আমাদের বুয়েট
লেখা : প্রকৌশলী রনক আহসান, সিএসই (কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং), ব্যাচ-২০০৪, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। সম্মানি সহ-সাধারণ সম্পাদক, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ(আইইবি)।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)’র ছাত্র, ছাত্রীদের এখন কেউ অধ্যাপক। আমরা ছাত্র, ছাত্রীদের মধ্যে কেউ মধ্যম মানের, কেউ ফাঁকিবাজ, আমার মতো কেউ ব্যাপক ফাঁকিবাজ। কেউ ২ থেকে ৪টা ভালোবাসার চেষ্টা একত্রে করেছেন, কেউ এক প্রেমেই লাইফ পার। কেউ গেমার, কেউ বিতার্কিক, কেউ বুয়েট ফিল্ম সোসাইটি, ড্যান্স ক্লাব, মূর্ছনা, এনভায়রনমেন্টাল ওয়াচ বা সত্যেন বোস বিজ্ঞান ক্লাবের মেম্বার। কেউ ১-২টা টিউশনি, কেউ কয়েকটি, কোচিং চালান আবার কেউ স্টার্ট-আপ করেন। বিদেশে ভ্লাদিমির পুতিনের সমর্থক, বাইডেন, কারো আমার মতো ট্রাম্প। ব্যক্তিজীবনে তাবলীগ করেন, খেলাধুলায় ইন্টারেস্ট, গান-বাজনা, সুফিবাদে, পীরভক্ত, পূজা-অর্চনা করেন। রোটারি ক্লাবে, স্কাউটিং, বাঁধনের কর্মী, পরিবেশবাদী, সংগঠক, পেশাজীবী, পেশাভিত্তিক সংগঠক এখন। বুয়েট গ্রাজুয়েট ক্লাব বা আইইবিতে ইনভলভ। বুয়েট অ্যালামনাইতে অ্যাক্টিভ। আমাদের ছেলেমেয়েদের কোনো কোনোজনের গবেষক, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ঝোঁক। কারো লেখক, বিখ্যাত গায়ক হওয়ার চেষ্টা আছে। বুয়েটিয়ান নামের আমরা ভার্সেটাইল কোয়ালিটির। প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ফিল্ডে সেরাদের একজন হওয়ার মতো প্রতিভা আছে। এই বুয়েটের সৌন্দর্য্য ও বৈশিষ্ট্য।
বুয়েটিয়ানদের মধ্যে ক্যাম্পাসে রাজনীতি করেছেন, সংখ্যাটি টোটাল ১০% হবে। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্রফ্রন্ট, হয়তো শিবির করেছেন। আমরা যারা একসময় বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি করেছি, আমরা কিন্তু বুয়েট কমিউনিটিরই অংশ। ছাত্র ইউনিয়নের অনেক সাবেক নেতৃবৃন্দ যেমন হাসানুল হক ইনু; তাদের গর্বের সঙ্গে বলতে শুনেছি, একসময় ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন। রাজনৈতিক কর্মীদের জীবন এমন। যারা মন থেকে দলীয় নীতি ও আদর্শে বিশ্বাস করেন, তারাও পলিটিক্যাল আইডিওলজি নিয়ে গর্ব করেন। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো মতই অন্যদের সঙ্গে নিজের আইডিওলজি নিয়ে ডিবেট করেন।
অনেকেই মনে করেন বুয়েটে যারা ছাত্ররাজনীতি করেছেন, তারা ভাদাইম্যা, দেশে তাদের কোন অবদান নেই। আপনারা কী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপ-কমিটির সম্পাদক আবদুস সবুর সাহেবকে জানেন? বিএনপির অন্যতম পলিসি মেকার ও আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে চেনেন? হাসানুল হক ইনু, জি.এম. কাদের বা খন্দকার মোশাররফ হোসেনের কে জানেন? মুফতি কাসেদ, শাফি ইমাম রুমী বা কুড়িগ্রামের রৌমারী মুক্তাঞ্চলের পাকবাহিনীর ত্রাস নুরুন্নবী চৌধুরী, বীরবিক্রম’কে চিনেন? ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয়য় প্রেসিডেন্ট যে একজন বুয়েটিয়ান জানেন? তারা যেসব পদ অলংকৃত করেছেন, যেসব দায়িত্ব পালন করেছেন সেগুলো কী বুয়েটের ছাত্র, ছাত্রী হিসেবে আপনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না? না জেনেও যদি নিজেকে রাজনীতি সচেতন দাবী করেন, তাহলে বলব, এখনো রাজনীতি সচেতন হতে পারেননি। আসলে নিজেই একজন ভাদাইম্যা।
আমরা যারা বুয়েটের সাবেক ছাত্র ও একসময় বুয়েট ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম, আমাদের সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম ‘বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক কর্মীবৃন্দ’। 'সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী' আমার আইডেন্টিটির অংশ। আরো অনেকের মতো সবসময় গর্বের সঙ্গে বলি, আমি বুয়েট ছাত্রলীগের একজন কর্মী ছিলাম। ছাত্রলীগকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে এখানে আমাদের আরেকটি জীবন, জগত ও স্বপ্ন।
