কাঁঠাল থেকে বারির ১০টি খাবার!
পুষ্টির রাজা কাঁঠাল থেকে ১০টি খাদ্যপণ্য বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বারির দুই বিজ্ঞানী। তারা প্রধান শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি গবেষণাগারের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. হাফিজুল হক খান। তার সঙ্গে বিভাগের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী। এসেছেন বিনার মহাপরিচালকও সেদিন। লিখেছেন রাকিবুল হাসান
কাঁঠাল তো আমাদের জাতীয় ফল। কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষকরা বলেন ‘পুষ্টির রাজা’। খেতে হয় আয়োজন করে। মৌসুমী ফসলটি অত্যন্ত অর্থকরী। তবে কৃষি অধ্যাপক ও গবেষকদের মতে, প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে প্রতিবছর দেশে বিপুল পারিমাণ নষ্ট হয়ে যায়। চাষীদের টাকা না পাওয়ার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে চান তারা। সেজন্য সবাই কাজ করছেন। সারা বছর প্রাপ্তি সহজলভ্য করবেন উদ্দেশ্য আছে ফসল বিজ্ঞানীদের। সেজন্য কাঁঠাল থেকে অনেকগুলো দারুণ খাদ্যপণ্য তৈরি করা হয়েছে।
তারা কারা?
বিখ্যাত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)’র বিজ্ঞানী। কৃষি বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। কাঁঠালের খাদ্যপণ্য আবিস্কারকরা প্রতিষ্ঠানটির শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিভাগের বিজ্ঞানী। প্রধান শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি গবেষণাগারের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. হাফিজুল হক খান। তার সঙ্গে বিভাগের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী। বারি হলো বহুবিধ ফসল গবেষণা প্রতিষ্ঠান, একমাত্র ও সবচেয়ে ভালো। মাটি, ফসল, শষ্য ব্যবস্থাপনা, রোগ-বালাই এবং পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা, পানি ও সেচ ব্যবস্থাপনা, কৃষি যন্ত্রপাতির উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক উৎপাদন নিয়ে কাজ আছে। তবে সব হারিয়ে যায় তাদের ফসল আবিষ্কারে। তবে এই বিজ্ঞানীরা নতুন আবিষ্কার করেছেন। দীর্ঘদিনের গবেষণায় তারা কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত করে মোট ১০টি প্যাকেট ও বোতলজাত পণ্য তৈরী করেছেন। কাঁঠালের জ্যাম, আচার, চাটনি, চিপস, কাটলেট, আইসক্রিম, দই, ভর্তা, আমস্বত্ব, রেডি টু কুক ফ্রেশকাট। বাজারে সাড়া পড়ে যাবে ভালোভাবে বেচতে পারলে আশা সবার। বারি আছে ঢাকার জয়দেবপুরে। স্বায়ত্বশাসিত ও বিখ্যাত এক কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এ দেশের কৃষকদের ভাগ্যন্নয়নে বারির অবদানের কোনো শেষ নেই। ধানের জাতই অনেক আবিষ্কার করেছে বারি। খেঁয়ে বেঁচে আছেন বাংলাদেশের মানুষরা। নিজেদের অনেক গর্বের কথা বলতে নারাজ, সুযোগও তেমন লাভ করেন না তারা। তবে এই খবরটি নিয়ে সামনে চলে এলেন। জানাতে গিয়ে গর্বিত হলেন খুব বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি রাকিবুল হাসান। তিনিও অধ্যাপক গবেষকদের মতো বারির নামকরা গবেষক, বিজ্ঞানী ও তাদের বড় ভাই, বোনদের ক্যাম্পাসে পেয়েছেন। দারুণ ও সফল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন সেদিন বিনার প্রধান ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম। বিনার নাম কৃষক, খামারি, কৃষিপ্রযুক্তি, পণ্য বিক্রেতা কম্পানি ও ভোক্তাদের জানা থাকলেও পুরো নামটি জানা?
