অভিমানী অ্যান্টনি গনসালভেস
অ্যান্টনি গনসালভেস ভারতের গোয়া অঙ্গরাজ্যের মানুষ। ব্রিটিশ ভারতে, ১৯২৭ সালে জন্ম, ১২ জুন। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। অল্প বয়সেই সঙ্গীতশিল্পী বাবার শিক্ষাগুলো আত্মস্থ করেছেন। কিশোর কালে গেয়ান সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে এক হতে বম্বে চলে গিয়েছেন। নওশাদের দলেই এই আধো, আধো ভায়োলিন বাদকের যাত্রা। তার দলটির জন্ম ১৯৪৩ সালে। তারা কাজ করেছেন সব বিখ্যাত চরিত্র-অনিল বিশ্বাস, গুলাম হায়দার, সাইয়াম সুন্দর, শচীন দেব বর্মণ, তার ছেলে আর. ডি. বর্মণ ও পেয়ারে লাল।
১৯৫০’র দশকের মাঝামাঝিতে গোয়ার নিজস্ব, হারানো সঙ্গীত সম্পদ-সিম্ফনির সুধাকে হিন্দুস্তানী মেলোডি ও সিনেমার ছন্দগুলোর সঙ্গে এক করতে আবার নতুন জীবন শুরু করলেন অ্যান্টনি গনসালভেস। তিনি অত্যন্ত নামকরা ভায়োলিন বাদক ছিলেন। ১৯৫০ ও ১৯৬০’র দশকের ভারতের সবচেয়ে সেরা পরিচালকদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা আছে খ্রিস্টান এই সঙ্গীতবিদের। বি.আর. চোপরার ‘নয়া ধুর’, ‘ওয়াক্ত’, গুরু নওশাদের ‘দিল্লাগি’তে তার অধীনে কাজ করেছেন ও নিজের প্রতিভার ছাপ রেখেছেন। চেতন আনন্দের ‘হাকিকত’-এ কাজ করেছেন।`পয়সা’র জন্যও চিরকাল বেঁচে থাকবেন। তিনি ১৯৪৫ সালের ছবি ‘পেহিলি নজর’, ১৯৪৯ সালের ‘মহল’, ১৯৫০ সালের ‘দোলাক’-এই তিনটি ছবিতে মিউজিক অ্যারেঞ্জার হিসেবে কাজ করেছেন।
১৯৫৮ সালে অ্যান্টনি গনসালভেস ভারতে সিম্ফনি অর্কেস্টা দল গড়ে তোলেন। নাম ‘দি ইন্ডিয়ান সিম্ফনি অর্কেস্টা’। লতা মুঙ্গেশকার ও মান্না দের সলো অনুষ্ঠানগুলোর জন্য তিনি দলটি গড়েছিলেন। তারা তাদের একক শোতে কাজ করতেন। সেগুলো হয়েছে বম্বের ‘সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ’-এ।
১৯৬৫ সালে গনসালভেজ ভারতীয় সিনেমা শিল্প থেকে সরে গেলেন ও চলে গেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছিলেন নিউ ইয়র্কের ‘সিরাকিইজ ইউনির্ভাসিটি’তে। চার্চের প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত, ১৮৭০ সালের পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী একটি বেসরকারী, গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়। তবে ১৯২০ সাল থেকে অসাম্প্রদায়িক নীতিতে চলছে। সেখানে গিয়ে অ্যান্টনি হলেন একজন সদস্য ‘দি আমেরিকান সোসাইটি অব কম্পোজারস, পাবলিশারস অ্যান্ড অথরস’র।
শেষ জীবনে চলে এলেন মাতৃভূমি ভারতে। সেই যে গ্রাম, যেখানে জন্মেছিলেন, সেখানেই কৃতবিদ্য মানুষটি তার শেষ ঠিকানা নিলেন। একসময় পর্তুগিজদের দখলে থাকা গোয়ার গ্রামটির নাম ‘মাজোরদা’। ফের সঙ্গীত রচনা, সুর তৈরি, গান গাওয়া ও লেখার জীবন তার ভারতের মাটিতে। তবে ভারতের হিন্দি ছবিতে ফেরা হলো না অভিমানে। নিউমোনিয়ায় রোগে তার ফুসফুসে প্রদাহ হয়েছিল। নিম্ম রক্তচাপ ছিল। ১৮ জানুয়ারি ২০১২ সালে এই মহান সঙ্গীতবিদ চলে গেলেন।
