কৃষক-জেলের জীবন, জীবিকার ৬২ বছর
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এই দেশের মানুষের ক্ষুধা, দারিদ্রতা ও খাবারের যোগানের কারিগর। ৬২ বছরে পা দিয়েছে। লিখেছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাকিবুল হাসান
বাংলাদেশের প্রধান ও প্রথম বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়। কৃষি, মৎস্য, কামার, কুমার জেলেদের বিশ্ববিদ্যালয়-‘বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’। পুরো এশিয়া মহাদেশ ও সারা বিশ্বের অন্যতম নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়টির আজ ৬২ বছর। সর্বশেষ স্বীকৃতি তারা পেয়েছেন নব প্রচলিত কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূণ ব্যক্তি বা এগ্রিকালচারালি ইম্পর্টেন্ট পারসন (এআইপি) সম্মাননা। লাভ করেছেন উপাচার্য ও নামী গবেষক অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান। তিনি বলেছেন, “কৃষি শিক্ষা, গবেষণা ও সস্প্রসারণ’-এর পথিকৃৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম ১৯৬১ সালের ১৮ আগষ্ট। এই দিনে বাংলাদেশের কৃষি শিক্ষক, গবেষক, কর্মকর্তাদের আমি আমাদের ভালোবাসা জানাই।”
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ও বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আজ শিক্ষকদের নিয়ে ভোরে দেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়েছেন প্রশাসন ভবনের সামনে। পায়রা উড়িয়েছেন শান্তির প্রতীক হিসেবে, সব শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন, বঙ্গবন্ধুর ম্যুারালে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। নিয়মিত কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের-গাছের চারা রোপণ করেছেন তারা, ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠনগুলোর মধ্যে গাছের চারা বিলিয়েছেন, গবেষণা জমিগুলোতে নানা ধরণের ফসলের বীজ বুনেছেন ও গবেষণা পুকুরগুলোতে ছেড়েছেন নানা গবেষণায় পাওয়া মাছের পোনা। সবখানেই তাদের অনস্বীকার্য অবদান।
এখন দেশের কৃষি, মৎস্য ও সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর মেরুদন্ড-বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট জায়গা ১২শ ৫০ একর। এখানেই আছে দেশের প্রধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো। যেমন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। ময়মনসিংহ শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে তারা, ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে। আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগেও এ দেশের সব কৃষি, মৎস্য খাতের ছাত্র, ছাত্রীরা এখানেই উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেছেন। এখনো ১১শর বেশি ছেলেমেয়ে তারা ভর্তি করেন। পুরো দেশে তাদের তৈরি ৫০ হাজার ছাত্র, ছাত্রী চাকরি করছেন। প্রতিটি সিটই অমূল্য।
কৃষি বিজ্ঞান ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে স্বয়ংসম্পূণ অনন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়। কৃষি, ভেটেরিনারি, পশুপালন, কৃষি অর্থনীতি, গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান, কৃষি প্রকৌশল, কৃষি প্রযুক্তি, মাৎস্যবিজ্ঞান কী পড়ানো হয় না? মোট ৪৩টি বিভাগ আছে। সেমিস্টার পদ্ধতিতে। ৯ হাজার ৮শ ১৮ জন ছাত্র, ছাত্রী প্রথম বর্ষ থেকে মাস্টার্সে পড়ছেন। তাদের জন্য আছেন দেশবরেণ্য মোট ৫শ ৬৬ জন অধ্যাপক। আছে ১৪টি হল।
