কবিতার মেয়ে শারমিন

জেবুন নাহার শারমিন একজন বিখ্যাত আবৃত্তিকার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি মঞ্চের। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা এই সংগঠনের আজীবনের উপদেষ্টা। কী তার জীবন, কিভাবে আবৃত্তিতে এলেন, অর্জন, সাফল্য ও সংগ্রামের কাহিনী লিখেছেন জুনায়েদ খান
জন্ম তার কুমিল্লা জেলার লাঙ্গলকোট উপজেলার মনতলী গ্রামে। বাবা মোহাম্মদ ইউনুস। বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর অফিসার। অবসরে আছেন। তাতে তার ছেলে, মেয়েরা বেড়ে উঠেছে চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ছিমছাম, সুন্দর একটি কোয়ার্টারে। মেয়ের নাম তাদের জেবুন নাহার শারমিন। মা রাশিদা বেগম। তিনি ছেলেমেয়ে আর সংসার নিয়ে আছেন। তারা বড় পরিবার। তিন বোন, দুই ভাই। সবাই উচ্চশিক্ষিত। ভাইদের একজন নৌবাহিনী স্কুল ও কলেজের শিক্ষক, আরেকজন সিইপিজেড বা চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়জাতকরণ এলাকার একটি বহুজাতিক কম্পানিতে কর্মরত। দুজন বড় বোন-একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, অন্যজন সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী সমাজসেবা অফিসার। ৩৮তম বিসিএস।
সবার ছোট শারমিন। এই পরিবারের সর্বশেষ সন্তান। প্রত্যেকের খুব আদরের। বড় যত্নে মানুষ। শিশু বয়সে স্বপ্ন ছিল, একদিন অনেক বড় হব। হব মানুষের মতো মানুষ এক। কাজ করব মানবতার তরে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হব। ধীরে, ধীরে বড় হওয়ার সঙ্গে, সঙ্গে এই জীবনের স্বপ্নগুলোও বড় হতে থাকলো। ছোট থেকে অসাধারণ সুন্দর মেয়েটি পড়ালেখায় খুব ভালো। তারা পড়ালেখাকে খুব গুরুত্ব দেন। তিনি নৌবাহিনী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি। বরাবরের মেধাবী মেধাবী। পড়ালেখা করেছেন বিজ্ঞানে। পঞ্চমে অসুস্থতায় বৃত্তি পরীক্ষা দিতে পারেননি। নচেৎ পেয়ে যেতেন। সেই মেধার স্বাক্ষর রাখলেন অষ্টমে। লাভ করেছেন সরকারি বৃত্তি। গল্প করতে, করতে এই লেখক জুনায়েদ খানকে বলেছেন, “জানো, যখন আমি মাধ্যমিকের ছাত্রী, তখন বিটিভিতে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও তাদের পরিবারদের নিয়ে ‘অর্নিবাণ’ নামে একটি অনুষ্ঠান নিয়মিত হতো। এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান খুব জনপ্রিয় ছিল। সেখানে একটি দলীয় নৃত্যে অংশ নিয়েছিলাম। বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন। অনেক সিনিয়র, জুনিয়র তাকে মেয়ের প্রশংসা করেছেন। বাসায় অনেকদিন এই গল্প চলেছিল। সেই থেকে পরিবারের সাহায্য পেয়ে চলেছি। স্যার, ম্যাডামরাও তখন খুব উৎসাহ দিয়েছেন। সেই আমার পাথেয়, জীবনের অন্য গল্পের শুরু।’