বিগত একযুগে বুয়েট ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীদের জন্য ক্যাম্পাসে ‘ছাত্রলীগ’ ঘৃণা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এই ছাত্রলীগের একমাত্র পরিচয় নয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বুয়েটে যারা কর্মী ছিলেন, যারা চিন্তা করেননি, আওয়ামী লীগ কখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবে, বলতে পারেন তারা কোন স্বার্থে লীগ করতেন? তারা হলেন সেই জেনারেশন, যাদের কাছে 'ছাত্রলীগ' আবেগ ও ভালোবাসা, যাদের কাছে ‘বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী’ গৌরবাজ্জ্বল আরেক আত্ম-পরিচয়।
‘বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক নেতৃবৃন্দ’ জানেন, জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বুয়েটে একসঙ্গে বসলেই দলীয় লেজুড়বৃত্তিক প্রগ্রাম হয়ে যায় না। আমরা সাবেক নেতৃবৃন্দ এই বুয়েটেরই প্রাক্তন ছাত্র। আওয়ামী লীগ বা কোনো সহ-সংগঠনের প্রগ্রাম করতে আসিনি। আমাদের ক্যাম্পাসে স্বপরিচয়ে আসার অধিকার আমারও আছে। বুয়েটে বাঁধনকর্মী বা কোন ব্যাচ প্রাক্তনী, তাবলিগ কর্মী বা অন্য কোন পরিচয়ে বুয়েটে আসতে চান, আসেন; আমি আমার বুয়েটে ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী পরিচয়েও আসতে প্রেফার করি। এই পরিচয় শুধু একই মতাদর্শের সাবেক কর্মীদের একত্রে গেট টুগেদার।
রানিং ভাই-বোনদের কেউ যদি বলতে পারেন, আমরা কেউ আপনাদের ছাত্রলীগ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছি, তাহলে আমাদের অপরাধী করবেন। এই ধরনের একটি উদাহরণ দেখাতে পারবেন? ১৩ আগস্টের জাতীয় শোক দিবসের আগে এই উপলক্ষে দোয়া অনুষ্ঠানে বুয়েটের বর্তমান কোনো ছাত্র, ছাত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বুয়েটিয়ান ছাড়া অন্য কেউ সেখানে উপস্থিতও ছিলেন না। সেখানে উনসত্তরের গনঅভ্যুত্থানে সক্রিয় আমাদের ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সাবেক নেতৃবৃন্দসহ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, নানা সময়ের নেতাকর্মী প্রত্যেকেই পেশাজীবনে সফল। স্মৃতিচারণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো, গর্বে বলেছেন বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, বুয়েটে যৌবনের সোনাঝরা দিনগুলো।
যারা মনে করছেন, সাবেক ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের ১৩ আগস্টের প্রগ্রামটি বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে, তারা ভুল বুঝছেন। কোনো রানিং স্টুডেন্টকে আমরা কখনো বলিনি অ্যাটেন্ড করতে। পড়ালেখা করতে বলেছি। শহীদ আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটে অ্যলামনাইদের প্রতিবাদ, কর্মসূচিগুলোতে আমরা বুয়েট ছাত্রলীগের অনেক সাবেক নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেছি। শ্রদ্ধেয় জে.আর.সি. স্যারের নেতৃত্বেও। আমরা সবসময় আবরার হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছি। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ সিদ্ধান্তের বিষয়ে বুয়েট কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ ছাত্র, ছাত্রীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছি। তবে যতদিন বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে, ততদিন আমরা কর্তৃপক্ষকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। তবে বর্তমান ছাত্র-ছাত্রী ভাইবোনদের অনুরোধ, সচেতন থাকতে। ‘ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ সংগঠন’-এ জাতীয় শ্লোগান কারা দেন? তাদের দেখা উচিত। অনুরোধ, সচেতন থাকতে যেন মৌলবাদ ও উগ্রবাদের আঁতুড়ঘর বুয়েট হয়।
আচ্ছা, যে সংগঠনটি করতে গিয়ে আরিফ রায়হান দীপ জীবন দিলেন, তাদের পক্ষ থেকে তার জন্য সামান্য দোয়া করতে মৃত্যুস্থানে বাবা, ভাইয়েরা যেতে পারবেন না? দীপের গেলবারের মৃত্যুবার্ষিকীতে বাবা বললেন, "আজকে এই দিনে আমি তোমাদের দেখে দীপকে কিছু সময়ের জন্য খুঁজে পেলাম। বেঁচে থাকলে এই বয়সে দেখতে কেমন হত, সে অনুভূতি পেলাম।’ তার কথা মিথ্যে হয়ে যাবে? ২০১৪ সাল থেকে এই বছর পর্যন্ত তার বাবা ছেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে সন্তানের স্মৃতিফলকে এসেছেন। এই অধিকার আপনারা কেড়ে নিতে চান?