বলিউডের প্রথম মিউজিক অ্যারেঞ্জার হলেন এই অ্যান্টনি গনজালভেস। শব্দটি সিনেমা ও গানের ভুবনের সবার জানা। তিনি একজন কিংবদন্তী মিউজিক অ্যারেঞ্জার (যারা নানা ধরণের শিল্পীকে একটি শিল্পকর্মের জন্য যোগাড় ও তাদের পরিচালনা করেন) ছিলেন। আগের দিনে, অ্যান্টনিদের সময়ে গানের লাইনগুলোকে ঘিরেই সঙ্গীত তৈরি করা হতো। গানটি যখন সঙ্গীত পরিচালক ও শিল্পী মিলে গাইতেন, যন্ত্রসঙ্গীতকাররা তাদের নৈপুণ্য প্রদর্শন করতেন। এভাবেই গানগুলো অক্ষয় হয়েছে। অ্যান্টনি গনসালভেসই প্রথম ‘স্টাফ নোটেশন’ প্রদান করেছেন বলিউডের গানের ভুবনকে। ফলে যন্ত্র সঙ্গীতশিল্পীরা তাদের কাছে যা চাওয়া হলো, ঠিক তাই দিতে পারতেন। তাতে হিন্দি সিনেমার গানের ভুবন চিরকালের জন্য বদলে গেল। আরো উন্নতির পথ ধরলো। তিনি গানের দুটি অন্তরার মাঝের সময়ে তার সঙ্গীত বোধকে ব্যবহার করে সুরকে বিস্তার করতে পারতেন দারুণভাবে। এই স্বীকৃতিও তাকে খ্যাতি দিয়েছে। মদন মোহন, এস.ডি বর্মণের মতো সঙ্গীত পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করে তাদের তৈরি করেছেন। এছাড়াও অনেক তরুণ শিল্পীকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন স্টাফ নোটেশন। ফলে তারা পূর্ণতা পেয়েছেন ভালোবাসার গানের ভুবনে।
অ্যান্টনি গনসালভেস বিবাহিত ছিলেন। তার স্ত্রী আগেই গত হয়েছেন। একমাত্র মেয়ে লক্ষ্মী গনসালভেস একজন পেশাদার চিত্রশিল্পী। তার বাবা মারা গিয়েছেন তার গোয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে। ২০১২ সালের ১৮ জুন। তখন তার বয়স ৮৪ বছর।
তবে এই মানুষটিকে পেয়ারে লাল গানের মাধ্যমে, ছবিতে চরিত্র হিসেবে নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত বম্বের শিল্পীদের ছোট একটি ভুবনের বাইরে আর কেউই চিনতেন না। তার নামটিও তেমন জানা ছিল না। তিনি ১৯৬০’র দশকেই কিশোরকালের ভালোবাসার এই ভুবন ছেড়ে চলে গেলেন।
যখন বলিউডের কিংবদন্তী সঙ্গীত পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারে লাল গীতিকার আনন্দ বক্সির সঙ্গে ‘অমর, আকবর, আন্টনি’ সিনেমার গানগুলো নিয়ে বসলেন, ‘মাই নেম ইজ অ্যান্টনি ফার্নান্দেজ’ গানটির সুর আবেদন তৈরি করতে পারছে না। এই নিয়ে কাজ করতে, করতে পেয়ারে লাল তার গুরু অ্যান্টনি গনসালভেসের নামে এই চরিত্রটির নাম রাখতে অনুরোধ করলেন। এভাবেই তার ভায়োলিন শিক্ষককে অমর করে রাখতে চাইলেন তিনি। সেখানে উপস্থিত সিনেমাটির পরিচালক মদন মোহন দেশাই সঙ্গে, সঙ্গে ভাবনাটি গ্রহণ করলেন। তিনিও জানতেন, অ্যান্টনি গনসালভেস আছেন, একজন কিংবদন্তী। একটি ছবিতে সত্যিকারের নামে থাকছেন তিনি। তার জীবন থাকছে সেলুলয়েডে চিরকালের মতো বলিউডের ভুবনে।
