‘হাওয়া’র রাজনীতি ও রাজনীতির ‘হাওয়া’
আবু নাছের ভূঁইয়া
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৫শ ৩২ ডলারে আসতে ১৯৭২ ‘৭৩ সাল থেকে শুরু করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ৩৪ বছর সময় লেগেছে। আর ২০০৭-’০৮ সাল থেকে ২০১৯-২০ সালে পৌঁছে, ১১ বছরে মাথাপিছু আয় প্রায় চারগুণ হয়েছে। অনেক বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার। গত একটি বছর ২০২১-’২২ অর্থ বছরে আমাদের মাথাপিছু আয় প্রায় সাড়ে ৮শ ডলারের বেশি হয়েছে। এখন জনপ্রতি বাংলাদেশীদের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৯০০ ডলার। নেতৃত্বের দূরদর্শিতা ও ক্যারিশমায় শেখ হাসিনা চমক দেখিয়েছেন। কাল যেখানে আঁধার ছিল, আজ সেখানে আলো। কাল যেখানে মন্দ ছিল, আজ সেখানে ভালো।
আন্তর্জাতিক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় ২০০১ থেকে ২০০৬ বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে। ২০০১ সালে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে জোটে নিয়ে নির্বাচনের বৈতরণী পার হয়ে ক্ষমতায় এলেন বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া।
প্রধানমন্ত্রী হলেও তার দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থায় একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করে এবং দুর্নীতির বরপুত্র তারেক জিয়া ও তার কলঙ্কজনক অধ্যায়ের আঁতুড়ঘর হিসেবে অধিক পরিচিত হাওয়া ভবন গড়ে উঠেছে, খবরে প্রকাশ।
হাওয়া ভবনের কল্যাণে জর্জ মিয়া নাটক থেকে শুরু করে এমন কোন খাত নেই যে খাতে চরম দুর্নীতি, দুর্দশার চিত্র বাংলাদেশ দেখেনি। যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যখাত, অর্থনীতি, ব্যবসা, বাণিজ্য, সন্ত্রাস, জঙ্গি, মদদদাতাসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই তখনকার বাংলাদেশ ছিল দুর্নীতিতে ঠাসা। পেছনে কলকাঠি নাড়াতেন হাওয়া ভবনের তারেক জিয়া ও তার দোসররা। আওয়ামী লীগের নেতারা কর্মকান্ডগুলোতে ‘দুর্নীতির বরপুত্র’, ‘তারেক জিয়া মি. ১০ পার্সেন্ট’ ইত্যাদিতে অভিহিত করতেন। তখন দুর্নীতিতে বাংলাদেশ ৫ বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে। মোটা দাগে শিরোনাম হয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগলোতে। প্যারাডাইস পেপারস, উইকিলিকস-সব মাধ্যমেই উঠে আসেন বেগম খালেদা জিয়ার সুপুত্র। সীমাহীন দুর্নীতির তথ্য ছড়ালো তার জীবনে। তিনি কী ভেবেছিলেন এভাবেই বাংলাদেশে অন্ধকারের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন? ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে ক্ষমতার রাজনীতি থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগকে।
খালেদা জিয়া সরকারের দু:শাসন, সীমাহীন দুর্নীতি ও অরাজকতার মধ্যে এক-এগারোর সরকার দেশে আবির্ভূত হয়েছে। দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন তারেক জিয়াও। অথচ তার উল্টো চিত্র আজকের বাংলাদেশ। এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনা সৎ এবং দুর্নীতিমুক্ত থাকায় বিশ্ব দরবারে অনন্য উচ্চতায় আসীন হয়েছেন।
সম্প্রতি ইউরোপের একটি গবেষণা সংস্থা ‘পিপলস এন্ড পলিটিক্স’ বিশ্বের পাঁচটি সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিহ্নিত করেছেন, যাদের কোনো দুর্নীতেই স্পর্শ করেনি। তাদের বিদেশে কোন ব্যাংক একাউন্ট নেই, উল্লেখ করার মতো সম্পদই নেই। ১৭৩টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে ১শ নম্বরের ভিত্তিতে নম্বর প্রদান করা হয়েছে। তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল। তার স্কোর ৯০। দ্বিতীয় সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং, তার ৮৮। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮৭ স্কোর পেয়ে তালিকাটিতে তৃতীয়। নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইরনা সোলবার্গ, ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানী চতুর্থ ও পঞ্চম। তাদের স্কোর ৮৫ এবং ৮১। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭৮ শতাংশ মানুষই মনে করেন, শেখ হাসিনা দুর্নীতিমুক্ত, লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে। ছোটখাটো কোনো দুর্নীতিই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
