‘সাক্ষর জাতি এগিয়ে থাকে সময়ের চেয়ে’
‘৮ সেপ্টেম্বর’, ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস’। দিবসটি সারা বিশ্বের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলো যেমন-ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক যোগাযোগ সাক্ষরতা নিশ্চিতে বাংলাদেশের জন্য দিবসটি অনন্য।
সাক্ষরতা দিবসের ইতিহাস জানা জরুরি। সারা বিশ্বে ইউনেস্কোর নেতৃত্বে ১৯৬৬ সাল থেকে দিবস আকারে পালিত হয়ে আসছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে পালিত হয়।
প্রতি বছরই ইউনেস্কো একটি থিম ঘোষণা দিয়ে থাকে। এ বছরের থিম, ‘সম্ভাবনা ও সুযোগ অন্বষেণ করে সাক্ষরতা অর্জনের স্থান পরিবর্তন’।
সময় বহমান। সেই বহতায় বদলাচ্ছে সময়। তৈরি করছে নানান সুযোগ ও সম্ভাবনা। কাজে লাগিয়ে সাক্ষরতা অর্জনের পদ্ধতিগুলো পরিবর্তন করা সময়ের দাবি। পরিবর্তনের আগে জানতে হবে সাক্ষরতা বলতে কি বোঝায়? সাক্ষরতা বলতে সাধারণত অক্ষরজ্ঞান সম্পন্নতা বোঝায়।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিসরে সাক্ষরতা শব্দের প্রথম উল্লেখ দেখা যায়, ১৯০১ সালে লোক গণনার অফিসিয়াল ডকুমেন্টে। ষাটের দশকে সাক্ষরতা বলতে অক্ষর জ্ঞান সম্পন্নতার পাশাপাশি হিসাব-নিকাশের যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ পরিগণিত হয়েছিলেন।
আশির দশকে লেখাপড়া, হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি সচেতনতা ও দৃশ্যমান সামগ্রী পঠনের ক্ষমতা সাক্ষরতা দক্ষতা হিসেবে ধরা হয়েছিল।
সময়ের সাথে সাক্ষরতার সংজ্ঞা পরিবর্তন না হয়ে সংযোজিত হয়েছে নানান শব্দ। দিন, দিন বৃদ্ধি পেয়েছে পরিধি।
১৯৯৩ সালে ইউনেস্কো একে পুণ:সংজ্ঞায়িত করে। শুধু অক্ষর জ্ঞান সম্পন্নতাই সাক্ষরতা বলা হয় না। এর সঙ্গে জীবনধারণ, যোগাযোগ দক্ষতা ও ক্ষমতায়নের দক্ষতা যুক্ত হয়েছে।
বর্তমানের সংজ্ঞায় সাক্ষরতার সঙ্গে যোগাযোগ দক্ষতা, ক্ষমতায়নের দক্ষতা, জীবন নির্বাহী দক্ষতা, প্রতিরক্ষা দক্ষতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা সংযোজিত।
বৃহত্তর পরিসরে বলা যায়, স্বাভাবিকভাবে জীবন ধারণের জন্য ধর্মে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, সামাজিক যোগাযোগে, আচরণে ও কর্মে মানুষের নির্দেশক হলো সাক্ষরতা।
৭৭১ মিলিয়ন নিরক্ষর মানুষ পৃথিবীতে রয়েছে। করোনার পর সারা বিশ্বে প্রায় ২৪ মিলিয়ন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ফিরেনি। তাদের ১১ মিলিয়ন নারী। বাংলাদেশেও এই চিত্র ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার ৭৫%’র বেশি ( সূত্র-বিবিএস)। শতভাগ সাক্ষরতার নিশ্চিত করার যে প্রচেষ্টা ছিল করোনার ঢেউ এসে তা স্থবির করে দিয়েছে।
করোনার পর বিশ্ব নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য হয়েছে। করোনার ধাক্কার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পুনরায় ভাবতে হচ্ছে বিশ্বকে। আগামীর প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় থাকতে হচ্ছে চৌকসভাবে। সময়ের সাথে তৈরি হচ্ছে সুযোগ আর অমিত সম্ভাবনা। তাই প্রতিটি সম্ভাবনা এবং সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন করা দরকার।