বিনার বীন :
সবসময় মনে পড়ে না আড়ালে। সেটি হলো, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। আমাদের কৃষিজ পরমাণু বিজ্ঞানীদের আবিস্কারগুলো ও তাদের জন্য পরমাণু গবেষণা কাজে লাগানোর একমাত্র সরকারী প্রতিষ্ঠান। তারাও নতুন, আরো উৎপাদনশীল ফসলগুলোর প্রজাতি উদ্ভাবন করেন। ভূমি ও পানির উত্তম ব্যবস্থাপনা তৈরি কর্ম। পরমাণু বা ছোট, ছোট অনুগুলোকে কাজে লাগিয়ে ফসলের উৎপাদন বাড়ান তারা। ফসলের রোগ ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনাও গবেষণা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে তাদের অফিস। এখন ৮০ জন বিজ্ঞানী আছেন বাংলাদেশের একমাত্র এই পরমাণু নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানে। সবসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রী, অধ্যাপক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাহায্য লাভ করেন। অনেক কিছু জানতে পারেন। কাজ করতে পারেন তাদের সাহায্যে, তাদের নিয়ে। অবদান রাখতে পারেন বাংলাদেশের কৃষি, মাৎস্যখাতে। ১৩টি উপকেন্দ্র বা সাব-সেন্টার আছে বিনার।
বিনার প্রধান এলেন
বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম সেদিন ছিলেন তাদের সবার সঙ্গে। খুব খুশি হয়েছেন। বাংলাদেশের কাজ নিয়ে বলতে গিয়ে, বিজ্ঞানীদের অবদান জানাতে গিয়ে কৃষি ও সংশ্লিষ্ট খাতের এই প্রধানের বুক গর্বে ভরেছে। আলোচনায় বলেছেন প্রধান অতিথি, ‘এই আবিষ্কারে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। আমাদের আরেকটি সাফল্য হলো। ফলে বিনার হয়ে আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। বলব, বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষককে বানিজ্যিকীকরণ করতে হবে। কৃষক পর্যায়েও উদ্যেক্তা তৈরি করতে হবে। তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের গবেষণায় উদ্ভাবিত পণ্যগুলো মাঠে-ঘাটে, কৃষকের হাতে পৌঁছাতে হবে। উদ্যেক্তাদের ছড়িয়ে দিতে হবে প্রশিক্ষণে। আমাদের সবার আবিষ্কারগুলো বরাবরের মতো বাংলাদেশের মানুষের। এগুলোর মূল্য নিধারণ করতে হবে। ভোক্তাদের মাঝে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। বিভিন্ন কৃষিজদ্রব্য প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য আমাদের দেশেই উদ্ভাবন করতে হবে নতুন সব প্রযুক্তি। মাঠ পর্যায়ে কৃষক ও উদ্যেক্তা সবাই তাতে লাভবান হবেন। আমাদের কৃষিজ দ্রব্য পঁচে যাওয়া থেকে রক্ষা পাবে।’
শুনে সবাই খুব খুশি
তাদের আগ্রহ অনেক বেড়েছে। আবিস্কাররা কষ্টের ফল পেয়েছেন। আগামী দিনের বাংলাদেশের নব পণ্যগুলো তৈরি করতেও আগ্রহ তৈরি হয়েছে। জানানো হয়েছে, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) অর্থায়নে ও নিউ ভিশন সলিউশন্স লিমিটেডের সহযোগিতায় প্রকল্পটি পরিচালিত হয়েছে। সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনেছেন কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের সিনিয়র স্পেশালিস্ট (ফিল্ড ক্রপস) ড. নরেশচন্দ্র দেব বর্মার বক্তব্য। ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আবু হানিফ। নিউ ভিশন সলিউশন্সের মূখ্য পরিদর্শক তারেক রাফি ভূঁইয়া বারি, বিনা ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের সামনে আসতে পেরে খুব খুশি। তার সঙ্গে প্রকল্প ম্যানেজার কায়সার আলম। তারেক রাফি ভূঁইয়া হাসিমুখে জানিয়েছেন, ‘কাঠালের এই পণ্যগুলো নিয়ে আমরা বারির সঙ্গে চুক্তি করেছি। বারির সঙ্গে চুক্তির কথা বলতে গিয়ে আমার খুব ভালো লেগেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিনা এবং বাংলাদেশ মাৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের শহর ময়মনসিংহ। এখানে তো বটেই, আরোকটি জেলা এমনকী উপজেলাগুলোতে পণ্যগুলো বিপণনের কাজ করছি।’ বলতে, বলতে তিনি বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে গর্বিত হলেন, ‘এই অঞ্চলগুলোর ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরীর প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্পন্ন হয়েছে। বেশকজন সফলভাবে কাঁঠাল থেকে বিভিন্ন পণ্য তৈরী ও স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেছেন। ভোক্তাদের সুনাম লাভেও হয়েছেন।’
আবিষ্কারকদের কাহিনী
কাঁঠালের খাদ্যপণ্যের গবেষণার প্রধান গবেষক ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী বলেছেন, ‘এই প্রকল্পটির আওতায় আমরা কাঁঠালকে খাদ্যপণ্যে প্রথমবারের মতো প্রক্রিয়াজাত করেছি। মুখরোচক ১২টি প্যাকেট ও বোতলজাত পণ্য তৈরী করেছি। বারি বিভিন্ন ধরণে, প্যাকেটজাত পণ্য হিসেবে বাজারে বিক্রির উপযোগীও করেছে। প্রতিটি পণ্যই ঘরে রেখে প্রায় সারা বছর খাওয়া যাবে। কাঁঠাল থেকে তৈরি খাদ্যদ্রব্যগুলো উদ্ভাবনের মাধ্যমে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫শ কোটি টাকা কমানো সম্ভব।’ নিজের মনের ভাবও ব্যক্ত করেছেন তার শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি গবেষণাগারের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. হাফিজুল হক খান। তিনি ছিলেন আয়োজনের সভাপতি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রী, গবেষক ও অধ্যাপকরা এই অনুষ্ঠান থেকে অনেক কিছু জানতে এবং শিখতে পেরেছেন।
ওএস।