একটি সুবর্ণ গল্প
ছন্দের পতনে ভরা সুবর্ণা মজুমদারের জীবন। বহমানতা নেই, আছে দু:খ। তারপরও থেমে থাকেনি জীবনের সংগ্রাম । চমকে দেওয়া কাহিনী লিখেছেন ও ছবি তুলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র সাংবাদিক সফিকুল আহসান ইমন
জন্ম বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার কুরমুনি গ্রামে। বাবা তার সামান্য একজন দিনমজুর। সুবর্ণা মজুমদাররা সবাই বোন। তিনি দ্বিতীয়। দিনমজুরের মেয়ে হওয়া বড় দুর্ভাগ্যের। তাই দিয়ে যে জীবন গড়া ওদের। বড় বোনেরও যথেষ্ট মেধা ছিল। টাকার অভাবে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরমও তুলতে পারেননি। টানাপোড়েনের এক নিদারুণ সংসার। বাবা এই মেয়েটিরও পড়ালেখার খরচ চালাতে পারেননি। নবম শ্রেণীতে পড়–য়াকে তাই বিয়ে দিয়েছেন। জামাই একই উপজেলার কালশিরা গ্রামের আশীষ কুমার মন্ডল। তবে সুবর্ণা অদম্য মেধাবী। জীবনের কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাকে হারাতে পারেনি। সংসারের অনেক কাজ সামলেছেন। লেখাপড়া করেছেন খুব কষ্টে। এভাবেই এইচএসসি পাশ।
এরপর পড়ালেখা করবেন কীভাবে? এই চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারতেন না সুবর্ণা। পড়ালেখার তার বড় শখ। মানুষের জীবনে শিক্ষাই পাথেয়-এই সত্যটি খুব অল্প বয়সেই জানতে পারলেন কিশোরী মেয়েটি। মাসে দেড়শ টাকা পারিশ্রমিকে একটি গ্রামের সামান্য গ্রন্থাগারে লাইব্রেরিয়ানের চাকরি নিলেন সুবর্ণা। এই তার মাসে টাকার যোগান। এ কটি টাকা দিয়েই তিনি সামনে এগিয়েছেন। তিলে, তিলে টাকা জমিয়েছেন বহু কষ্টে। অভাব, অনটন হাসিমুখে সয়েছেন। সংসারের সব কাজ করেছেন। পড়ালেখা করেছেন সময় বের করে।
২০১৭ সালে জীবনটি বদলে গেল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গরীব ঘরের এই বৌটির। ভর্তি হলেন তিনি সমাজবিজ্ঞানে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অত্যন্ত ভালো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো এক বিভাগের ছাত্রী হলেন তিনি। সংসার আছে যার, আছেন শ্বশুড়, শ্বাশুড়ি, দেবর, ননদ, জা। আবার নিজের সংসার আছে। স্বামী আছেন। নিজের পরিবারও আছে। তাদের নিয়ে জীবন বদলে দেওয়ার স্বপ্ন আঁকতে থাকলেন একটি গ্রামের অসামান্য তরুণী। তার মধ্যেই মেধাতালিকাতে নামটি রইলো তার। চমকে গেলেন নিজেও। আসলেই কী আমি এত মেধাবী? তবে সেখানেও তার জীবনে আঘাত এলো খুব করুণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটে ক্লাস শুরু হয়েছে। আর সবার মতো স্বপ্ন বুনতে বুনতে ক্যাম্পাসে যান সুবর্ণা মজুমদার। স্বামী হলেন তার জীবনের স্বপ্ন দেখানোর মানুষ।
সেদিন ছিল রবিবার। বৃহস্পতিবার গিয়ে সেদিন সকালে চলে এলেন তিনি বাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রধান ফটকের সামনের মূল রাজপথে এসে নামলেন। ততক্ষণে ক্লাসের দেরি হয়ে গিয়েছে। সময় কী আর বসে থাকে? প্রথম বর্ষে দ্রুত ক্লাস ধরবেন বলে বেখেয়ালে পড়ালেখাপ্রেমী সুবর্ণা রাস্তা পেরুতে গেলেন। একজন বাসের চালক, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গাড়ি চালনা করেন, অসতর্ক হয়ে চাপা দিলেন সুবর্ণাকে। তীব্র আতনাদে তার চারপাশ নি:স্তব্ধ হয়ে গেল। ছাত্র, ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা উদ্ধার করলেন তাকে। থেঁতলে গিয়েছে শরীর। নিথর পড়ে আছেন তিনি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। সঙ্গে, সঙ্গে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে উদ্ধার করে নিয়ে গেলেন শিক্ষকরা। অনেকে চিনেছেন, এই মেয়েটি সুবর্ণা মজুমদার। আমাদেরই ছাত্রী।