এরপর অমিতাভ বচ্চন ১৯৭৭ সালের হিট ছবি ‘অমর, আকবর, অ্যান্টনি’ ছবিতে তার চরিত্র করেছেন। তার নামে বিখ্যাত গানটি হলো অমিতাভের কন্ঠে ও পেয়ারে লালের সুরে, ‘মাই নেম ইজ অ্যান্টনি গনসালভেস’। ভারতের হিন্দি গানের ভুবনে অত্যন্ত বিখ্যাত ‘হেমোগ্লোবিন ইন দি অ্যাটমোসফেরিক প্রেশার ইন দি কান্ট্রি’তে গানের শুরু। চটুল ধারার, রসাত্নক, কিশোর কুমার গেয়েছেন। অমিতাভের অভিনয়েও চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। যেখানে পেয়ারে লাল তার ভায়োলিন শিক্ষক ও গুরুর প্রতি ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশে করেছেন।
‘কোনোদিনও বুড়ো হবে না গানটি’ বলেন বোদ্ধারা। গানের ও সিনেমার অন্যতম চরিত্র, অমিতাভ বচ্চনের রূপদান করা, অ্যান্টনি গনসালভেস সত্যিকারের উৎসাহমূলক চরিত্র। জীবনীধর্মী ছবিটি মশলা ধারার-ধর্মীয় সহনশীলতার দারুণ গল্প। পরিচালক মনমোহন দেশাই, লিখেছেন কাদের খান। প্রধান তিন অভিনেতা বিনোদ খান্না, ঋষি কাপুর ও অমিতাভ। তিনি অ্যান্টনির জীবনী অবলম্বনে খ্রিস্টান ছেলের চরিত্র করেছেন। তাদের বিপরীতে শাবানা আজমি, নিতু সিং (এখন ঋষির স্ত্রী) ও পারভীন ববি। তিন ভাইয়ের গল্প যাদের তিন ধরণের বিশ্বাস-হিন্দু, ইসলাম ও খ্রিস্টান। লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারে লাল দুজনে সঙ্গীত পরিচালক। গীতগুলো লিখেছেন আনন্দ বক্সি। ২৭ মে মুক্তি পাওয়া ছবিটি ২০২০ সাল পর্যন্ত ৪৬ মিলিয়ন রূপী আয় করেছে। বছরের সবচেয়ে বিক্রি হওয়া সিনেমা ছিল তখনই। সেবারের ২৫তম ফিল্ম ফেয়ারে ছবিটি সেরা অভিনেতা, সেরা সঙ্গীত পরিচালক ও সেরা এডিটিংয়ের পুরস্কার জয় করেছে।
অমিতাভ তার সেরা সময়ে সেরা নায়কদের ভীড়ে যাকে পর্দায় ফুটিয়েছেন, তিনি ভারতের অনেক বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীর শিক্ষাগুরু ছিলেন। এক আর. ডি. বর্মণের নামই তো যথেষ্ট। পেয়ারে লাল বলেছেন, ‘আমার ওস্তাদ অ্যান্টনি গনসালভেস রাগ প্রধান কম্পোজিশনে বিশ্বাস করতেন।’ তিনিই ওস্তাদের নামে অমিতাভের জন্য চরিত্রটির নাম রাখতে অনুরোধ করেছিলেন দেশাইকে। এরপর ঘরে, ঘরে নামটি ছড়িয়েছে। ফলে অ্যান্টনি গনসালভেস বেঁচে গিয়েছেন। অথচ বলিউডের লোকেরা বিশ্বাস করেন, কারো বলিউডের ক্লাসিক্ল্যাল মিউজিকের জ্ঞান থাকলেই তিনি এই নামটি শুনেছেন। যিনি গানের একটি রহস্য, একজন নায়ক ও ভুলে যাওয়া একটি চরিত্র। একটি আমোদ ও একজন অত্যন্ত সিরিয়াস মানুষ। একটি মিথ। মূলধারাতে এসেছেন তাদের ওই ছবিতে, সবার সামনে প্রথম। ইস্টারের দিনে পারভীন ববির মাধ্যমে প্রথম পর্দায়। সুপার-ডুপার হিট ‘অমর, আকবর, অ্যান্টনি’ পরে তামিল ভাষায় রিমেক হয়েছে। তেলেগুতে, মালায়ালামেও। পরের বছরই পাকিস্তান অনানুষ্ঠানিকভাবে তৈরি করেছে পাঞ্জাবি ভাষায়, একই নামে।