১/১১তে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে তারেক জিয়া বিভিন্ন দুর্নীতির কথা স্বীকার করেছেন। ২০০৮ সালে তিনি মুচলেকা দিয়ে জামিনে মুক্ত হয়েছে। মুচলেকা দিয়ে লন্ডনে চলে যান। সেই থেকে লন্ডনে বসবাস। এর মধ্যে তার মা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা, মানি লন্ডারিং মামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ অন্যান্য মামলাগুলোর রায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামী হিসেবে লন্ডনে জীবনযাপন করছেন। কেন? কোথা থেকে আসে তারেক রহমানের গাড়ি-বাড়ি? বাংলায় প্রবাদ আছে ‘কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না।’ তারেক রহমানের ক্ষেত্রে যথাযথ। লন্ডনে বসে টাকা কামাচ্ছেন। বিএনপির লন্ডন শাখায় নির্বাচন, মনোনয়ন, রাজনীতি চলছে। তিনি স্কাইপের মাধ্যমেও সচল রেখেছেন।
বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পারেনি। ২০১৮ নির্বাচনে মনোনয়নের নামে তারেক রহমান সেখানে খুলে বসেছেন নির্বাচন কেন্দ্র। মনোনয়ন।
বিএনপির দুর্দিনে, নেতা, কর্মীরা ৩০০ আসনে ৯০০ জন মনোনয়ন পেয়ে যান। টাকার শক্তি রাজনৈতিক শক্তির চেয়েও অধিক! ব্যবসায়ী বা অন্য যে কোনো পেশার, যাদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার চেয়ে টাকার শক্তি বেশি ও তারেক জিয়া। তার চাহিদায় মনোনয়ন দেন কী?
দলের খারাপ অবস্থায় বিএনপি আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া, চাঁদপুরে এহসানুল হক মিলন, নারায়ণগঞ্জে তৈমুর আলম খন্দকারের মত ত্যাগী নেতারা মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
আবার যারা মনোনয়ন হারান, তাদের অনেকের কর্মীরা বিএনপির অফিসগুলোতে হামলা, ভাঙচুর, তালা লাগানোর মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন। তিন বারের প্রধানমন্ত্রী, সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী ৭৬ বছরের বছরের বৃদ্ধ মা পড়ে আছেন জেলে, কেন?
কথায় আছে, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।’ তারেক জিয়া লন্ডনে গিয়েও কৃতকর্ম থেকে নিজেকে সরাতে পারেননি। একই আসনে একাধিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়ে তিনি বিএনপির মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছিলেন। বিএনপির রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন। এত কিছুর পরেও তারেকের কোনো পরিবর্তন হয়নি কেন? তিনি যদি ২০১৮ নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে লন্ডনে কাজ করতে পারেন, তাহলে দেশে ফিরতে পারলে কী করবেন? এমনসব নীতি অবলম্বন করার কারণেই সমালোচকরা বলেন, বিএনপি এলিটদের ক্লাব।
উইকিলিকসের একটি তথ্য, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রদূত জেমস. এফ. মরিয়ার্টি তার দেশ মার্কিন যুক্তনাষ্ট্রের উচ্চ মহলে একটি গোপন তারবার্তায় তারেক সম্পর্কে লিখেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান মার্কিন সরকারের তিনটি লক্ষ্য- গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন ও জঙ্গিবাদ নির্মূলের মিশনকে প্রচণ্ডভাবে হুমকির সম্মুখীন করেছেন, আইনের প্রতি তার প্রকাশ্য অশ্রদ্ধা বাংলাদেশে জঙ্গিদের মূল শক্ত করতে সহায়তা করেছে।’
লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিক ও গবেষক।
ছবিটি প্রতীকি।