অনেকক্ষণ যুদ্ধ করে বাঁচার আশা কম বলে হতাশ চিকিৎসকরা বেরিয়ে এলেন অপারেশন থিয়েটার থেকে। ভালো চাইলে এখনই নিয়ে যান ঢাকায়-রোগীকে বাঁচাতে বললেন তারা। ভিসি স্যারের কল্যাণে সরকার থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হলো সঙ্গে, সঙ্গে। তারা একজন উপাচার্যের কাতর অনুরোধ ফেলতে পারেননি। ছাত্রীকে বাঁচানোর শিক্ষকের আর্তনাদ তাদের কষ্ট হয়েছে। সঙ্গে, সঙ্গে ঢাকার অন্যতম সেরা অ্যাপোলো হাসাপাতাল থেকে চিকিৎসক নিয়ে ঢাকার দিকে চললো বিমান। এরপর টানা একটি সপ্তাহ আইসিইউতেই কেটেছে তার। সুবর্ণাকে নিয়ে চিকিৎসকরা লড়েছেন জীবন ও মৃত্যুর লড়াই। জ্ঞানই ফেরেনি তার। তারপর চোখে আলো এলো, তার মস্তিস্ক সাড়া দিলো। এই সময়টিতে সুবর্ণার সহায় হয়ে পাশে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. খন্দকার নাসির উদ্দিন। তিনি সারাক্ষণ গরীব বাবার অভাব দূর করেছেন তার ক্ষমতা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও প্রচেষ্টায়।
সুবর্ণার প্রথম বাক্যই ছিল-‘আমি কে? তুমি কী আমাকে চেন মা?’ অনেক দূর থেকে মৃদু স্বর আস্তে, আস্তে তার কানের পর্দায় এসে লাগলো। মনে করতে পারেন, অবিশ্বাস্য মেধাবী মেয়েটি, দারুণ যার স্মৃতিশক্তি। আবছা, আবছা দৃষ্টিতে এক পলক তাকিয়ে থাকলেন তিনি তার দিকে। এরপর রোগাক্রান্ত স্বরটি জবাব দিল ধীরে, ‘জ্বী। আমি আপনাকে চিনি, আপনি আমাদের উপাচার্য স্যার।’ তার পাশে বসে আছেন তিনি। সুবণা নিজেকে একটি ভালো হাসপাতালের ভালো বেডে আবিস্কার করলেন। জানলেন তিনি খুব অসুস্থ। মনে পড়লো, পুরোনো জীবনের কথা, আহত হবার কথাও খেয়াল হলো। চিকিৎসক আর নার্সদের ভীড়ে, চারদিকে মা-বাবা, আত্মীয়জনকে স্বামীসহ দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। নিজের অসুখও তার শরীর জানালো। ফলে কাঁদতে লাগলেন তিনি। আর কোনোদিন উচ্চতম শিক্ষিত হতে পারবেন না, পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকতে হবে বিছানায়। তার বাবার এই টাকা শোধেরও ক্ষমতা নেই। স্বামী থাকবে না, সংসারও না। একজন অসহায় দুর্বল, অক্ষম মেয়ে হিসেবে জীবনটি কাটবে আমার। এই হাসপাতালের টাকা শোধের ক্ষমতাও তো আমার পরিবারের কারো নেই। জানেন তিনি।
তবে তার কোনোকিছুই ঘটেনি উপাচার্য অধ্যাপক ড. খন্দকার নাসির উদ্দিনের কারণে। পাশে দাঁড়িয়েছেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু, স্বজনেরা। তারা আইসিইউতে ভর্তি সুবর্ণার জন্য মিছিল, মানববন্ধন করেছেন। সুবর্ণা মজুমদারের উন্নত চিকিৎসা, ব্যয়ভার বহন, চাকরি প্রদান ছিল। অন্যদিকে নিজের সব যোগাযোগ ও পরিচিতি ব্যবহার করেছেন উপাচার্য স্যার। ফলে অ্যাপোলো হাসপাতালের সেরা চিকিৎসা লাভের সুযোগ হয়েছে সুবর্ণার। তিনটি মাস হাসপাতালের বেডে পড়েছিলেন তিনি। তিনবার পায়ে ও দুইবার মাথায় অপারেশন করতে হয়েছে। মোট ২০ লাখ টাকার পুরোটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে সরকার বহন করেছেন। এই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক, ছাত্র, ছাত্রী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ভালোবাসা লাভ করেছেন তিনি।