হ্যান্ডপ্যাডেল রিকশার চাকা ঘোরাতেই মুছে গেছে প্রতিবন্ধী শুভ’র হাতের রেখা
রংপুর নগরীর শুভ সাহা জন্মগত ভাবেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। কোমর থেকে পা পর্যন্ত নিচের অংশ অচল। পায়ে ভর দিয়েও দাঁড়াতে পারে না। শুধু ডান হাতটি সচল। এহাতেই তার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে উপার্জনক্ষম কেউ নেই। পরিবারে বৃদ্ধ মা-বাবা আর ভাইবোনের করুণ অবস্থা দেখে শেষ পর্যন্ত ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়েন। সংসারের বোঝা টানতে বেছে নেন ভিক্ষাবৃত্তি। এভাবেই ৮ বছর ধরে পথে প্রন্তরে ঘুরে অন্যের দয়ার দানে পরিবারের ভরণ পোষণের হাল ধরেছেন।
রংপুর নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের তাঁতিপাড়া এলাকায় থাকেন শুভ সাহা। সেখানে ভাড়া নেওয়া একটি জরাজীর্ণ ঘরে গাদাগাদি করে থাকছে তাদের পরিবার। ভিক্ষাবৃত্তির টাকায় বাবার ওষুধ, ছোট ভাইবোনের পড়া লেখার জোগান আর মাস শেষে দেন ঘরভাড়া। ২০ বছর বয়সী শুভ সাহা লেখাপড়া করতে পারেননি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আর অভাব অনটনের সংসার তাকে দমিয়ে রেখেছেন। কিন্তু শুভ সাহা সংসারে কারও বোঝা হয়নি। বরং নিজেই মা-বাবা, ভাইবোনদের দায়িত্বের বোঝা মাথায় তুলে নিয়েছেন তিনি। ছোটবেলা থেকে নানা রকম বিড়ম্বনার শিকার শুভ সাহা পরিবারের মুখে হাসি দেখতেই অন্যের কাছে হাত পেতে চাইলে লজ্জা করেন না বলে জানান।
রংপুর নগরীর স্টেশন রোড এলাকায় শুভ সাহার সঙ্গে দেখা হয়। তিন চাকার একটা হ্যান্ডপ্যাডেল রিকশা নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে বেড়ান তিনি। হাত বাড়িয়ে চান একটু সহায়তা।আলাপচারিতায় তিনি ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ার পেছনের করুন কথা শোনান শুভ সাহা। ভিক্ষাবৃত্তি পেশায় আসার কারণ জানতে চাইলে একটু ভারাক্রান্ত মুখে বলেন, গরিবের যন্ত্রণা বেশি, দুঃখ কষ্টের যেন অন্ত নেই। সৃষ্টিকর্তা আমাদের কপাল খারাপ করে জন্মদিয়েছেন। আমার বাবার বয়স ৮০ বছরের কাছাকাছি। পরিবারে কেউ নেই আয় রোজগার করার মতো। অসুস্থ বাবার ওষুধ, অন্যদের দেখাশুনা সবই আমাকে করতে হয়। আমি পঙ্গু বলে কেউ তো আমাকে কাজ দেবে না। এজন্যই ভিক্ষা করি জীবন বাচাঁর তাগিদে।
শুভ জানান, তার বাবা মঙ্গল সাহা একটা হোটেলে কাজ করতেন। এখন বয়স হয়ে গেছে। অনেকদিন ধরে অসুস্থ। এজন্য আর কেউ তার বৃদ্ধ বাবাকে কাজে নেন না। পরিবারের বড় সন্তান। মা-বাবার কষ্ট আর ছোট দুই ভাইবোনের মুখের দিকে চেয়ে ঘরে বসে থাকতে পারি না। পরিবারের কথা চিন্তা করে শরীরের অর্ধেক অংশ ও একটি হাত অচল হলেও মনোবল সুদৃঢ় রেখে নিরুপায় হয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়েছিন। ২০১৩ সাল থেকে ভিক্ষা করে সংসার চালাচ্ছি। ছোট ভাই রাম প্রসাদ আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করেছে। আর ছোট বোন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ালেখা করে।
প্রতিবন্ধি শুভ বলেন, প্রতিবন্ধী ভাতার কিছু টাকা দিয়ে নগরীর লোহা গাড়ায় তিন চাকার একটি গাড়ি বানিয়েছি। গাড়িটি নিয়ে সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করি। একহাতে সামনের হ্যান্ডেল আর আরেক হাতে চাকা ঘুরিয়ে গাড়ি নিয়ে সড়ক পারাপার ও চলাফেরা করতে খুব কষ্ট হয়। ৯ বছর ধরে এভাবে চলাফেরা করছি। প্যাডেল আর চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে হাতের তালুতে কড়া আর ফোসকা পড়েছে। এ কারণে আজ আমার হাতের রেখা মুছে গেছে। আমি ভিক্ষা করতাম না। সরকার থেকে প্রতিবন্ধীভাতা পাই। কিন্তু তা দিয়ে কি সংসার, ভাইবোনের পড়ালেখা, ঘরভাড়া দেওয়া সম্ভব? এজন্য ভিক্ষা করি। আমার বাবা তো বৃদ্ধ ও বেকার। সমাজে অনেক ধনী ও হৃদয়বান মানুষ আছেন। কেউ যদি একটু এগিয়ে আসেন। একটা ছোট দোকান করার ব্যবস্থা করে দেন তাহলে ভিক্ষা ছেড়ে দেব। আমার গাড়িটা ভেঙে গেছে সেটাও ঠিক করার মতো টাকাপয়সা নেই।
রংপুর সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মীর মো. জামাল উদ্দিন জানান, শুভ সাহার পরিবারে উপার্জন করার মতো তেমন কেউ নেই। প্রতিবন্ধী ভাতার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে সহযোগিতা দেওয়া হয়। বৃত্তবানরা শুভ সাহার পাশে এগিয়ে আসলে পরিবারটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।