মাগুরার মডেল কৃষক প্রতিবন্ধী আক্কাস
জন্মের পর থেকেই আক্কাসের দুটি পা শুকনো। জন্মগত পঙ্গু হওয়ার ফলে শিশু কাল থেকে আক্কাস হাটতে পারেনি। অন্য মানুষের মতো স্বাভাবিক হাটা-চলা করতে না পারায় বিছানাতেই থাকতে হয়েছে তাকে। তবে থেমে যাননি। কাঠের লাঠি ভর করে স্কুলে যান আক্কাস। তার সহপাঠী ও স্কুলের শিক্ষকরা তাকে অনুপ্রেরণা দেয়। এভাবেই তিনি স্কুল জীবনে এসএসসি পরীক্ষা দেন এবং সাফল্যের সঙ্গে পাশ করেন। এর পাশপাশি তার দুটি পায়ের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের বেশ কিছু চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। কিন্তু চিকিৎসকরা সর্বশেষ তাকে জানিয়ে দেয় তার পা দুটি আর ভালো হবে না। তবুও দৃঢ় মনোবল ও মনের তীব্র ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তিনি এখন তার গ্রামের মডেল কৃষক।
মাগুরা সদরের আঠারো ইউনিয়নের নালিয়ার ডাঙ্গা গ্রামে কৃষক আক্কাসের বাড়ি। আক্কাসের মা আলেয়া খাতুন জানান, জন্মগতভাবে আক্কাসের দুটি পা শুকনো। শিশুকাল থেকে তাকে মানুষ করতে আমাদের অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। চিকিৎসকরা বলেছেন-এটা পোলিও রোগ। কোনও ভাবে তার পা দুটো ভালো হবে না। তারপরও আমরা ভারতেও তাকে দেখিয়েছি কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকরা বলেছেন-এটা আর ঠিক হবে না। তাই ছেলের নিজের চেষ্টা ও পরিশ্রমের ফলে আজ সে এলাকার একজন প্ররিশ্রমী কৃষক । অন্যের কাছে হাত না পেতে সে নিজের চেষ্টায় বড় হয়েছে। লাঠি ভর দিয়ে সে মাঠে যায় । কাজ করে ফসল ফলায়, তারপর বিক্রি করে। এই অবস্থার মধ্যে থেকেই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। তার সংসারে দুটো সন্তান । তাদের মুখের দিক তাকিয়ে সে কাজ করে।
সরেজমিনে সদরের নালিয়ার ডাঙ্গা গ্রামে গিয়ে কথা হয় আক্কাসের সঙ্গে। সাহসী ও পরিশ্রমী এই কৃষক বলেন, চিকিৎসকরা যখন বলল পা দুটো আর ভালো হবে না তখন মনোবল পুরোপুরো হারিয়ে ফেলি। পরে পরিবারের সদস্য, বন্ধু ও প্রতিবেশীরা আমাকে নানাভাবে মনোবল দিতে থাকে। স্কুল জীবন থেকে কলেজ জীবনে যাই কিন্তু কলেজ জীবন শেষ করতে পারিনি। এক সময় এক কৃষি কর্মকর্তা আমাকে পরামর্শ দেন তুমি আইপএম কৃষি প্রশিক্ষণ করে কৃষি কাজে মনোযোগ দাও তাহলে ভালো করবা। তার পরামর্শে আমি আইপিএম কৃষি প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করি। এরপর ২০১৮ সালে প্রতিবন্ধী ভাতার ৮ হাজার টাকা দিয়ে নিজের সামান্য কিছু জমিতে শুরু করি মিষ্টি কুমড়ো চাষ।
আক্কাস বলেন, মাত্র ২৮০০ টাকা খরচ করে আমি সেই বছর কুমড়ো বিক্রি করি ৪০ হাজার টাকার। বর্তমানে আমি নিজের জমি ছাড়াও অন্যের জমি বর্গা নিয়ে প্রায় ৪০ শতক চাষ করি। প্রতি বছর একই জমিতে আমি ৪ ধরনের ফসল চাষ করি। প্রথমে পাট আবাদ করি। পাট কেটে সেই জমি চাষ দিয়ে লাগাই মিষ্টি কুমড়ো। মিষ্টি কুমড়ো উঠে গেলে জমি প্রস্তুত করে সেখানে খিরা লাগাই। সর্বশেষ জমিতে রোপন করি পেয়াজ। এভাবে আমি নিজে প্ররিশ্রম করে সাফল্য অর্জন করেছি।
তিনি আরও বলেন, চাষবাদে জেলার কৃষি কর্মকর্তারা আমাকে নানা ভাবে সহযোগিতা করছেন। আমি কৃষি বিভাগ থেকে বিনামূল্যে বিভিন্ন মৌসুমী ফসলের বীজ ও সার পাই। কোন ফসল কিভাবে চাষ করতে হয় তার পরামর্শ দেওয়ার জন্য আমি বিভিন্ন সময় কৃষি অফিসে যাই। তারা আমাকে পরামর্শ প্রদান করে থাকেন।
এ ছাড়াও করোনাকালীন সময়ে কালিজিরা চাষ করে সাফল্য অর্জন করেছেন বলে জানান কৃষক আক্কাস। তিনি বলেন, কারণ করোনার সময়ে মানুষ কালিজিরা বেশি ব্যবহার করত। সেই সময় আমি আমাদের গ্রামে প্রথম এ চাষ শুরু করি। আমার দেখাদেখি এলাকার অনেক কৃষক সেই সময় এ চাষ করে। আমার চাষের কাজে কোনও শ্রমিক নেই। নিজেই প্ররিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করি। নিজেই মাড়াই করি। নিজেই তা বিক্রি করি। আমার পরিবারের লোকজন আমাকে সহযোগিতা করে এ কাজে। বর্তমানে আমি ৩ একর জমির চাষ করি। এখানে চাষ হয় পাট, ধান, মিষ্টি কুমড়ো, খিরা, বেগুন, ধনিয়া ও মসলা জাতীয় ফসল।
কথা প্রসঙ্গে আক্কাস আরো বলেন, আমি প্রতিবন্ধী হয়েও কোনও কাজ ছোট মনে করি না। নিজের মনোবল ঠিক রেখে প্ররিশ্রম করে যাচ্ছি। আমার কাজ দেখে এলাকার কৃষক আমাকে উৎসাহ প্রদান করে। তাদের ভালোবাসা নিয়েই বেঁচে থাকা। আমি আইপিএম এর সেরা কৃষক, মসলা চাষে সেরা কৃষক ও মাগুরার মডেল কৃষকের পুরস্কার অর্জন করি কৃষি বিভাগ থেকে। বর্তমানে আমি জাতীয় পর্যায়ে সেরা কৃষক ও চ্যানেল আই সেরা কৃষকের পুরস্কার পাওয়ার জন্য আবেদন করেছি।
এ ব্যাপারে মাগুরা সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. হুমায়ন কবির বলেন, আক্কাস প্রতিবন্ধী হলেও কৃষি কাজ করে বিভিন্ন মসলা ও মৌসুমী ফসল চাষ করে এলাকায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমাদের কৃষি বিভাগ থেকে আক্কাসকে সব সময় সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আক্কাস মাগুরা জেলার একজন মডেল কৃষক। তার সাফল্য দেখে জেলার অনেক কৃষক এখন উদ্ধুদ্ধ হচ্ছে কৃষিকাজ করতে। কোনও কাজই আসলে ছোট নয় আক্কাস তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ভবিষ্যতে কৃষি বিভাগ থেকে আক্কাসকে সর্বাত্বক সহযোগিতা করা হবে।
এসআইএইচ