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. খন্দকার নাসির উদ্দিনের ভালোবাসার কথা কোনোদিন ভুলবে না তার পরিবার। তিন মাসের মাথায় প্রিয় অসহায় ছাত্রী যখন বাড়ি ফিরে গেল বাগেরহাটে, তিনি এক সপ্তাহের মধ্যে তার স্বামী আশীষ কুমার মন্ডলকে মাস্টার রোলে একটি চাকরি দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে অভাব, অনটন আর দু:শ্চিন্তার কালো মেঘ সরে গেল পরিবারটির ওপর থেকে। কাজ শেষে স্ত্রীর যত্ন করতে পারেন। তাদের বাসা হলো ক্যাম্পাসের ভালো পরিবেশে। তারা উন্নত জীবনের দেখা পেলেন। ধীরে, ধীরে আবার সাহস বেড়ে গেল মেয়েটির অন্যদের পড়ালেখা করতে দেখে। তার বয়সের মেয়েরা যখন ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ক্লাস করতে যান, তিনি আর বসে থাকতে পারেন না। স্বামীও এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বদন্যতা ও সহযোগিতার কথা শতমুখে বলেন। ফলে চিকিৎসকদের বেঁধে দেওয়া নিয়মে এগুতে থাকেন তিনি। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সাহায্যে আরো ভালোভাবে তরুণী বৌ, ছাত্রীটির যত্ন নিয়েছেন। তাতে পড়ালেখার সুযোগ হয়েছে ফের সুবর্ণা মজুমদারের।
কম বেতনে তাদের সংসার ভালোভাবে চলতে থাকে। ক্যাম্পাস তাদের ভুলে যায়নি মোটেও। ওষুধ, সংসার খরচ, পড়ালেখা ইত্যাদি বিবেচনা করে আজকের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ. কিউ. এম. মাহবুব এই ফেব্রুয়ারিতেই সুবর্ণা মজুমদারের স্বামী আশীষ কুমার মন্ডলকে স্থায়ী চাকরি দিয়েছেন বিশেষ বিবেচনায়। ফলে তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন খুব ভালোভাবে। এরপর পড়ালেখার খবর। দারুণ ছাত্রী সুবর্ণা অনার্সে সমাজবিজ্ঞান থেকে প্রথম শ্রেণী লাভ করেছেন। তিনি আছেন মেধাতালিকায় ৩.৬০। এখন শিক্ষক হতে চান তিনি। উচ্চতর ডিগ্রি নেবেন। বলেছেন ক্যাম্পাসের ছোট ভাই সাংবাদিক সফিকুল আহসান ইমনকে, ‘আমরা ভালো আছি খুব। ভেবেছিলাম, মরেই যাবো। সেটি হয়নি তোমাদের সবার কারণে। এখনো মাথা ও পায়ে ব্যথা করে। খুব যন্ত্রণা হয়। নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। তবে আমাদের কৃতজ্ঞতার কোনো শেষ নেই।’
পুরোনো জীবনে ফিরে তাকাতে চান না সবগুলো পর্যায়ে খুব ভালো ফলাফল করা মেয়েটি। পাঁচ বছরের টানা ভালোবাসায় তিনি অভিভূত। মেয়েটিকে সাহায্য করতে পেরে খুব ভালো লাগছে তাদের ক্যাম্পাসের। সবার হয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ. কিউ. এম. মাহবুব বলেছেন, ‘ভিসি হিসেবে যোগদানের পর থেকে আমি মেয়েটির পাশে আছি। নিয়মানুযায়ী সুবর্ণার স্বামীকে স্থায়ী চাকরিতে যোগদান করানো হয়েছে। আমি তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করি।’ এরপর বলেছেন, ‘আমাদের প্রশাসন সবসময় ছাত্র, ছাত্রীদের পাশে থাকে। আমরা তাদের ভালোবাসি।’
ছবি : অসাধারণ সুন্দরী ও মেধাবী সুবর্ণা মজুমদার; তাদের যৌথজীবন-আশীষ কুমার মন্ডল ও স্ত্রী সুবর্ণা।
ওএস।