এই বাংলায় জম্মে আমি হয়েছি ধন্য
দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের বন্ধুরা এবার গেলেন ফোর্ডনগর। রূপময় গল্প লিখেছেন প্রতিষ্ঠাতা জাভেদ হাকিম। ছবি তুলেছেন ফরিদ, হানিফ।
দেখার চোখ থাকলে সবই সুন্দর। তবে প্রকৃতির রুপ-লাবণ্যের নির্যাস পেতে হলে চাই অর্ন্তদৃষ্টি। আমাদের দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’র বন্ধুদের জীবনে পুরোটাই যেন দেখা আর দেখানো। বহুবার গিয়েছি নিছক আড্ডা জমাতে সাভার নামাবাজার নতুন ব্রীজ পার হয়ে ফোর্ডনগরে। অথচ খড়ার চর, ফরিঙ্গা আরেকটু এগিয়ে কাংশা বা ফোর্ডনগরের প্রথম খন্ড যাওয়া হয়নি। ফোর্ডনগর পরিধির প্রথম খন্ড মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর, দ্বিতীয় খন্ড পড়েছে ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলায়। এ দুটো খন্ডতেই সাভার বাজার রোড দিয়ে যাওয়া খুবই সহজ ও কাছে।
হুট করেই একদিন দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’র বন্ধুরা ঘুরতে চলে গেলাম। সংগঠনের অ্যাডমিনের বন্ধুরা বেশকটা মটর বাইক এনেছে। তাতে সাত-সকালেই ছুটে গেলাম খড়ার চর গ্রামে। ঘুরে বেড়ালাম ছবির মত সুন্দর গ্রামের আশপাশে। মায়াবী পথে ঘুরতে, ঘুরতে চলে গেলাম মানিকগঞ্জ উপজেলায়, ধলেশ্বরীর তীরের গ্রাম কাংশা। আশ্চর্য হলাম ঢাকার এত পাশে, অথচ এখনও রয়েছে খাঁটি গ্রাম বাংলা। কাংশার প্রকৃতি দেখলে বিশ্বাসই হবে না, এখানকার দূরত্ব কোলাহলের শহর ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে ৩৭ কিলোমিটার মাত্র। চারপাশ নয়নাভিরাম প্রকৃতি দিয়ে ঘেরা। নেই কোনো কোলাহল।
কাংশা ব্রিজের উপর থেকে শান্ত ধলেশ্বরীর রূপ দেখলাম। একটা সময় আর লোভ সামলাতে না পেরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম নদীর বুকে। চললো সবার ইচ্ছেমতো জলকেলি। পানির নীচের কাদা দিয়ে সারা শরীর মেখে, হারিয়ে গেলাম শৈশবের স্মৃতিতে। নদীর পাড়ে বসে থেকে মাঝবয়সীদের এ রকম ছেলেমিপনা উপভোগ করছেন মাঝবয়সী স্থানীয় মাজের আলী। তারে জিগাই, ‘ও ভাই কি দেহেন?’ উত্তর দেন, ‘পাগলামি দেহি।’ ‘হা, হা, হা- কন কি ভাই! আমরা কি পাগল?’ মাজের বলেন, ‘আমিও আরেক পাগল। পাগল না হইলে কি আর আপনাগো গোসল করা আমি বইয়া দেখি।’ বাহ্, বেশ যুক্তিসঙ্গত উত্তর। ভালো লেগে গেল মানুষটারে।
জুম্মার আজান হতেই পানি হতে উঠে আসলাম। নয়া আমদানী মাজের পাগলও হলেন আমাদের সঙ্গী। এবার দে-ছুটের দামালদের আর পায় কে? স্থানীয় পাগল বলে কথা! হি, হি, হি, করে হাসলাম সবাই। নামাজ পড়ার জন্য তার সঙ্গে চলে গেলাম কাংশা ব্রিজের ওপারে। জুম্মা শেষে গ্রামটা ঘুরে দেখলাম। পেটে এবার চোঁ, চোঁ। দুপুরের খাবারের জন্য চলে গেলাম আগে থেকেই আয়োজন করে রাখা খড়ার চর মাদ্রাসার মেহমানখানায়। বেশ আয়েশ করেই উদরপূর্তি চললো। খাওয়া, দাওয়া শেষে ফড়িঙ্গা গ্রামে। বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠের মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে এক পুরানা বটবৃক্ষ। খানিকটা সময় চললো সেখানে আড্ডা।
