ঋতুভেদে বদলায় নওগাঁর জবই বিলের রূপ
নানা বৈচিত্র্যে ভরা আমাদের এ বাংলাদেশ। প্রকৃতি অকৃত্রিম ভালবাসায় এ দেশটি সাজিয়েছে। বাংলাদেশের অপার সৌন্দর্য পর্যটকদের হৃদয়স্পর্শ করে। প্রকৃতির অকৃত্রিম, অনাবিল, অফুরন্ত বহুমাত্রিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। তেমনই এক মন প্রশান্ত করা ও নয়ন জুড়ানো দর্শনীয় স্থান হলো নওগাঁর সাপাহার উপজেলায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী জবই বিল। প্রতিদিনের যান্ত্রিক জীবন থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা নওগাঁয় জবই বিলের কোনো জুড়ি নেই।
বিলটিতে সারা বছর পানি থাকলেও ঋতুভেদে এখানকার রূপ ও সৌন্দর্য বদলায়। বর্ষায় বিলের চারিদিকে বিস্তৃর্ণ জলরাশির এক নয়ানাভিরাম সৌন্দর্যের দেখা মিলে জবই বিল এলাকায়। যতদূর চোখ যায় দেখা মেলে পানি আর পানি। এ সময় বিলের চারপাশের গ্রামগুলোকে দূরের কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বলে মনে হয়। স্বচ্ছ পানিতে মেঘের আনাগোনার প্রতিচ্ছবি বিলের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেয়। সব মিলিয়ে বর্ষাকালে জবই বিল এলাকায় চোখজুড়ানো দৃশ্যপট তৈরি হয়। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় পুরো বিল পানিতে নিমজ্জিত থাকার পর বিলের অধিকাংশ এলাকা জেগে ওঠে। শুষ্ক মৌসুমে বিলের মাঝে জমে থাকা জলরাশি থেকে আসা শীতল হওয়া ও পড়ন্ত বিকেলে মিষ্টি রোদের ছড়াছড়ি জবই বিলকে এক শিল্পীর হাতের সুনিপণ চিত্রপটের রূপ দেয়। তবে জবই বিলকে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষদের সবচেয়ে আকৃষ্ট করে শীতকালে। শীতের কুয়াশায় আচ্ছন্ন জবই বিল নানা ধরনের পাখির কলরবে মুখর হয়ে ওঠে। সাইবেরিয়াসহ পৃথিবীর শীতপ্রধান এলাকা থেকে আসা পরিযায়ী পাখি আর নানান ধরনের দেশি পাখির বিলের জলাশয়ে খাবারের খুঁজে বিচরণ করে। আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তে থাকা হাজারো পাখি দেখে দর্শনার্থীরা পুলকিত হন।
সাপাহার উপজেলার আইহাই ইউনিয়নে ভারত সীমান্তঘেঁষে বিলটির অবস্থান। ঐতিহ্যবাহী বিলটির উত্তরে ভারত থেকে উৎপত্তি হয়ে দক্ষিণে পুনর্ভবা নদীতে মিলিত হয়েছে। এক সময় যুগ যুগ ধরে বিলটি সাপাহার উপজেলাবাসীকে দুই ভাগে বিভক্ত করে রেখেছিল। ১৯৯৯ সালে জবই বিলের মাঝ দিয়ে নির্মিত ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পাকা সড়ক ও ২০০ মিটার দীর্ঘবিশিষ্ট দুটি সেতু দ্বারা উপজেলাবাসীর এ বিভক্তি মোচন হয়। বিলের ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে বিলের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করেন দর্শনার্থীরা। ঘুরতে আসা মানুষের সুবিধার জন্য সড়কের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে কংক্রিটের ছাউনি।
সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী, জবই বিলের আয়তন ৯৯০ একর বা ৪ বর্গকিলোমিটার। আগে এ বিল দামুর মাহিল নামে পরিচিত ছিল। বিলের উত্তরের অংশকে বলা হতো দামুর বিল ও দক্ষিণ অংশকে বলা হতো মাহিল বিল। তবে বিলটি জবই গ্রামের পাশে অবস্থিত হওয়ায় এটি বর্তমানে জবই বিল নামেই অধিক পরিচিত।
জবই বিলে এক সময় বাইচ (মাছ ধরার প্রতিযোগিতা) হতো। আগে সেখানে জাল যার জলা তার নীতি ছিল। বিলের আশপাশের হাজার হাজার মানুষ বিলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তবে বিলটি বেশ কিছু বছর ধরে মাছ চাষের জন্য ইজারা দেওয়ায় সেখানে বর্তমানে বাইচ হয় না। জেলেরা মাছ ধরা ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
জবই বিলের পশ্চিম তীরবর্তী পাহাড়িপুকুর গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা আব্দুল গফুর মণ্ডল বলেন, ‘২০-২৫ বছর আগেও এ বাইচ হইছে। প্রতি বছর খরার সময় বিলের পানি কমে গেলে পলো (বাঁশ ও বেতের সংমিশ্রণে তৈরি মাছ ধরার যন্ত্র) নিয়ে বিলের আশপাশের গ্রামের মানুষ ছাড়াও সাপাহার, পত্নীতলা ও পোরশা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ মাছ ধরতে আসতেন। সপ্তাহের দুই দিন রোববার বিলের উত্তর অংশে ও মঙ্গলবার দিন বিলের দক্ষিণ অংশে বাইচ হতো। হাজার হাজার মানুষের মাছ ধরার সেই দৃশ্য আজও চোখের সামনে ভাসে। ৩০-৪০ কেজি ওজনের বোয়াল, আইড়, গজারসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরা পড়ত। বড় বড় মাছের আঘাতে প্রতি বছর বাইচে দুই-একজন মানুষের মৃত্যু হতো। এজন্য এলাকার লোকজন এ বিলকে মানুষ খেকো বিল বলে ডাকত। তবে যখন থেকে বিলে মাছ চাষের জন্য সরকারিভাবে ইজারা দেওয়া শুরু হয়েছে তখন থেকে এখানে আর বাইচ হয় না।’
