নীলাদ্রি লেক মন মাতায়
তাহিরপুরের নীলাদ্রি লেক, শহীদ সিরাজ লেকও। সেখান থেকে টাঙ্গুয়ার রামসার সাইটটি। মাঝে চুনাপাথরের ইতিহাসের গল্প। লিখেছেন ও ছবি তুলেছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক, ছাত্র ও আলোকচিত্রী রাজিবুল ইসলাম।
চিরহরিৎ বৃক্ষের সমারোহ, সুমিষ্ট আবহাওয়া, অসাধারণ রূপময় প্রকৃতি, খরস্রোতা পাহাড়ি নদী, লেক, অপরূপ পরিবেশে গড়ে উঠেছে ‘ভূস্বর্গ কাশ্মীর’। তার সৌন্দর্য্য দেখতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ছুটে আসেন। এমন একটি ভূস্বর্গ কিন্তু বাংলাদেশেও আছে। ‘বাংলার কাশ্মীর’ খ্যাত ‘নীলাদ্রি’র কথা বলছি।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টেকেরঘাটে মেঘালয় সীমান্তের উল্টোদিকে আমাদের নীলাদ্রি লেক। আসল নাম ‘শহীদ সিরাজ লেক’। পাশের মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন একাত্তরে শহীদ এই বীর মুক্তিযুদ্ধা। তার নামেই এখন নাম রাখা হয়েছে ‘শহীদ সিরাজ লেক’। বেশিরভাগ লোকের চেনা নীলাদ্রি লেক নামে।
‘নীলাদ্রি লেক’ মূলত পরিত্যক্ত একটি লাইমস্টোন বা চুনাপাথরের লেক। নীল স্বচ্ছ জলের চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যের দৌলতে ‘নীলাদ্রি লেক’ নামে খ্যাত। নীলাদ্রি লেকের আশপাশে আছে অনেকগুলো পাথুরে টিলা ও পাহাড়ের সমারোহ। তাদের একপাশে নীল জলের স্বচ্ছ লেকটি। আবার স্বচ্ছ জলের বুকে ভেসে থাকতে দেখা যায় ছোট, ছোট ঢিলাগুলো। লেকের তীরে দাঁড়িয়ে চোখে পড়ে অদূরের ভারত সীমান্তে ও সুউচ্চ সুবিশাল সবুজ পাহাড়রাজি। স্বর্গীয় সৌন্দর্য্যরে দারুণ সুষমা। সেখান থেকেও ভেসে আসে পাহাড়ের গায়ে জন্মানো গাছের পাতায় হাওয়ার মিতালিময় সুর ও সঙ্গীত। পাহাড়-টিলা ও লেকের স্বচ্ছ জলের প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রাণে বয়ে আনে সবসময় অনাবিল শান্তি।
ইতিহাসের গল্প-সিমেন্টের চাহিদা পূরণ করতে ১৯৪০ সালে সুরমা নদীর তীরে ছাতকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। আমাদের কাছে ‘ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি’। ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে চুনাপাথর সংগ্রহ করে আগের আমলে কারখানার সিমেন্ট কাঁচামালের চাহিদাটি মেটানো হতো। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে নানা সমস্যা ও ব্যয় বাড়ায় এবং পাসপোটের ঘেরাটোপে ভারত থেকে চুনাপাথর সংগ্রহ বন্ধ হয়ে গেল। ফলে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি চালু রাখতে নিজস্ব ব্যবস্থায় চুনাপাথর উত্তোলন শুরু করতে হলো। এজন্য ১৯৬১ সালে ভূতাত্বিক জরিপ সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের ভাঙ্গারঘাট ও সীমান্তের কাছে টেকেরঘাটের ৫টি চুনাপাথরের কূপে চালানো হয়। মোট ১৩ কোটি ২৫ লাখ ৫৬ হাজার ৫ শ ৩৪ মেট্রিক টন চুনাপাথর মজুদ আছে বলে নিশ্চিত হন বিসিআইসি। ১৯৬৫-৬৬ সালে টেকেরঘাট খনিজ প্রকল্পে ৩ শ ২৭ একরে চুনাপাথর খনিজ পদাথ আছে বলে জানান তারা। ৭০ দশমিক ৬৯ একর ও ৯২ দশমিক ২৫ একর এলাকায় মোট ২টি খনি আছে। তবে সেই থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মোটে ১৬ লাখ ৬৩ হাজার ৭শত ৮৩ মেট্রিক টন চুনাপাথর উত্তোলন করা গিয়েছে। অভিযোগ, বিসিআইসির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক সংগঠনের কিছু লোকের কারণে লাভের প্রকল্পটি হঠাৎ লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিও বিসিআইসির অধীনে চলে গেল। এরপর ১৯৯৬ সালের দিকে খনিজ প্রকল্পটিকে বন্ধ করে দেওয়া হলো। প্রায় ৪ শ শ্রমিক-কর্মচারীকে বিসিআইসির অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে বদলি করা হলো।
দীর্ঘদিন ধরে খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে কারখানার যন্ত্রপাতি। অযত্ন, অবহেলায় এভাবে নষ্ট হচ্ছে ৬০ কোটির বেশি টাকার যন্ত্র। বেশিরভাগ এখন অকেজো হয়ে গেছে। চুরিও হয়েছে ২০ কেটি টাকার মূল্যবান যন্ত্রাংশ।
এই তাহিরপুর সীমান্তে দৃষ্টিনন্দন পাথর কোয়ারিটি। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না। পর্যটকদের কাছে অধরাই ছিল লেকের সৌন্দর্য। তারপর হঠাৎ ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে শহীদ সিরাজ লেক। ততদিনে লেকের চেহারা ফিরেছে। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন লেকের আশপাশে পর্যটকদের জন্য ৪৬ লাখ ৯৭ হাজার ৫৯৩ টাকায় নৌকা ঘাট, শৌচাগার, ৫টি বিশ্রাম ছাতা, সীমানা, বেঞ্চ, গোলঘর, রাত্রি যাপন কেন্দ্রসহ থাকা-খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা করছেন। অনেক কাজ সম্পন্ন।
তাহিরপুর থেকে ইঞ্জিনের ছোট, বড় নৌকায় ‘পাটলাই নদী’তে পৌঁছানো যায়। সেখান থেকে নদী পথে ‘বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট’ ভুবনবিখ্যাত টাঙ্গুয়ার হওর। অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখতে, দেখতে অসাধারণ জলমগ্ন ভুবনে ডুবে যেতে পারেন। পাটলাই নদীর দুই ধারে আছে করচ গাছ। পর্যটকদের দৃষ্টি ও হৃদয় কাড়ে। নৌকায় বসেও ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের ডাক কানে আসে।
হাওড় টাঙ্গুয়ায় ঢুকলেই তো চোখে পড়ে বিশাল ওয়াচ টাওয়ার, নিচেই সুবিশাল চির সবুজের বেষ্টনী। সারি, সারি হিজল, করচ গাছ, নলখাগড়া হাওরের বুক মায়ের স্নেহে আগলে রেখেছে। টাঙ্গুয়ায় শীত মৌসুমে সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া, নেপাল, ভুটান, ভারতসহ নানা দেশের হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসা বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত আঙিনা।
ওএফএস।