এবার যাই বংশী নদীর তীরে কাজিয়ালকুন্ডু গ্রামে। যার বুক চিরে নতুন পিচ করা সড়ক চলে গেছে আরিচা মহাসড়কের ঢুলিভিটার দিকে। পথের দুপাশে সৃজন করা বনায়ন। বেশ চমৎকার, নিরিবিলি পরিবেশ। সড়কের পাশেই বিশাল বিল। জেলেরা আপন মনে মাছ ধরছেন। সেসব মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে, দেখতেই ছুটলাম চৌঠাইল গ্রামের দিকে। মাঝে রূপনগরের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ জুড়ে সরষে ফুলের রূপ। খানিকের জন্য দিলাম ব্রেক। যতদূর চোখ যায়- শুধু হলদে রাঙা সরষে। আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে দূর দেশ থেকে আসা পরিযায়ীর দল। আমরাও বেশি দেরী না করে ছুটে চললাম আড়ালিয়া হয়ে চৌঠাইল।
পড়ন্ত বিকালে গ্রামের পিচ ঢালা সরু পথে মটর বাইকে চড়ে বেড়ানোর মজাই আলাদা। বাইকার, সাইক্লিস্টদের জন্য আকর্ষণীয় জায়গা এই পথগুলো। চলতে, চলতে অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম চৌঠাইল। এ পাশটায় ধলেশ্বরী সরু খালের রূপ ধারণ করেছে। সম্ভবত নদীখেকোদের শকুনি দৃষ্টি পড়েছে। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য এখনও অসাধারণ। সবুজ ফসলের ক্ষেত, বাঁশবাগানে নানা পাখির কিচির-মিচির, কৃষকের মিষ্টি হাসি, গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোর অনুসন্ধানী জিজ্ঞাসা, লেগেছিল বেশ। ঘুরে, ঘুরে ভ্রমণের নির্যাস নিতে, নিতে একসময় দেখি, তেজদীপ্ত লাল সূর্যটি সেদিনের জন্য নানা রঙের আভা ছড়িয়ে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে।
তড়িৎ গতিতে জসিম ও হানিফ ধলেশ্বরীর তীরে তাঁবু টানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। দুর্জয় বারবিকিউর জন্য মুরগীর খোঁজে বাজারে ছুটলো। আমি বান্দা অলস, শুধু চেয়ে চেয়ে ওদের দৌড়ঝাঁপ দেখছি। বাদ মাগরিব শুরু হলো ভরা জোছনার আলোয় মুরগী পোড়ানো। হিম বাতাসে তপ্ত আগুনে ঝলসানো মুরগীর গোস্তের সঙ্গে পূর্ণিমার চাঁদটাকেই মনে হলো সদ্য ভাজা নান রুটি।
এরকম জায়গায় ঘুরতে গেলে, যে কাউকেই আনমনে বিড় বিড় করে গেয়ে উঠতে হবে, ‘আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ।’ আসলেই। যার দ্বিতীয় খন্ডে এত রূপ, তার প্রথম খন্ডের প্রকৃতিতে, না জানি আরও কত মায়াবী, নৈসর্গিক লাবণ্য মিশানো আছে। তবে কী পাহাড়ের গহীনে যাওয়া দে-ছুট ভ্রমণ বন্ধুরা, বাড়ির পাশের দ্বিতীয় খন্ড না দেখেই থাকবে? না তা কখনেই হতে পারে না।
আবারও একদিন কুয়াশার চাদরে মোড়ানো খুব ভোরে চলে গেলাম প্রথম খন্ড দর্শনে। ব্রিজ দিয়ে না গিয়ে সাভার থানা রোডের ভাগলপুর গ্রামের বংশী নদীর বালুর ঘাট হতে খেয়ায় পার হলাম। নদীর পার দিয়ে হাঁটতে, হাঁটতে গ্রামের মেঠো পথে ঢুকে পড়লাম। যতই যেতে থাকি, ততই যেন মুগ্ধতা ভর করছে। দারুণ সব নয়নাভিরাম দৃশ্য। একসময় ফসলের আইল ধরে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে, হাঁটতে মনে হলো, দেশীয় নানান পদের সবজির বেশিরভাগ চাহিদাই