ছাগল-কবুতর-মাছের সমন্বিত ব্যবসায় মাসে লাভ লক্ষাধিক টাকা
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর, ইউনিয়নের ডুবারপাড়া এলাকায় ছাগল-কবুতর-মাছের সমন্বিত ব্যবসায় মাসে লাভ হচ্ছে লক্ষাধিক টাকা। আর ওই ব্যবসায় নিয়মিত কাজ করায় কর্মসংস্থানে হয়েছে শতাধিক মানুষের।
শিশির আহমেদ একজন সৌখিন খামারী। বর্তমানে খামারে রয়েছে ২১টি উন্নত জাতের ছাগল, ১৫০-২০০ জোড়া দেশি-বিদেশি কবুতর আর ১৮ বিঘা আয়তনের ২টি পুকুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মাছ পাঠাতে ৫টি ট্রাক। প্রতিদিন কাজ করে সংসার নির্বাহ করছেন ১শ শ্রমিক। এতে প্রতিদিন গড়ে ওই ব্যবসায়ীর লাভ হচ্ছে লক্ষাধিক টাকা।
সরেজমিনে ওই ব্যবসায়ীর বাড়ি গিয়ে দেখা মিলল তার ছাগল আর কবুতরের খামার। এছাড়া, বাড়িতে দেখা গেলো মাছ বহণকারী ট্রাক। নিজ ব্যাবসা পরিচালনার জন্য, বাড়ির একটি রুমে বসিয়েছেন অফিস। ক্ষণে ক্ষণে আসছে বিভিন্ন ক্রেতা, আসছে মাছ নিয়ে যাওয়ার শ্রমিকরা।
ব্যবসায়ী শিশির আহমেদ জানান, ২০১২ সালে বাংলাদেশ ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ কমপ্লিট করেন তিনি। এরপর চাকরির খোঁজ না করে মাছ ব্যবসা শুরু করেন। নিজ এলাকায় ৮০-৯০ বিঘার ১০-১২টি পুকুরে চাষ শুরু করেন বিভিন্ন জাতের মাছ। শুরুতে পুকুরে মাছ চাষ করে পায়কারদের কাছে বিক্রি করলেও ২০১৬ সালে তাঁর মাথায় আসে নতুন এক আইডিয়া। তিনি পুকুরের সংখ্যা কমিয়ে দেন আর ওই সময় কে কাজে লাগিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বড় বড় মাছ আরত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। এরপর এলাকার অন্যান্য ব্যবসায়ীদের পুকুর এবং নিজ পুকুরে চাষকৃত রুই, কাতলা, মৃগেলসহ দেশের চাহিদা রয়েছে এমন মাছ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহের কাজ শুরু করেন তিনি। আর এতেই আসে সফলতা। এখন প্রতিদিনই অর্ডার পান মাছ সরবরাহের। চাহিদামত মাছ স্থানীয় বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কিনেন সঙ্গে নিজের পুকুরের মাছ নিয়ে পাঁচটি ট্রাকে করে প্রতিদিন শ্রমিকদের সহায়তায় তিনি ওই মাছগুলো পাঠাচ্ছেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
দুই ছেলের জনক ওই ব্যবসায়ী জানালেন, তার ওই ব্যবসায়ীক কাজে একই ডিপার্টমেন্টে একই সঙ্গে পড়া সহধর্মিনী তাকে সার্বিক সহযোগিতা করেন। তিনি মূলত দেশের বিভিন্ন জেলায় মাছ সরবরাহ করা, বিভিন্ন জায়গা থেকে উন্নত জাতের কবুতর কেনা আর বিক্রি, উন্নত জাতের ছাগল কিনে পালন এবং বিক্রির কাজ করেন। আর ব্যবসায়িক সকল হিসাবসহ অন্যান্য সার্বিক কাজ তদারকি করেন তার সহধর্মিনী।
এক প্রশ্নের জবাবে শিশির আহমেদ জানান, তার ছাগলের খামারে ৬টি তোতা, তিনটি হরিয়ানা, ২টি বারবাড়ি এবং ৭টি ক্রসসহ মোট ২১ টি সৌখিন ছাগল রয়েছে।
গত দুই বছর থেকে তিনি ওই ছাগল পালন খামার সংযোজন করেছেন। তিনি ভারতের রাজস্থান থেকে ছাগলগুলো সংগ্রহ করেন। ৬ মাস পরপর ছাগলগুলো তিনটি বাচ্চা দেয়। ওই ছাগলের খামারে তার এ পর্যন্ত ৯-১০ লাখ টাকা ইনভেস্ট করা হয়েছে। যা থেকে বছরে গড়ে তার লাভ হচ্ছে অন্নত ৫ লাখ টাকা।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে শিশির জানান, ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় চারটি গলা কবুতর শখের বশে পালন শুরু করেন তিনি। বর্তমানে তার খামারে রয়েছে ১৫০-২০০ জোড়া উন্নত জাতের কবুতর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফ্রান্সের এক্সেকিউশন, মন্ডিয়াল, কালো কিং শকিং, লাহোরী, সিরাজী, কালো স্প্যান্ডেল হেনা, হলুদ হেনা, কবার লাক, ড্যানিশ ও কাল ভ্যানিশ, এন্ডেলিশিয়ান, বিউটি, লক্কা সহ ৪০-৫০ প্রজাতির কবুতর।
