১০ মিনিট পরীক্ষায় সময় বাড়লো, বাসে ৫টি সিট
হাবিবার মতো মেয়েরা চলাফেরা, চোখে দেখার রোগে আক্রান্ত। মেধা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের কষ্টগুলো দূর করতে পাশে এসেছেন স্যারেরা। ১০ মিনিট করে সময় বাড়বে, শ্রুতলেখক পাবেন। বাসে সিট পাঁচটি। দারুণ লিখেছেন ও ছবি দিয়েছেন মাহমুদুল হাসান
হাবিবা। বয়স বিশের একটু কম বা বেশি। জন্ম তার কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার একটি গ্রামে। জন্মগতভাবে দু পায়ে সমস্যা আছে। চলাফেরায় খুব অসুবিধা হয়। একা হাঁটতে গেলে পড়তে হয় বিপাকে। তাই সবসময়ই কারো না কারো সাহায্যের দরকার পড়ে। তবে মেয়েটি অসাধারণ মেধাবী। বাবা-মায়ের সাহায্যে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেছেন। স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে এসেছেন। খুব ভালো ফলও করেছেন। স্বপ্ন পূরণের তীব্র আকাঙ্খায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ’১৯-’২০ সেশনের ছাত্রী। তবে এখানে এসে অনেকটাই একা হয়ে পড়েছেন, বলেছেন মনের দুঃখে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এখনো লাভ করতে পারেননি। ফলে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জিং সময় পার করতে হচ্ছে, জানালেন হাবিবা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে ‘সুস্থ’, ‘স্বাভাবিক’ শিক্ষার্থীদেরই বিভিন্ন বাধা, বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। সেখানে একজন ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জন্ড শিক্ষার্থীর জন্য সমস্যাগুলো আরও প্রকট। তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে বিশেষ সুযোগ, সুবিধা দেওয়ার কথা ছিলো। বাস্তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাদে বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্র একেবারে ভিন্ন। পর্যাপ্ত সুবিধাই তারা পাচ্ছেন না। আলাদা কোনো সুযোগ সুবিধা তো দুরের কথা!
এ বিষয় নিয়ে হাবিবার সঙ্গে কথা বলতে গেলে বলেন,‘ স্কুল-কলেজে বাবা-মা সাহায্য করতেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হল থেকে আমার ডিপার্টমেন্টের দুরত্ব বেশি হয়ে গেছে। অনেক সময় রিক্সায় উঠতে অসুবিধা হয়, একা চলাফেরা করতে কষ্ট হয়। আমাদের ক্লাসগুলো অনেক সময় ওপর তালায় হয়। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আমার অসুবিধা হয়। একার না, আমার মতো যারা আছেন, সবারই এই সমস্যাগুলো হয়ে থাকে। প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জিং সময় পার করতে হয় আমাদের। কাজেই আমার দাবি থাকবে প্রশাসনের প্রতি-তারা যেন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪শর বেশি ছাত্র, ছাত্রী রয়েছেন, তারা কোনো না কোনোভাবে ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড। কারো পায়ের সমস্যা, কারোর হাতে, কারোর চোখে, কারো সর্ব অঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোতে কোনো র্যাম্পিংয়ে ব্যবস্থা না থাকায়, যাদের পায়ে সমস্যা, খুব কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। এরকম অনেক ‘হাবিবা’র সন্ধান মিলবে পুরো ক্যাম্পাসে।
তেমনই আরেকজন ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রোনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ’২০-’২১ সেশনের ছাত্র কাউসার আহমেদ। তার ডান হাতে সমস্যা। ফলে ভালোভাবে লিখতে পারেন না। অনেক সময় লেগে যায়। পরীক্ষার ফল খারাপ হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে কাউসারের চাওয়া, ‘আমার মতো ছাত্র, ছাত্রীদের জন্য যেন পরীক্ষায় অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ করা হয়।’
অন্য প্রধান বিশাববিদ্যালয়গুলোর মতো এই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করছে পিডিএফ (ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জন্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন) নামের বিশেষ সংগঠন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেল পরিস্থিতি আসলে কতটা খারাপের দিকে এগোচ্ছে। সেক্রেটারি শাকিল আহমেদ বলেন, ‘আমরা ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড শিক্ষার্থীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করি। প্রশাসন থেকে কিছু সহায়তা পাচ্ছি। তবে পর্যাঙপ্ত আর্থিক সহায়তা পাই না। আমাদের সংগঠন থেকেও তাদের পড়াশোনা কার্যক্রমে বিশেষ সহায়তা দিতে পারছি না। পর্যাপ্ত ডিভাইস না থাকায় যারা চোখে দেখতে পারেন না বা কানে শুনতে পারেন না, তাদের সবারও অনেক সমস্যা হচ্ছে। যাদের পায়ে সমস্যা তাদের জন্য যথেষ্ট হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করতে পারিনি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাম্পিংয়ের ব্যবস্থাও নেই। যারা পরীক্ষা দেয় তাদের জন্য অনেক সময় শ্রুতলেখক পাওয়া যায় না। এমনদের অনেকেই তাদের পর্যাপ্ত সুবিধাগুলো পাচ্ছেন না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট বাণিজ্যের প্রভাবও তাদের ওপর পড়ছে জানিয়ে শাকিল বলেন, ‘এ ধরনের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে অনেক সময় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হেনস্থারও শিকার হতে হয়। সহজে সিট পাওয়া যায় না। তারা লাভ করতে পারেন না। চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের।’
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক প্রফেসর ড. প্রদীপ কুমার পান্ডে বলেছেন, ‘প্রতিবন্ধীতায় আক্রান্ত ছেলেমেয়েরাও আমাদের সন্তানসম। এমন শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অ্যাকাডেমিক, প্রশাসনিক ও আবাসিক ভবনসহ অন্যান্য ভবনের মূল প্রবেশপথের সিঁড়ির একপাশে র্যাম্প প্রস্তুত করা হবে। আবাসিক ১৭টি হলের নিচতলায় ১ম বর্ষ থেকেই প্রতিবন্ধীতায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের আবাসন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিশ্চিত করা হবে। এখন থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীতায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সময় ঘণ্টা ন্যূনতম ১০ মিনিট বৃদ্ধি ও শ্রুতলেখক নিয়োগ সহজীকরণ করা হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্র, ছাত্রী বাসে পাঁচটি সিট তাদের জন্য জন্য আলাদাভাবে বরাদ্দ থাকবে।’ সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি গোলাম সাব্বির সাত্তারের সভাপতিত্বে সিন্ডিকেটের ৫শ ৯তম সভায় সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সাংবাদিকতা বিভাগের অন্যতম অধ্যাপক ড. পাণ্ডে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রতীকি ছবিটি আসিফ আহমেদ দিগন্তের কাছ থেকে নেওয়া।
ওএস।