দু-বেলা পাখিদের লক্ষ্য করে দুলালের আদরের ডাক শুরু হয়। 'তোতা-ময়নারা আয় আয় আয়। জান ময়নারা আয় আয় আয়। খেয়ে যা খাবার। সময় হয়েছে। আয় আয় আয়। ভয় নাই। আমি আছি, আয়।’ দুলালের ওই ডাক শুনে বিভিন্ন গাছ থেকে নিচে নামতে থাকে পাখির দল। ছুটে আসে শালিক, বুলবুলি, চড়ুই, ময়নাসহ নানা প্রজাতির শত শত পাখি। ওই পাখিরা কাছে আসতেই হাত দিয়ে ছিটিয়ে তাদের খাবার দিতে থাকেন দুলাল। পাখিরা খাবার খেয়ে কৃতজ্ঞতার ডাক দিতে থাকে। সেইসঙ্গে দুলালের দিকে তারা ঘার ঘুড়িয়ে তাকায় আর ডাকে। আর ওই দৃশ্য দেখে দুলালের মুখে ফোটে হাঁসি।
জানা যায়, পাখিদের খাবার দেওয়া শেষ হলে তারা উড়ে যায় গাছের শাখে, আকাশে। তখন দুলালও চলে যান নিজ কাজে। এভাবেই চলছে গত ৫টি বছর। এমনকি এলাকায় কেউ পাখি ধরতে বা শিকার করতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ান দুলাল।
সরেজমিনে দেখা যায়, জোড়মল্লিকা সেতুর পাশে একটি ঝুপড়ি ঘরে ঝাঁলমুড়ির পসরা সাজিয়ে বসেছেন দুলাল। সময় বিকাল প্রায় ৪টা। হঠাৎ নজরে এলো উপর দিয়ে যাওয়া বিদ্যুতের তার। সেখানে এক এক করে এসে বসছে শালিক, বুলবুলি, চড়ুই, বাবুইসহ নানা পাখি। ওদের দেখেই মুচকি হাঁসির ঝিলিক দেখা যায় দুলালের মুখে। নিমিষেই নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিলেন বয়ামে রাখা চানাচুর। ছিটিয়ে দিলেন মাটিতে। আবারও হাতের মুঠোয় চানাচুর নিয়ে মাটিতে ছিটাতে ছিটাতে সজোরে ডাকতে লাগলেন পাখিদের।
পাখিদের খাবার শেষে কথা হয় দুলালের সঙ্গে। জানা যায়, ৬ বছর আগে ইউপি সদস্য পদে নির্বাচন করেছিলেন দুলাল। আশা করেছিলেন নির্বাচিত হবেন। কিন্তু শেষ অবধি নির্বাচিত হননি। কারণ মানুষ তাকে আশা দিয়েও ভোট দেয়নি। এর পর থেকেই তার মনে হতে থাকে মানুষের চেয়ে পাখিরাই ভালো। তখন থেকেই পাখিদের নিয়মিত খাবার খাওয়ানো শুরু করেন তিনি।
পাখিপ্রেমী দুলাল হোসেন জানান, ছোটবেলা থেকেই পাখিদের প্রতি তার একটা টান ছিল। প্রথম দিকে খাবার ছিটালে কিছু পাখি আসত। তবে তার সঙ্গে পাখিদের সম্পর্ক এখন মধুর। তাই তার ডাকে এখন শত শত পাখি হাজির হয়।
তিনি আরো জানান, দিনে দিনে তার কাছে আসা পাখির সংখ্যা বাড়ছে। নিজের পরিশ্রমের অর্থ দিয়ে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করে শান্তি পাই। কখনো কখনো নিজে না খেয়েও তাদের খাবার জোগাড় করি। তারা খেলে আমার প্রশান্তি লাগে, মনে তৃপ্তি লাগে।
পাখিদের প্রতি ঝাঁলমুড়ি বিক্রেতা দুলালের এমন ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ স্থানীয়রা। পাখিদের সঙ্গে তার ওমন মধুর সম্পর্ক এলাকায় বেশ আলোচনার সৃষ্টি করেছে।
স্থানীয় অধিবাসী কালাম ও জাফর জানান, পাখিদের সঙ্গে দুলালের ওই সম্পর্ক না দেখলে বিশ্বাস হবে না। তার এমন কাজে আমরাও খুঁশি। আমারাও এখন অনুভব করি পাখির প্রতি ভালোবাসা।
তরুণ আল আমিন জানান, ওই দৃশ্য দেখতে খুবই ভালো লাগে। মাঝে মাঝেই বন্ধুদের সাথে ওই দৃশ্য দেখতে আসি।
এ ব্যাপারে সিংড়ার পরিবেশ ও প্রকৃতি আন্দোলনের সভাপতি মোল্লা মো. এমরান আলী রানা বলেন, দুলাল হোসেন একজন বৃদ্ধ মানুষ হিসেবে পাখির প্রতি যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন তা অনন্য। পরিবেশ ও প্রকৃতি বাঁচাতে তিনি এগিয়ে এসেছেন। পাখিসহ সকল জীববৈচিত্র রক্ষায় সবার এগিয়ে আসা দরকার। আমাদের উচিত জীবের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতা দেখানো। পাখিদের খাওয়ানোর মাঝে আনন্দ পান ঝালমুড়ি বিক্রেতা দুলাল। তাকে দেখে সমাজের অনেক ব্যক্তি পাখিসহ জীববৈচিত্র রক্ষায় এগিয়ে আসবে বলে আশা করেন তিনি।
এসআইএইচ