জবই বিলের সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্দি করতে চাইলে রোদের বিষয়টি মাথায় রেখে এখানে আসতে হবে। এখানে সকাল কিংবা বিকেলের দিকে আড্ডা দেওয়ার উপযুক্ত সময়। তবে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীরা অনেকেই খাবারের আবর্জনা ফেলে এখানকার পরিবেশ নোংরা করে ফেলেন।
বিলের পথ দিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়বে ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকা। বিলে ঘুরতে আসা মানুষের ঘোরার জন্য বিলের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া সড়কে ভেড়ানো থাকে নৌকা। টাকার বিনিময়ে স্থানীয় মাঝিরা নৌকায় করে দর্শনার্থীদের বিল ঘুরে দেখান। দিন শেষে যখন আলো ফুরিয়ে যায়, জবই বিলের সৌন্দর্য যেন আরও বেড়ে যায়। চাঁদের আলোয় দেখা যায় অপরূপ গ্রামবাংলা।
জবই বিলে অতিথি পাখির পর্যাপ্ত খাবার থাকায় প্রতি বছর শীতের মৌসুমে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির আগমন ঘটে। বালিহাঁস, পাতি সরালীসহ জানা-অজানা বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আসে বিলে। পাখির কিচিরমিচিরে সব সময় মুখরিত থাকে। বিলের ছোট ছোট মাছ, জলজ পোকা-মাকড় এবং শামুকই মূলত তাদের প্রধান খাদ্য। অতিথি পাখি ছাড়াও সারা বছর দেশি নানা প্রজাতির পাখির বিচরণ দেখা যায় এ বিলে।
জবই বিলের জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে সেখানে গড়ে উঠেছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটি নামে ওই সংগঠনের সদস্যরা পরিযায়ী পাখিসহ যেকোনো দেশি পাখি শিকার বন্ধে সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি সোহানুর রহমান সবুজ বলেন, আগে যখন এ বিলে জাল যার জলা তার নীতি ছিল, তখন এখানে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। বিলের আশপাশের গ্রামের জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বিলে জলজ উদ্ভিদও প্রচুর পরিমাণে ছিল। তবে যখন থেকে বিলটি মাছ চাষের জন্য ইজারা দেওয়া শুরু হয়েছে, তখন থেকে বিলে আর দেশি মাছ তেমন একটা পাওয়া যায় না। বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের ফলে বিলের জলজ সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে ২০২০ সাল থেকে ঐতিহ্যবাহী এ বিলের ইকোসিস্টেমের কথা চিন্তা করে এখানে বাণিজ্যিক মাছ চাষ বন্ধ হয়েছে। বর্তমানে এ বিলে আশপাশের গ্রামের পরিচয় সনদধারী জেলেরা এখানে মাছ আহরণ করে থাকেন। এর ফলে এ বিলে আবারও দেশি প্রজাতির মাছ পাওয়া যাচ্ছে। জলজ সম্পদও সমৃদ্ধ হচ্ছে।
জবই বিলে ঘুরে বেড়ানোর প্রকৃত সময় বর্ষাকাল ও শীতকাল। নওগাঁ জেলা শহর থেকে জবই বিলের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। সেখানে যেতে হলে পর্যটকেরা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানে রাজশাহী শাহ মখদুম বিমানবন্দর যেতে পারবেন। রাজশাহী থেকে এরপর নওগাঁর সাপাহার উপজেলা সদর পর্যন্ত বিআরটিসিসহ বিভিন্ন পরিবহনের বাসে করে আসতে পারবেন। এ ছাড়া ট্রেনে ঢাকা থেকে সান্তাহার রেলস্টেশন নামতে হবে। সেখান থেকে বাস কিংবা অটোরিকশার মাধ্যমে জবই বিলে যাওয়া যাবে। আবার ঢাকা থেকে বিভিন্ন জনপ্রিয় পরিবহনের এসি বা নন-এসি বাস করে সরাসরি সাপাহারে যাওয়া যাবে। সেখানে থেকে সিএনজি, অটোরিকশা কিংবা ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে করে জবই বিলে যেতে পারবেন।
সাপাহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্যাহ আল মামুন বলেন, ‘জবই বিলের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সম্প্রতি বিলের মাঝ দিয়ে যাওয়া সড়কে জবই সেতু ও মাসনাতলা সেতুর সংযোগ সড়কের উভয় পাশে পিলার বসানো হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের পরিকল্পনা আছে দর্শনার্থীদের বসার জন্য বিলের মাঝ দিয়ে যাওয়া রাস্তায় কংক্রিটের বেঞ্চ তৈরি করা হবে। এ ছাড়া বিলের রাস্তা থেকে বিলের মাঝ বরাবর গিয়ে সৌন্দর্য উপভোগের জন্য ঝুলন্ত রাস্তা তৈরি করা হবে। আশা করা যাচ্ছে চলতি অর্থবছরে এসব পরিকল্পনা দৃশ্যমান হবে। দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরির পাশাপাশি জবই বিলের ইকোসিস্টেম রক্ষার জন্য প্রশাসন সব সময় সচেষ্ট রয়েছে।’
এসএন