নব্বই বয়সী বিনয় সাহা এখনও চা বিক্রি করেই চলেন

বিনয় চন্দ্র সাহা বয়স নব্বইয়ের বেশি। বয়সের ভারে ন্যুয্য। তবুও করতে হচ্ছে জীবন সংগ্রাম। এবয়সেও জীবন আর সংসার পরিচালনা করতে বিক্রি করেন চা। সিরাজগঞ্জ শহরের ঐতিহ্য ইলিয়ট ব্রিজের পূর্বপাশে ছোট একটা টং দোকান। এটাই বিনয়ের চায়ের দোকান।
বিনয় সাহা’র বাড়ি শহরে থেক কিছুটা দূরে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বনবাড়িয়া গ্রামে। তিন ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে অভাব অনটনের নিত্যদিনের সংসার। দারিদ্রতার কারণে ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করতে পারেননি। এর মাঝেই চা বিক্রি করেই জামাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে শশুর বাড়ি পাঠিয়েছেন দুই মেয়েকে। দুই ছেলে কায়িক শ্রমে মজুর খেটে যা আয় করেন, তা দিয়েই জোটে তাদের আহার। দুই ছেলেই আলাদা সংসারে পেতেছেন। তাদের আয়ের টাকায় বাবা বিনয়ের মুখে আহার তুলে দিতে এখনও কার্পণ্য করে না দুই ছেলে। কিন্তু স্বাধীনচেতা বিনয় এই নব্বই বছর বয়সেও নিজের আয়ের উপরই নির্ভর করে চলতে চান। চা বিক্রি করে যা আয় হয় তাতেই নিজের মত করে গোছান নিজের জীবন। ছেলেদের কাছ থেকে নিতে হয় না কোন টাকা।
বিনয় সাহা সেই পাকিস্তান আমল থেকে চা বিক্রি করেন। পাকিস্তানের শেষ সময়ে তার বয়স ছিল ৩০ বছর। তখন এখন প্রায় ৯০ বছরে উপরে। এই বয়সেও আধ বেলা দোকান চালিয়া চলে যান বাড়িতে ৷ বয়সের ভারে তার হাঁটাও এখন কষ্ট। তারপরেও হাল ছাড়িনি তিনি। প্রতিদিন বাড়ি আর টং দোকানে আসা যাওয়ায় খরচ হয় রিকসায় ৬০ টাকা। সকাল ৮টার দিকে দোকান খোলেন, চলে দুপুর ১২ থেকে ১টা পর্যন্ত।
এই আধবেলা থাকেন খুব যত্ন করে গড়ে তোলা পরম আদরের দোকানে। তার ব্যবসা জীবনের দীর্ঘ সময়ে টং দোকানের আশেপাশের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অনেকেরই ব্যবসার স্থান বদল হয়েছে। ব্যবসার ধরনও বদল হয়েছে। কিন্তু বদলায়নি বিনয় চন্দ্র সাহার ব্যবসার ধরন। বদলায়নি ব্যবসার স্থান। সেই যে পাকিস্তান আমলে চা বেচার কাজ শুরু করেছিলেন ইলিয়ট ব্রিজের পৃর্ব পাশে। এখনও রয়েছেন সেই স্থানে।
দিনে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা আয় হয় বিনয় চন্দ্রের দোকানে। দীর্ঘ সময়ে অনেক খরিদ্দারই বাধা হয়ে গেছেন তার দোকানের সাথে। শহরের আলোক সজ্জায় সাজিয়ে অনেক দোকান চালু হয়েছে। কিন্ত বিনয় চন্দ্র সেই পুরানো খরিদদাররা পরম যত্ন আর ভালোবাসায় সেসব রং বেরঙের দোকানে না গিয়ে আসেন তার দোকানে।
অবশ্য বিনয় সাহার খরিদ্দারদের বেশির ভাগই রিকসা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। শ্রেণি অবস্থানও এই ভালোলাগা আর ভালোবাসার হয়ত একটি মজবুত ভিত। যেকারণে দেখা যায় ক্রেতা রিকসা চালকরা চা পানের সাথে সাথে বিনয় চন্দ্রের সাথে জমিয়ে তোলে বাঙালির চিরন্তন আড্ডা।
এভাবেই চলছে বিনয় চন্দ্র সাহার রোজকার জীবন। তারপরও মনের মধ্যে কেমন যেন আকুলতা। মনের গহীনে তার প্রচণ্ড অভিমান। ছোট বেলায় তার বাবা-মা মারা যান। বড় হতে থাকেন কাকার কাছে। কাকার সাথে একটা সময় মনের মিল হয়না। চলার চেষ্টা করেন একা। অনেক কষ্টে তার দিন কেটেছে। শিশু বয়সে নিজের চেষ্টায় গড়ে তোলেন বিনয় চন্দ্র এই চায়ের দোকান।
ভাল ব্যবসা করতে চেয়ে ছিলেন, পারেননি টাকার অভাবে। চা বিক্রি করেই আজ অবধি চলছে তার জীবন। কিন্ত এ জীবনে পায়নি কারও সহযোগিতা। শেষ বয়সে পেয়েছেন বয়স্ক ভাতা। এখনও হয়নি ছোট্ট স্বপ্নের আবাসন। টাকার অভাবে হয়নি গড়া ছোট্ট বেলা থেকে মনের ভেতরে পুশিয়ে রাখা একটি মুদিখানা দোকানের মালিক হওয়া স্বপ্নটা।
এভাবেই বিনয়ের মত হাজারও বিনয়ের জীবনে সুর্য ওঠে আর অস্ত যায়। সে সুর্য প্রচণ্ডতা পায় না কখনও।