শারমিন পড়েছেন বিভাগের সেরা, দেশের অন্যতম বিখ্যাত, অসাধারণ ছাত্র- ছাত্রী তৈরির কারিগর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি পরিসংখ্যানের ছাত্রী। ভর্তি হয়েছেন ২০১২ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে তার জীবনের মোড় ঘুরে গেল। জড়িয়ে গেলেন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অন্যতম সেরা একটি আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে। তারা ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি মঞ্চ’। ছোট থেকে তার কবিতার প্রতি ভালোবাসা আছে। ফলে ভর্তি হয়ে অনুষ্ঠান দেখে মঞ্চে যোগ দিতে কোনো ভুল হলো না। সেই থেকে আজ অবধি জড়িয়ে আছেন নিবিড়ভাবে। মঞ্চের প্রতিটি কাজে দারুণ সক্রিয় শারমিন, থাকেন সবার আগে। কোনোকিছুতেই তার না নেই। নিয়মিত অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ, ব্যবস্থাপনা, দক্ষ সংগঠক, উপস্থাপক ইত্যাদি ভূমিকাগুলোতে তিনি দারুণ কার্যকর।
জেবুন নাহার শারমিনের জীবনের অন্যতম অর্জন ২০১৬ সালে। অষ্টম কাউন্সিলে হয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক। মোটে চার বছরের মধ্যে সাধারণ সম্পাদক কীভাবে? ‘আমার নিজেরও ঘোরের মনে হয়। আমাদের স্বনামধন্য সংগঠনের এই পদে যাওয়া কোনো সহজ কাজ নয়। প্রত্যাশা না করেই মনোযোগ দিয়ে কাজ করে চলেছি, অনুষ্ঠানগুলো করেছি। তাই তারা আমার ওপর আস্থা রেখেছেন। সত্যি বলতে কী, পদের জন্য নিজের উন্নতির চেষ্টা করিনি কখনো। আবৃত্তি মঞ্চকে ভালোবেসে নিজের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় কাজ করার চেষ্টা করেছি বরাবর। তারই ফলাফল পেয়েছি।’ বিনয়ী মেয়েটি বলেছেন তারপর, ‘কত কাজ করেছি জানি না। তবে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ও দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাছুম আহমেদ স্যার ও মঞ্চের বড় আপু-ভাইয়ারা ভালোবেসে, আস্থা রেখে দায়িত্বটি দিয়েছেন।’ এই জীবনে একটি নাটকেও অভিনয় করেছেন তিনি। চট্টগ্রামেরই জনপ্রিয় পরিচালক শাখাওয়াত শিবলীর পরিচালনা। মনিবকতা ও ভালোবাসার গুণগুলো তাকে ক্যাম্পাস, চট্টগ্রাম শহর এবং আশেপাশের জেলাগুলো এমনকী কুমিল্লার জন্মভূমিতেও আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন, কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ প্রদান এবং অনুষ্ঠানগুলোর উপস্থাপকের কাজ এনে দিয়েছে। অনেক ভালোবাসা ও সম্মান লাভ করেছেন জীবনের বাঁকে। তিনি হয়েছেন প্রশিক্ষক, ভয়েস ওভার আর্টিস্ট, সংবাদ পাঠিকা।
জেবুন নাহার শারমিন জানিয়েছেন, তাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষালয়টির বয়স এখন ২২ বছর! শত, শত আবৃত্তিকর্মীর ভালোবাসায় গড়া। এখন ৩০ জনের বেশি নিয়মিত আবৃত্তিকার আছেন। মেয়েই ১৯ জন। তাদের পেছনে তার অবদান কম নয়। তিনি সবচেয়ে ভালো কর্মীদেরও একজন। শিক্ষকরা অত্যন্ত ভালোবাসেন। আবৃত্তির জন্য অনেক ত্যাগ আছে তার। আছে কত সাধনা। কেবল আবৃত্তি করেননি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে, হয়েছেন নিষ্ঠাবান শ্রমিক। অথচ তার বিভাগ পরিসংখ্যান। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েটিকে সবাই চেনেন, খুব ভালোবাসেন।
বিভাগেও শারমিন করেছেন আবৃত্তির অনেক অনুষ্ঠান, যেভাবে তারা আড্ডা, কর্মশালা, প্রশিক্ষণ ও বার্ষিক এবং নিয়মিত প্রতিযোগিতাগুলোর আয়োজন করে চলেছেন। বাংলাদেশের প্রায় সবকটি আবৃত্তি সংগঠনের নানা সময়ে, নিয়মিতভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি মঞ্চের সাহায্য ও সহযোগিতা লাভের রেকর্ড আছে।