মিটিয়ে দেয় এই ফোর্ডনগর। পৌষের হিম শীতল বাতাসে বেশ ভালো লাগছে প্রাত:ভ্রমণ। দূর থেকেই চোখে ধরা দিচ্ছে গোলাপ ও গ্লাডিওলাস বাগানের নজরকাড়া সৌন্দর্য। পথেই দেখলাম, চন্দ্রমল্লিকার বাগান। তাদের রেখে লাল, গোলাপি, সাদা, বেগুনি গ্লাডিওলাস বাগানের সামনে যেতেই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। বাংলার রূপ পুরোটাই এ পাশটায় যেন ভর করেছে। গাঢ় লাল ও সাদা-এ দুটো রঙের ফুলের বাগানই বেশি। কুয়াশা ভেদ করা চিক, চিক রোদের আলো ফুলের গায়ে খেলা করছে। বাগানভর্তি ফুটন্ত গ্লাডিওলাস। চারপাশে ঘনসবুজ গাছ, গাছালি। আহ্ কী অপার্থিব সুখ! প্রকৃতির এরকম দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যে আমরা সবাই বিমোহিত। তখন আমার চিৎকার করে বলে উঠতে ইচ্ছে করছিল, এই বাংলায় জম্মে আমি হয়েছি ধন্য।
যুগের পরিক্রমায় ভাগ হয়ে যাওয়া দুই খন্ডের ফোর্ডনগর জুড়েই, আজও চিরায়িত গ্রাম-বাংলার অনিন্দ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভর করে আছে। সীমানা ভাগ হলেও, ফোর্ডনগরের নজরকাড়া সৌন্দর্যকে কেউ ভাগ করতে পারেনি। বরং ফুলচাষিরা যেভাবে জমির পর জমি গ্লাডিওলাসের চাষাবাদ শুর করেছেন, অদূর ভবিষ্যতে সারা দেশের ফুল ও ভ্রমণপ্রেমীদের মিলন মেলায় পরিণত হবে ফোর্ডনগরের গ্রামগুলো। একদা জলদস্যুদের আক্রমণ হতে নিরাপদ থাকার জন্য, ওলন্দাজ পুর্তগিজদের তৈরি ফোর্ড দূর্গ কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও এখন তা ক্রপ ফোর্ড মানে ফসলের দূর্গ। ফুলচাষিরা যদি তাদের চাষাবাদ অব্যাহত রাখেন, তাহলে হয়তো একদিন ফোর্ডনগর নামটি মানুষ ভুলে গিয়ে ফুলের নগর হিসেবে চিনবেন। যেমনটা সাদুল্লাপুর। এখন গোলাপ গ্রাম হিসেবেই বেশী পরিচিত।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে জানতে পারলাম, দেশী গরুর কাঁটি দুধ আর খাসের চর, মিরের চর গ্রামে আবহমান বাংলার শীত ঐতিহ্যের খেজুর রসের স্বাদও নেয়া যাবে। ততক্ষণে সূর্যি মামা মাথার ওপরে। কি আর করা-তাই সেদিনের মতো রসের লোভ সংবরণ করেই ফিরতি পথে চললাম।
যাবেন কিভাবে : গুলিস্তান, গাবতলী বা অন্য কোন বাস স্ট্যান্ড থেকে আরিচা বা সাভারগামী বাসে যেতে হবে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড। সেখান হতে রিক্সা বা অটোতে নামাবাজার। ব্রিজের সামনে থেকে ভাড়ায়চালিত মটর বাইক, অটোতে রূপনগর, কাজিয়ালকুন্ডু, চৌঠাইল, খড়ার চর, কাংশাসহ ফের্ডনগর ১ম খন্ডের গ্রামগুলোতে ঘোরা যাবে। এভাবে দ্বিতীয় অংশ।
খরচপাতি : সারাদিনের ঘোরাঘুরির জন্য জনপ্রতি ৫০০, ৬০০ টাকা হলেই চলবে। খরচের ব্যপারটি অনেকটাই নিজেদের সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করে।
ভ্রমণ তথ্য : সড়ক পথ ভালো। নিরাপত্তাও রয়েছে যথেষ্ট। চাইলে পরিবারের সব বয়সী সদস্যদের নিয়েও ঘুরে আসা যাবে। ফোর্ডনগর, নামাবাজার ব্রিজ আঞ্চলিক ভাষায় ফুটনগর নামেও পরিচিত। খুব সকালে চলে গেলে একদিনেই ফোর্ডনগর প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড ঘুরে আসা যাবে।
ওএফএস।