এই দেশের কৃষি, গবেষণা, মৎস্য ভুবনে বহু বছর ধরে প্রধান ভূমিকা রেখে চলেছেন তারা। কৃষক ও জেলের জীবন, জীবিকা তারা। দেশের মানুষের ভাত, মাছের ব্যবস্থা করেন। গবেষণা ভুবনে তাদের সাফল্য অবিশ্বাস্য ও চমকপ্রদ। ‘জৈব সার’ তাদের আবিস্কার। দুই, একটি আবিস্কার করা ফসল হলো-বাউকুল, বাউধানগুলো, বাকৃবি সরিষা, নব জাতের সয়াবিনের বীজ, বাকৃবি আলু, বাকৃবি কচু।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হারিয়ে যাওয়া তারা বাইম, গুচি বাইম, বড় বাইম, কুঁচিয়া, গাঙ মাগুর, বাকৃবি কই, বাকৃবি বাটা মাছ’কে দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে উন্নত কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিতে দেশের ও দশের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।
কটি ফসল পদ্ধতির মধ্যে আছে-পুকুর, জমিতে মাছ ও সবজির সমন্বিত চাষ, বিদ্যুতহীন হিমাগার ব্যবস্থা।
দেশের খাদ্য অর্থনীতির প্রধান শক্তি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের আবিষ্কার ও ভূমিকা কোনোদিন শেষ হবে না।
কলা, আনারসের উন্নত জাত আবিস্কার, শুকনো মৌসুমে বোরো ধান চাষ পদ্ধতি আবিস্কার তাদের আরো সাফল্য।
এই দেশের ফসলগুলোর জন্ম থেকে খাবার হিসেবে খাওয়া নির্ভর করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর।
দেশে গবাদিপশুর ভ্রূণ প্রতিস্থাপন ব্যবস্থা আবিষ্কার ও প্রচলন করেছেন তারা।
শিক্ষকরা আরো তৈরি করেছেন ছাত্র, ছাত্রীদের নিয়ে মাটি পরীক্ষার সরঞ্জাম।
মাছের রোগ প্রতিরোধকল্পে ঔষধি গাছের ব্যবহার তাদের নব আবিস্কার।
হাওড়াঞ্চলে সমন্বিত চাষাবাদ কৌশল গড়েছেন।
ইলিশের জীবন রহস্য উন্মোচন করেছেন।
হারিয়ে যাওয়া ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের জীবন রহস্য উন্মোচন তাদের অনন্য কীর্তি। আরো কত যে সাফল্য আছে।
‘বাংলাদেশ এগ্রিকালচারার ইউনিভার্সিটি জার্মপ্লাজম সেন্টার’ অত্যন্ত পরিণত হয়েছে দিনে, দিনে।
তাদের আছে বহু সংগঠন।
অসংখ্য কৃতি ছাত্র, ছাত্রী ও গবেষক আছেন।
এআইপি-বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান জন্মদিনে তাদের সকল ছাত্র, ছাত্রী ও শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং এই দেশের কৃষক, কামার, কুমার, জেলেকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, ‘আপনারা জানেন, আমাদের অবদানে জন্মভূমি বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ করার যে চ্যালেঞ্জগুলো আমরা গ্রহণ করেছিলাম, মোকাবেলা করেছি, তাতে জয়লাভ করেছি। এই বিপুল জনসংখ্যার দেশ থেকে আমরা খাদ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হচ্ছি। বাংলাদেশের মানুষের ক্ষুধাকে জয় করেছি, খাবারের অভাব পূরণ করে দিয়েছি। দেশে মঙ্গার অবসান ঘটিয়েছি। মানুষের মাঝে নিরাপদ খাদ্য পৌঁছে দিয়ে চলেছি। আমাদের সকল ছাত্র, ছাত্রীরা দক্ষতার সঙ্গে নানা খাতে দেশে ও বিদেশে সুনামের সঙ্গে চাকরি এবং কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের মাধ্যমেই আমরা বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছি। আগামী দিনগুলোতে আরো সুনাম অজন করব।’
অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান একজন নামকরা কৃতি শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষা প্রশাসক। তিনি লবণাক্ততা সহিষ্ণু তিনটি সরিষা আবিস্কার করেছেন। বাউধান-৩ আবিস্কারক দলের অন্যতম গবেষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকস অ্যান্ড প্লান্ট ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক।
ওএফএস।