আমরা দীপের স্মৃতিফলকে শ্রদ্ধা জানালে আপনাদের খারাপ লাগে, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট সাবেকুন নাহার সনির স্মৃতিফলকে শ্রদ্ধা জানালে ভালো লাগে? এ আপনাদের কেমন দ্বীচারিতা? উল্লেখ্য, সনি আপুর মৃত্যুবার্ষিকীতে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফন্টের ভাইবোনদের পাশে বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক কর্মীবৃন্দ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। আমিও সকালে বুয়েটে গিয়েছি, প্রগ্রাম শেষে আপুর পরিবার ও সনি মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনে ছিলাম সারাদিন। বিশ্বাস করি, আমার মতই সাবেক বুয়েটিয়ানদের রাজনৈতিক কর্মীর অধিকার আছে, স্বপরিচয়ে বুয়েটে বসা, সামাজিক ও জাতীয় প্রগ্রামে অংশগ্রহণের। ছাত্র শিবির ব্যতীত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তো দলীয় ব্যক্তি নন, তাকে নিয়ে বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক কর্মীবৃন্দের দোয়া অনুষ্ঠান মোটেও রাজনৈতিক বা দলীয় কাজ হতে পারে না। আর দিন শেষে পরিচয়- আমি একজন গর্বিত বুয়েটিয়ান। আমি ছাত্রলীগ, বুয়েট শাখার সাবেক গর্বিত কর্মী।
একটি হত্যাকাণ্ডের বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন আইনী বিষয় জড়িত থাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কার্যকর করতে ৩৫ বছর লেগেছে। এদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যাম্পাসভিত্তিক হত্যাকাণ্ডের কখনো কোনো বিচার হয়নি। সনি আপুর হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি, এমনকী ছাত্রলীগ কর্মী দীপ হত্যার সুষ্ঠু বিচার অধরা আছে কিন্তু আবরার হত্যার বিচার হচ্ছে। বুয়েটিয়ানরা স্বীকার করেন আর না করেন, সত্য এই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছ্বায় নিম্ন আদালতে আবরার হত্যার বিচার কাজ সর্বোচ্চ গতিতে সম্পন্ন হয়েছে। বিশ্বাস করি দ্রুততম সময়ে এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যকর করবেন প্রধানমন্ত্রী। আরো মনে করি, আবরারের ফ্যামিলির উচিত আপামর মানুষ, বুয়েটিয়ান কমিউনিটির প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীতে স্মরণসভা, দোয়া আয়োজনে বুয়েটের ছাত্র-ছাত্রী ভাইবোনদের ধন্যবাদ। আমরা বুয়েটিয়ানরা পরিবার। যেন বজায় রাখি। আমাদের একটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে জানলাম, আজকের ছাত্র, ছাত্রীদের কেউ ভয় পাচ্ছেন, পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে। বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক নেতৃবৃন্দরা সবাইকে আশ্বস্ত করছি, এমন কিছুই ঘটবে না। তার মানে এই নয়, বুয়েট ক্যাম্পাসে বাইরের কোনো, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হস্তক্ষেপ আমরা মেনে নেব। বুয়েট বুয়েটিয়ানদের আছে, ছিল, থাকবে। ক্যাম্পাসে বাঘের মত সাহস নিয়ে যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো কাটাব। দ্যাটস দি স্পিরিট।
ওএফএস।