বলিউড এই অসাধারণ সঙ্গীত পরিচালক ও প্রবল হিট ছবিটিকে ভুলতে পারেনি। ২০০৮ সালে তার নামেই ‘মাই নেম ইজ অ্যান্টনি গনসালভেস’ তৈরি হলো। পরিচালক ঈশ্বর নিভাস। সেখানে অ্যান্টনির চরিত্র করেছেন সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তী। তবে ছবিটি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে নানা কারণে। এছাড়াও ‘অ্যান্টনি গনসালভেস’ নামে ‘রাজ কমিকস’ নামের একটি ভারতীয় কমিক বুক প্রকাশনা সংস্থা বই করেছে। সেখানে তার নায়ক চরিত্র। প্রতি রাতে নিজের গুহা থেকে বেরিয়ে পড়ে। যারা আত্মহত্যা করতে যায়, তাদের বাঁচায়। তাদের ভেতরের শয়তানকে হারিয়ে দেয়। দিনের বেলা সে একজন অসাধারণ ভায়োলিন বাদক।
তার জীবনের ওপর ৫৮ মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র বানানো হয়েছে ভারত সরকারের তরফে। ২০১০ সালের ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়া (আইএফএফআই)’-তে তাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য প্রদর্শন করা হয়েছে। ‘স্পেশাল জুরি বোড অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছে। পরে অসংখ্যবার, নানা জায়গাতে দেখানো হয়েছে।
তার নামটি আরো আছে গ্রেগরি ডি. বুথের বইতে। তিনি ভারত, জনপ্রিয় গানের ধারা ও গান শিল্প নিয়ে আগ্রহী। তার বিখ্যাত বই “বিহাইন্ড দি সার্টেন : মেকিং মিউজিক অব মুম্বাই’জ ফিল্ম স্টুডিওজ (পদার আড়ালে : মুম্বাইয়ের ফিল্ম স্টুডিওগুলোর গান তৈরি)”। এই বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘এই স্বল্প খ্যাতি লাভ করা মানুষটি, তিনি অনেকের শিক্ষক ছিলেন। তবে সবসময় পর্দার আড়ালে থাকতেন। তাকে সবার কাছে জনপ্রিয় ও পরিচিত করে দিলো, লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারে রালের কাজের অন্ধভক্তদের কাছেও চিনিয়ে দিলো প্রথমবারের মতো ওই গান ও ছবিটি।’
তিনি মারা যাওয়ার পর পেয়ারে লাল বলেছেন, ‘১৯৭৭ সালে ছবিতে যখন আমরা কাজ করেছি, আমাদের ছবির গানটি তার নামে অমিতাভ ও কিশোরকে দিয়ে বানিয়ে আমি তার প্রতি আমার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছি। তিনি আমার গুরু ও একজন সঙ্গীত সাধু। জীবনের শেষ তিনটি বছর ভালো ছিলেন না। আমি নিয়মিত দেখতে গিয়েছি। এই মানুষটির কাছে মোটে ১৪ বছর বয়সে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমার বাবা একজন সঙ্গীত শিল্পী হলেও আপনার কাছেই শিখতে চাই। ভারতীয় ও পাশ্চাত্যের সঙ্গীতযন্ত্রগুলো আমি তার কাছেই বাজাতে শিখেছি। অনেক বছর তার ছাত্র ছিলাম। আজীবনেরও বটে। কোনোদিনও কোনোকিছুর জন্য মানুষটি আমার কাছ থেকে একটি পয়সাও নেননি। তিনি আমাকে সন্তানের মতো, ছেলের আদরে মানুষ করেছেন। একজন সত্যিকারের শিল্পী ছিলেন। তিনি শিল্পীদের শিল্পী। সঙ্গীতের খ্যাতির জন্য কাজ করেছেন জীবনভর, নিজের জন্য নয়। যদিও ভারতের হিন্দি ছবির সব বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালকের সবচেয়ে বেশিজনের সঙ্গে তিনিই কাজ করেছেন। মিউজিক অ্যারেঞ্জার ছিলেন প্রায় ৪শ ছবিতে, ২শ গানে কাজ করেছেন অ্যান্টনি গনজালভেস ১৯৪৩ থেকে ১৯৬৫ সালের হিন্দি সিনেমার ক্যারিয়ারে। আমি তার কাছে অত্যন্ত ঋণী। আমাকে সারাজীবন গাইড করেছেন। আমি তার কাছে শিখতে পেরে সৌভাগ্যবান।’
ওএফএস।