সাক্ষরতা অর্জনে শেখানোর পদ্ধতিগুলো পরিবর্তন করতে হবে।
সাক্ষরতা দক্ষতা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের ভাবনায় যে বিষয়গুলো রাখা যেতে পারে সেগুলো হলো-গতানুগতিক শেখানো প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সাক্ষরতা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাক্ষরতা দক্ষতাগুলো কাজে লাগানো ও শেখানো। ধর্ম পালন করার সময় আচরণীয় বিষয়গুলো কী, কী হবে জানানো। নিজের ধর্ম পালনের মাধ্যমে অন্যের ধর্মের আঘাত যেন না আসে, তা জানাই হলো ধর্মীয় সাক্ষরতা।
যোগাযোগ মাধ্যম চালানোর ক্ষেত্রে ডিজিটাল সাক্ষরতা সম্পর্কে সস্পষ্টভাবে জানানো প্রয়োজন। কোন, কোন বিষয়গুলো পাবলিক করা যাবে তা জানা, ছবি, কন্টেন্ট সম্পর্কে মানসম্মত ধারণা ডিজিটাল সাক্ষরতা।
অর্থনীতিতে হিসাব নিকেশের পাশাপাশি দেশের সামগ্রীক চাহিদার কথা বিবেচনা করে সম্পদ ব্যবহারে ব্যক্তিগত কৃচ্ছতা শেখানো। নাগরিক হিসেবে সারা জীবনব্যাপী পরিবর্তনের সাথে মিলিয়ে সমস্যা সমাধান করে সামনে যাওয়ার প্রক্রিয়াগুলো আয়ত্ত করানো। তবে শেখাতে গিয়ে অবশ্যই সবার কথা বিবেচনা করা এবং বিভিন্ন শ্রেনীর মানুষের কথা বিবেচনা করতে হবে। প্রতিটি মানুষের শেখার ধরন আলাদা, বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
সাক্ষরতা অর্জনে সবাইকে সুযোগ তৈরি করে দেওয়া প্রয়োজন।
সাক্ষরতা অর্জনের পদ্ধতিগুলো মানসম্মত ও ন্যায়সঙ্গত হতে হবে।
ডিজিটাল সাক্ষরতার ব্যপ্তি বাড়াতে হবে। ডিজিটাল যন্ত্রের ব্যবহার, ডিজিটাল যন্ত্রের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করার ক্ষেত্রে কার্যকর নীতি ব্যবস্থা করা ও সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
ডিজিটাল সাক্ষরতার সুযোগের বাইরে ও থাকা মানুষগুলোকে আগামীর কথা বিবেচনা করে ডিজিটাল সাক্ষরতা অর্জনে উৎসাহিত করতে হবে।
সাক্ষরতা নিয়ে কাজ করতে গেলে, মনে রাখতে হবে আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করার কথা। সাক্ষরতা দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে নিজেকে উন্মুক্ত রাখতে হবে। যেকোন পরিবর্তনের সাথে জানতে হবে, শিখতে হবে, মানতে হবে। ধর্ম, রাজনীতি বা সমাজের দোহাই দিয়ে পিছে থাকা যাবে না। যেখানে যে সুযোগ ও সম্ভাবনা পাওয়া যাবে, তাই কুড়িয়ে নিয়ে কাজে লাগাতে হবে। মনে রাখতে হবে সেই দোলনা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শিখতে হবে, জানতে হবে। শিক্ষার কোন বয়স নেই, বিকল্পও নেই।
একটি জাতিকে যেকোন সমস্যা মোকাবেলা করতে হলে তাদের সুযোগ ও সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে হয়। সেই সুযোগ ও সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে সফলতা অর্জন করে থাকেন তারা। সফলতাগুলো সাসটেনবল করে রাখতে সকলের সাক্ষরতা দক্ষতার প্রয়োজন অপরিহায। একটি সাক্ষর জাতি এগিয়ে থাকে সময়ের চেয়েও। মননে, মানে ও গুনে বাংলাদেশের সবার সাক্ষরতা অর্জন হোক প্রত্যাশা।
সাইফুল ইসলাম তালুকদার (রনি), জনসংযোগ কর্মকর্তা, আইইবি।
সাবেক ছাত্র, আইইআর, ঢাবি।
ওএফএস।