সংস্কারের অভাবে ধ্বংসের মুখে সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটা
জমিদারি নেই, নেই জমিদারের কোনো বংশধর। শুধু আছে একটি অবশিষ্ট পুরোনো স্মৃতিময় দালান। এটি হলো কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসুয়া গ্রামে অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটা। কটিয়াদি উপজেলা থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার ভেতরে মসূয়া বাজারের পাশেই এই ঐতিহাসিক বাড়িটির দেখা মিলবে।
বাড়িটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। বাড়িটির রাজকীয় জৌলুশ হারিয়ে গেলেও রয়ে গেছে শেষ স্মৃতিচিহ্ন। পুরোনো ইটের ভাঁজে ভাঁজে যেনো লুকিয়ে রয়েছে ইতিহাসের সব অলিখিত প্রমাণ।
এই বাড়িতেই জন্মেছেন প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ও সুকুমার রায় চৌধুরী। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হওয়ার অনেক আগেই সত্যজিতের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ও তার পিতা সুকুমার রায় সপরিবারে কলকাতায় চলে যান।
দুইতলা বিশিষ্ট বাড়িটির ছাদের দেয়াল আস্তে আস্তে খসে পড়ছে। ইটের ভাজে শ্যাঁওলার আস্তরণ, ছোট-বড় ঘাস আর বটবৃক্ষের আদলেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে ঐতিহাসিক এই বাড়ি। প্রাসাদের চারপাশে লতাপাতা আর বটবৃক্ষের আবর্তনে ঢাকা পড়েছে এর বাহ্যিক সৌন্দর্য। বাড়ির প্রতিটি ইটের পরতে গাঁথা জমিদারির ইতিহাস যেন ফিশ ফিশ করে জানান দেয় এখানে ভ্রমণ করতে আসা পর্যটকদের কানে।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
মসূয়া জমিদারবাড়ির জমিদার ছিলেন হরি কিশোর রায়। তার আদি বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ জেলায়। তৎকালীন জমিদারিতে অনেক প্রভাব থাকলেও নিঃসন্তান হওয়ায় তার মনে শান্তি ছিল না। পরে বড়ভাই কালীনাথ দেব ওরফে শ্যাম সুন্দর দেব ও জয়তারা দেবীর পুত্র কামদারঞ্জনকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন জমিদার হরি কিশোর রায়। জমিদারি প্রথা টিকিয়ে রাখতে দত্তক পুত্র কামদারঞ্জনের নাম পরিবর্তন করে নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে উপেন্দ্র কিশোর রায় রাখেন। পরে অবশ্য জমিদার হরি কিশোর রায়ের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। যার নাম রাখা হয় নরেন্দ্র কিশোর রায়। লেখাপড়ায় মনোযোগী উপেন্দ্র কিশোর রায়কে পড়ালেখায় স্বাবলম্বী করতে মময়মসিংহ জেলা স্কুলে ভর্তি করানো হয়। সেখানে হরি কিশোর রায়ের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। এখনো তার নিজ নামের একটি রাস্তা সে ইতিহাস বহন করে চলছে।
পালিত পুত্র উপেন্দ্র কিশোর রায়কে নিয়ে হরি কিশোর রায়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। তিনি চেয়েছিলেন পরবর্তীকালে জমিদারি তিনি সামলাবেন। কিন্তু পড়ালেখা, গানবাজনা ও ছবি আঁকায় মনোযোগী উপেন্দ্র কিশোর রায় ছিলেন পুরোই বিপরীত। তার ধ্যান-জ্ঞান ছিল শুধুই পড়ালেখা। তাই উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায় সতের বছর বয়সে ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। কলেজে অধ্যায়নকালেই জড়িয়ে পড়েন কলকাতার শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে। সেই সুবাদে আন্তরিকতা আর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে। এক সময় খ্যাতিমান সংস্কারমুক্ত মনের মানুষ ব্রাহ্মনন্দ কেশব চন্দ্র সেনের সান্নিধ্যে থেকে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন।
পরবর্তী বংশধর
১৮৮৩ সালে উপেন্দ্র কিশোর রায় ২১ বছর বয়সে বিএ পাস করার পর, দ্বারকানাথ ও প্রথম নারী গ্রাজুয়েট ডাক্তার কাদম্বিনীর একমাত্র কন্যা সন্তান বিধুমুখীকে বিয়ে করেন। ১৮৮৭ সালে এ দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন সুকুমার রায়। জন্মের পর থেকেই পিতার সব গুণাবলীই ছিল তার মধ্যে। ১৯১৩ সালের গোড়ার দিকে সুকুমার রায় ঢাকার খ্যাতনামা সমাজসেবক কালী নারায়ণ গুপ্তের কন্যা সুপ্রভাকে বিয়ে করেন। বৈবাহিক জীবনের আট বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯২১ সালে ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেন সত্যজিৎ রায়।
বর্তমানে জরাজীর্ণ বাড়িটির চারপাশে কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে বাড়ির চারপাশকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাড়িতে রয়েছে কারুকার্যখচিত প্রাচীন দালান, খেলার মাঠ, মূল ফটকে রয়েছে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, বাড়ির পেছনে আরেকটি ছোট পুকুরসহ রয়েছে একটি দরবার গৃহ। দরবার গৃহটি বর্তমানে মসূয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
জানা যায়, একটা সময় এই বাড়িকে 'পূর্ব বাংলার জোড়াসাঁকো' নামে ডাকা হতো। বাংলার ঐতিহ্য বহনকারী স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় রয়েছে। বাড়ির সামনেই মাঠের এক পাশে পর্যটকদের সুবিধার্থে নির্মাণ করা হয়েছে একটি দোতলা রেস্ট হাউস। ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১২ সালে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন কর্তৃক নির্মিত রেস্ট হাউসটি এখনো তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। দেশ-বিদেশ থেকে আসা পর্যটকদের জন্য রেস্ট হাউস শুধু নামেই তৈরি করা হয়েছে। এই বাড়িকে কেন্দ্র করে পর্যটন কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা নেওয়ার কথা থাকলেও কার্যক্রমে তেমন কোনো গতি নেই। তা ছাড়াও ঐতিহ্যের ধারক বাহক এই বাড়ি সংস্কারের কথা থাকলেও বাড়িটি এখনো সংস্কার হয়নি। প্রায় ৪ একরের এই বিশাল জমি ও বাড়ি বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব বিভাগের অধীনে রয়েছে।
এখানকার স্থানীয় সূত্র জানায়, সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ হরি কিশোর রায় চৌধুরী প্রায় ২০০ বছর আগে মসূয়া গ্রামে শ্রী শ্রী কাল ভৈরব পূজা উপলক্ষে একটি মেলার আয়োজন করেছিলেন। এখনো প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ বুধবার এই ঐতিহ্যবাহী মেলা হয়।
তাই অস্কার বিজয়ী সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটার শেষ স্মৃতিচিহ্ন এই বাড়ির সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন এখানকার স্থানীয় জনগণ।
এসএন