হারিয়ে যাচ্ছে গরু দিয়ে হালচাষ
যান্ত্রিক এই যুগে পুরোনো অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে। দেশের অনেক কিছুতেই ডিজিটালের সু-বাতাস বইছে এবং মানুষ ডিজিটালের সুবিধাগুলো পাচ্ছে অনেক সহজেই। সেই অগ্রযাত্রা থেমে নেই কৃষিভিত্তিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও। দিন দিন নতুন যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে সারাদেশ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালির চিরচেনা সেই গরু-লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষের চিত্র।
দেশের কৃষি প্রধান অঞ্চলের মধ্যে পটুয়াখালী অন্যতম গরু-লাঙ্গল দিয়ে রফিক হাওলাদারের জমি চাষ আর মই দেওয়ার দৃশ্য নজর কাড়ে সবার। এক সময় এই দিনে বাড়ি থেকে বের হয়ে মাঠের দিকে নজর পড়তেই দেখা যেত শত শত কৃষক বাঁশের ফালা দিয়ে তৈরি করা ধারালো লাঙ্গল কাঠের হাতল আর জোয়ালের মাধ্যমে গরুর কাঁধে বেঁধে দিয়ে জমি চাষ করছে। সে সময় গরু-লাঙ্গল ছাড়া জমি চাষ করার কথা চিন্তাই করা যেত না। অথচ গরু-লাঙ্গলের সঙ্গে কৃষকের সেই মিতালীর দৃশ্য এখন বিরল।
যুগের পরিবর্তন আর বিজ্ঞানের ক্রমাগত উন্নতির কারণে গরু-লাঙ্গলের স্থান দখল করে নিয়েছে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারসহ বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি। এখন আর কৃষক কাক ডাকা কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে জমি চাষ করতে মাঠে যায় না। কৃষক এখন তার সুবিধা মতো দিনের যেকোনো সময় ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার নিয়ে মাঠে গিয়ে অল্প সময়ে প্রয়োজনীয় জমি চাষ ও মই দিয়ে ফসল আবাদ করছে। তবে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষে পরিশ্রম ও সময় কমেছে। কিন্তু ফসলের গুণগতমান ও স্বাদ কমে গেছে। তা ছাড়া জমির উর্বরতাও হ্রাস পাচ্ছে।
পটুয়াখালী গলাচিপা আমখোলা ইউনিয়নের কৃষক রফিক হাওলাদার বলেন, এক সময় সব বাড়িতে গরু দিয়ে হালচাষ করত। এখন বিভিন্ন মেশিন দিয়ে হাল চাষ করা হয়। এখন প্রায় গরু দিয়ে হালচাষ বিলুপ্তের পথে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ডিজেলের যে দাম বেড়েছে এতে করে সামনের দিকে মেশিন দিয়ে হাল চাষ বন্ধ হয়ে যাবে। এমন সময় আসতেছে সবার আবার আগের মতো গরু দিয়ে হাল চাষ করতে হবে।
একই এলাকার কৃষক লিটন মোল্লা বলেন, জীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে আমার লাঙ্গল-জোয়াল আর গরুর পালের সঙ্গে। আমি ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে কাজ করি। বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা মেশিন দিয়ে হাল চাষ করি। আগে গরু দিয়ে হাল চাষ করতাম।
তিনি আরও বলেন, সংসারের আমি বড় ছেলে হওয়ায় বাবার সঙ্গে হাল চাষের কাজ করতাম। বাড়িতে হাল চাষের বলদ গরু ছিল ৩ জোড়া। চাষের জন্য দরকার হতো ওই বলদ গরুগুলো। ১ জোড়া বলদ, লাঙ্গল-জোয়াল, মই, ছড়ি (বাঁশের তৈরি গরু তাড়ানোর লাঠি), গরুর মুখের তুরি লাগত আমাদের হালচাষ করার জন্য। প্রায় কয়েক বছর হলো ট্রাক্টরের আসার পর থেকে এখন আর গরু দিয়ে হাল চাষ করি না।
গরু দিয়ে হাল চাষের উপকারিতার কথা বর্ণনা করে চাষি কালাম সিকদার বলেন, ‘গরু দিয়ে হাল চাষ করলে জমিতে ঘাস কম হয়, হাল চাষ করার সময় গরুর গোবর সেই জমিতেই পড়ত। এতে করে জমিতে অনেক জৈব সার হয়, এ জন্য ফসলও ভালো হয়। ট্রাক্টর দিয়ে চাষ পদ্ধতি শব্দ দূষণের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, হালের গরুর গোবর আমরা বাড়ি থেকে জমিতে দিতাম। সার কেনা লাগত কম। এ ছাড়া পরিবেশ দূষণ কম হতো।
তিনি আরও বলেন, লাঙ্গল দিয়ে চাষ করলে জমিতে অনেক খানি মাটির গভীরে গিয়ে মাটি তুলে উল্টিয়ে রাখত। ওপরের মাটি নিচে পড়ত আর নিচের মাটি ওপরে। এখন তো আর তা নেই। ট্রাক্টর দিয়ে গভীর থেকে মাটি তোলা হয় না।
ধীরে ধীরে পাওয়ার টিলারের প্রচলন হওয়ায় গরু দিয়ে হাল চাষের কদর কমে গেছে জানিয়ে এক প্রবীণ কৃষক জানান, কম সময়ে বেশি জমিতে চাষ দিতে সক্ষম হওয়ায় জমির মালিকরা পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করে নিচ্ছেন। অথচ এক সময় গরুই হাল চাষের একমাত্র মাধ্যম ছিল। বর্তমানে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার কৃষি ক্ষেত্রে অনেক সাফল্য নিয়ে এসেছে স্বীকার করে তিনি বলেন, যারা কৃষক গরু দিয়ে হাল চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করত কালক্রমে তারা পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। তবে এখনো গ্রামের কিছু কৃষক জমি চাষের জন্য লাঙ্গল-জোয়াল, গরু আর মই দিয়ে চাষ পদ্ধতি টিকিয়ে রেখেছেন।
গরু দিয়ে হাল চাষ গ্রামীণ সমাজের কৃষকদের একমাত্র অবলম্বন ছিল। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন তা বিলুপ্তির পথে। গ্রামীণ এই ঐতিহ্য ধরে রাখা এখন প্রায় দুরূহ। কারণ মানুষ এখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে। তবুও কিছু কিছু স্থানে আমাদের কৃষকদের এই ঐতিহ্য লালন করতেই অনেকে তা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। তবে যান্ত্রিকতার দাপটে ঐতিহ্যের এসব কৃষি উপকরণ কৃষকের ঘরে কতদিন টিকে থাকে তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। গরু দিয়ে হালচাষ না থাকায় গ্রামের মানুষের মাঝে অলসতা বিরাজ করছে, গরুর জৈব সার দিয়ে বাড়ির আঙিনায় যে শাক সবজি হতো সেগুলো এখন আর হচ্ছে না তাই আমাদের এই গ্রামীণ ঐতিহ্য গরু দিয়ে হালচাষ ও গরু পালন এগুলো টিকিয়ে রাখতে হবে।
এসএন