তিনি ইম্পোর্টার এর মাধ্যমে ইউরোপের ইতালিসহ বিভিন্ন দেশের কবুতর কিনেন। ওই কবুতরগুলো দেখাশোনার জন্য দুজন শ্রমিক সার্বক্ষণিক কাজ করে জানিয়ে তিনি বলেন, ওই কবুতর খামারে তার ১০- ১৫ লাখ টাকা ইনভেস্ট করেছেন তিনি। এতে প্রতিমাসে ওই কবুতর বিক্রি করে তার ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা লাভ হয়। তিনি আরো জানান, কবুতরের বাচ্চা ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা জোড়া এবং বড় কবুতর এক লাখ ২০ হাজার থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা জোড়া বিক্রি হয়। এছাড়া অ্যান্ডুলুশিয়ান এক্সিকিউশন জাতের কবুতর ২ লাখ টাকা জোড়া বিক্রি হয় যার বাচ্চা বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা জোড়া।
অপরাধ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, প্রায় ১০০ জন শ্রমিকের সমন্বয়ে নিজস্ব পাঁচটি ট্রাকে করে ঢাকা, দিনাজপুর, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় তিনি প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ লাখ টাকার মাছ পাঠান। এতে সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে মাসে তার লক্ষাধিক টাকা আয় হয়।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে শিশির আহমেদ জানান, প্রতিদিন তাকে ৮-১০ টন মাছ পাঠাতে হয় বিভিন্ন জেলায়।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি জানান, ভবিষ্যৎ তার ছাগলের খামার আরো সমৃদ্ধ ও বড় করা, কবুতরের খামারে আরো নতুন নতুন বিশ্ব চাহিদাসম্পন্ন কবুতর সংযোজন ছাড়াও মাছ ব্যাবসায় নতুন দিগন্তের সূচনা করতে চান। তিনি আরো জানান, তিনি তার মাছ বিদেশে রপ্তানি করতে চান। এক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ফ্রি মাছ চাষের পরিকল্পনা রয়েছে। কেননা বিদেশে, এন্টিবায়োটিক যুক্ত মাছ ছাড়া অন্য মাছ কেউ নেয় না।
তিনি দাবি করেন, আমাদের দেশের মাছের দামের তুলনায় বিদেশে একই মাছ অন্তত তিনগুণ দাম বেশি। সেক্ষেত্রে তিনি পৃথকভাবে একটি পুকুরে অ্যান্টিবায়োটিক ফ্রি মাছ চাষের চিন্তা করছেন। এটা করা গেলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি এন্টিবায়োটিক ফ্রি মাছ বিদেশে রপ্তানি করে দেশের সুনাম বয়ে আনার সাথে সাথে তার ব্যবসায় নতুন লাভের সূচনা করতে চান।
শিশিরের সহধর্মিনী শান্তা খাতুন জানান, তিনি ব্যাবসার যাবতীয় হিসাব রাখার পাশাপাশি খামার দেখাশোনাও করেন। সংসারের কাজের পাশাপাশি স্বামীকে ব্যাবসায় সহযোগীতা করতে পেরে তিনি খুশি।
স্বামীর ব্যবসা দেখাশোনা ও হিসাব নিকাশ করায় একদিকে যেমন ব্যবসার আয়-ব্যায় তিনি খেয়াল রাখতে পারছেন, তেমনি তিনি ওই কাজগুলো তদারকি করায় শিশিরও নিশ্চিন্ত থেকে ব্যবসায় পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারছেন। এতে তাদের উভয়েরই অংশিদারিত্ব সৃষ্টি হওয়ায় তারা দুজনেই খুশি। দুজনের এই অংশীদায়িত্বে দিন দিন তাদের উন্নতি হচ্ছে ব্যাবসায়।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা জানান, ওই খামার সম্পর্কে তিনি অবগত। শিক্ষিত যুবক তার স্ত্রীর সহায়তায় যেভাবে উন্নত জাতের কবুতর আর ছাগল এর খামার গড়ার পাশাপাশি মাছ সরবরাহের মাধ্যমে লাভবান হচ্ছেন একই সঙ্গে তাকে সহযোগীতা করে শত মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তা উদাহরণযোগ্য।
তবে এর সঙ্গে দেশের চাহিদার কথা বিবেচনা করে মাংস উৎপাদনের জন্য দেশীয় প্রজাতির ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতীয় ছাগল পালন আর দেশীয় কবুতর পালন ওই খামারে সংযোজন করা যায় কি-না তা বিবেচনার জন্য শিশিরকে আহ্বান জানান তিনি। শিশিরের পথ অবলম্বন করে বেকার যুবকরা যদি অনুরুপ খামার গড়ে তোলেন, তবে তাদের নিজেদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশেরও কল্যাণ হবে এমন দাবি করে এ কাজে এগিয়ে আসার, জন্য সকল যুব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।