নিজের পরিসংখ্যান বিভাগে ‘ইনডোর মেস অ্যান্ড কালচারাল কম্পিটিশন-২০১৬’ তে ‘কবিতা আবৃত্তি’তে ‘প্রথম’ পুরস্কার জিতেছেন তিনি। পরের বছর দ্বিতীয়। ফ্যাশন শোও করেছেন, জানালেন স্মার্টলি। হাসতে, হাসতে ভালো লাগায় বললেন, ‘পরিসংখ্যানের বেশকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আমার করা। অংশ নিয়েছি, যে কবার সময় করতে পেরেছি।’ শারমিনের আন্তরিকতা ও ত্যাগের প্রশংসা করেন সিনিয়র-জুনিয়র ও শিক্ষকেরা। আর তিনি বলেছেন, ‘আমার উদ্যোগের ফলে এখন বিভাগে ফি বছর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এর পেছনে সবার কিন্তু অনেক ত্যাগ ও ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। আমারও খুব মনে পড়ে সময়গুলো।’
শারমিন আবৃত্তির জন্য নানাজনের হাত ধরে, শিক্ষকদের ভালোবাসায়, বন্ধু ও সিনিয়র, জুনিয়রদের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম দাঁপিয়ে চলেছেন। ক্যাম্পাসের অতি পরিচিত মুখ হয়েছেন, তারকা খ্যাতি পেয়েছেন। নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে তার আবৃত্তি ও উপস্থাপনা নজর কেড়ে চলেছে। জেলা শিল্পকলা একাডেমি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), চট্টগ্রাম সনাক (সচেতন নাগরিক কমিটি), বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্র ও বিটিভির বিখ্যাত চট্টগ্রাম কেন্দ্রে নিয়মিত আবৃত্তি এবং উপস্থাপনা করছেন তিনি।
জেবুন নাহার শারমিন খুব সংস্কৃতিবান মানুষ। আবৃত্তির মতো স্বেচ্ছাসেবা উদ্যোগের পেছনে আছেন অনেক বছর ধরে। অনেকগুলো সংগঠনের নেপথ্যে ও সামনের সারিতে কাজ করছেন। ছিলেন কুমিল্লা জেলা শাখা স্টুডেন্টস অ্যাসেসিয়েশন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-সভাপতি, টিআইবির ইয়েস লিডার। আছেন বাংলাদেশ আবৃত্তিশিল্পী সংসদ ও সম্মিলিত আবৃত্তি জোট চট্টগ্রামে।
এবার তাদের প্রধান সংগঠনের গল্প। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবৃত্তি মঞ্চের শ্লোগান হলো ‘শ্বাশ্বত সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা।’ মঞ্চের ইতিহাসে অন্যতম সেরা মেয়েটিকে নিয়ে বলার খুব বেশি নেই। সারাক্ষণ তিনি তো তাদের নিয়ে আছেন। তবে বাহবা পাওয়ার কোনো আগ্রহ নেই। শারমিন বলেছেন, “আমাদের মঞ্চের ‘কবি ও কবিতা’ নিয়মিত আয়োজন। প্রতি মাসে দুটি আলোচনা ও কবিতা প্রশিক্ষণের আয়োজন করি এখানে। প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ বৃহস্পতিবার সভাটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ভবনের তৃতীয় তলায় হয়। আবৃত্তি মঞ্চের জন্য বরাদ্দ কক্ষ আছে।” প্রতিটি আলোচনা ও প্রশিক্ষণ সেশনে বাংলা ভাষার বরেণ্য একজন কবি ও তার জীবন এবং কবিতার ভুবনে বিচরণ করেন তারা। আবৃত্তির চর্চা চলে। মঞ্চের অন্যতম সংগঠক বলেছেন, ‘অনেক কিছু জানার আছে বলে সবাইকে নিয়মিতভাবে কর্মশালাটিতে অংশগ্রহণের অনুরোধ করছি আমি। ছাত্র, ছাত্রী তো এখানে আর কম নেই। সংগঠনের সুনাম তো আমাদেরই ধরে রাখতে হবে।’ নিয়মিত তারা ‘প্রমিত উচ্চারণ, উপস্থাপনা ও আবৃত্তি কর্মশালা’ করেন। তিনি অন্যতম প্রশিক্ষক। আয়োজনের গত কয়েকটি আবর্তনে জেবুন নাহার শারমিনকে ‘প্রশিক্ষক সম্মাননা’ দিয়ে আসছে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি মঞ্চ’। আগামী দিনের নতুন কর্মী, আবৃত্তিকার ও কবিদের জানিয়েছেন তিনি “মঞ্চের কাজ শুধু অনুষ্ঠান আয়োজন নয়। কবিতার আলোচনা ও রসাস্বাদন, কবিকে ভালোবাসা। তাদের মতো সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা। সেজন্য কাজ করে যাওয়া আজীবন। ফলে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি মঞ্চ’র প্রতিটি কাজ ভালোবেসে, খুব গুরুত্ব দিয়ে ও মনোযোগের সঙ্গে করে যেতে হবে। তাহলে একটি সুন্দর বিশ্বের জন্য আপনার ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে। আমাদের মঞ্চে সবাইকে স্বাগত।”
নতুনদের জন্য তাদের নামী এই সিনিয়রের উপদেশ, ‘আবৃত্তিকে ভালোবেসে এ ভুবনে আসতে হবে। বাংলাদেশের অনেক বরেণ্য আবৃত্তিকার জীবনে সাফল্য লাভ করেছেন আবৃত্তিতে। আসাদুজ্জামান নূর, রামেন্দু মজুমদার, আলী যাকের অনেক বড় উদাহরণ। তারা বিরাট সংগঠক, বাংলাদেশের নামী মানুষ। বিজ্ঞাপন, কর্মভুবনে প্রতিজনই সাফল্য লাভ করেছেন, নিজেদের চিরস্থায়ী করে রেখেছেন। তাই কেবল পড়ালেখা বা পরীক্ষায় প্রথম, দ্বিতীয় হবার ভাবনা ভেবে গেলে হবে না। অন্যান্য সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের মতোই আবৃত্তিকে নিজেকে উপস্থাপন এবং আপন ভাবনাগুলো তুলে ধরার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখতে হবে। গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর ক্ষেত্র আবৃত্তি ও কবিতার ভুবন।’
এখানে ফেলে আসা জীবনের দিকে তাকিয়ে জেবুন নাহার শারমিন বলেছেন, ‘কোনোকিছুই তো সহজে লাভ করা যায় না। বড় মানুষ এমনি, এমনি কেউ হননি। পরিশ্রম, সততা ও কাজের প্রতি ভালোবাসা মানুষকে বড় করে তৈরি করে।’ তবে তার দুঃখ, ‘দারুন সুন্দর, খুব নামকরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সংগঠন হলেও এখনো মঞ্চকে স্থায়ীভাবে রুমটি দেওয়া হয়নি। রুমটি অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করে চলেছি।’ ফলে ভিসি ম্যামের কাছে তার ছাত্রীর অনুরোধ, ‘আমাদের মঞ্চের নামে চাকসু ভবনের ৬ নম্বর রুমটি স্থায়ী বরাদ্দ করা হোক। অন্যান্য সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সমস্যাগুলোও দূর করে দেওয়া হোক।’
কথায়, কথায় শারমিনের অনেক বেলা গড়িয়েছে। কত কাহিনী জমা আছে তার জীবনের খাতায়। বললেন, ‘এমন দিনও গিয়েছে, টানা ১৫ ঘণ্টা বাইরে, বাইরে কাজ করতে হয়েছে। শহরে অনুষ্ঠান আয়োজন ও কাজগুলো করেছি। ক্লাসের পড়ালেখা ধরে রাখতে হয়েছে।’ জানালেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে দুদিনের মোট নয়টি কেন্দ্রীয় ও বর্ণাঢ্য আবৃত্তি উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে ছাত্র, ছাত্রী, শিক্ষক, নানা মানুষের সাহায্যে।’ ‘আবৃত্তিকারদের পাশে থাকেন বরাবর আবৃত্তির মানুষরা’, কথাটি গর্ব করে বলেছেন। তাদের অষ্টম উৎসবের শ্লোগান হলো, ‘জঙ্গীবাদের পিঠে কবিতার চাবুক’। তারা ‘নবম আবৃত্তি উৎসব’ করেছেন সর্বশেষ, টিএসসিতে। শ্লোগান ‘পতিত মানবতায় কবিতা আবাদ’। ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি মঞ্চ’ সম্মাননা লাভ করেছেন বাংলাদেশের বরেণ্য লেখক স্বাধীনতা পুরস্কার জয়ী সেলিনা হোসেন, অংশ নিয়েছেন নামকরা আবৃত্তিকার ও অভিনেতা, শিল্পকলা এবং নরেন বিশ্বাস পদকজয়ী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মুক্তিযোদ্ধা ও আবৃত্তিশিল্পী ডালিয়া আহমেদ। জয়ন্ত ও ডালিয়া কবিতায় মাতিয়ে দিয়েছেন চট্টগ্রামের ভুবন। সেলিনা হোসেনের কথার ভুবন অসাধারণ।
এরপর নিজের গল্প। জেবুন নাহার শারমিন বলেছেন, ‘আমি কবিতার পোকা, মানুষের সঙ্গ পেতেও ভালোবাসি। ভালো যেকোনো কাজের সঙ্গে থাকি। কবিতা হলে কথাই নেই। ভালো যেকোনো কবিতা আমার প্রিয়। ভালোবাসার এই ভুবন গড়া আছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, হেলাল হাফিজের কবিতায়। আধুনিক যেকোনো কবিতাও আমার আবৃত্তিকার, আবৃত্তিকর্মী হিসেবে আমার ভালো লাগে।’ যারা আবৃত্তিতে আসতে চান, তাদের জন্য শারমিনের পরামর্শ, ‘মন থেকে কবিতা ভালো লাগতে হবে, কবিতার প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে, তাহলে এ ভুবন মাত করা যাবে। অন্যসব শিল্পের মতো আবৃত্তিতে ভালো করতে বেশি, বেশি কবিতা পড়তে হবে। আত্মস্থ করতে হবে। তাহলে আবৃত্তিতেও সফল হওয়া যাবে।’ বলেছেন, ‘বাচিক শিল্পের মূল ভিত্তি আবৃত্তি। আয়ত্তে আনতে পারলে উপস্থাপনা, বিতর্ক ও বক্তৃতা, সংবাদপাঠ, অভিনয় সহজে রপ্ত করা যায়।’
নিজের নানা অর্জনের গল্প বরতে গিয়ে লাজুক হেসে দিলেন-‘নিজের কথা আর কী বলবো। তারপরও বলি, আমার বয়সে যখন সবাই প্রতিযোগিতাগুলোতে অংশ নিয়ে প্রাইজ পাচ্ছেন, তখন প্রতিযোগিতা আয়োজন করতেই ব্যস্ত ছিলাম। ফলে ওদিকে যাওয়া হয়নি। আবৃত্তির মাধ্যমে আমার প্রথম অর্জন হলো, আত্মবিশ্বাস লাভ। আমার ওপর মানুষের ভরসা, বিশ্বাস, আস্থাগুলোই অর্জন ও সাফল্য। আজ আমার কাজের ক্ষেত্র যতটা বিস্তৃত ও সফল, তার পুরোটাই আবৃত্তির কল্যাণে পাওয়া।’ এখন কী করছেন? বললেন, ‘কণ্ঠের কাজ ও আবৃত্তি, উপস্থাপনা আমার নেশা ও ভালোবাসা। পড়ালেখা শেষে বাচিক শিল্পকেই পেশা হিসেবে নিয়েছি। ধরাবাঁধা চাকরিতে আগ্রহ কম বলে ওসব, বিভিন্ন আয়োজন করা ও উপস্থাপনা, বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্র, বিটিভি চট্টগ্রাম, নানা ধরণের শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সমাজসেবা উদ্যোগে কাজ করে যাচ্ছি। বেতার চট্টগ্রামের তালিকাভুক্ত আবৃত্তিশিল্পী আমি।’ জেবুন নাহার শারমিন বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেটসহ বিভিন্ন জায়গায় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও কর্পোরেটদের অনুষ্ঠানগুলো উপস্থাপনা করি।’ আবৃত্তিশিল্পী, প্রশিক্ষক, উপস্থাপক, ভয়েস ওভার আর্টিস্ট, সংবাদ পাঠক, আবৃত্তি প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে তার সুনাম আছে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি মঞ্চের আজীবনের উপদেষ্টা। নজরুল একাডেমি চট্টগ্রামের আবৃত্তি বিভাগের প্রধান প্রশিক্ষক।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা? শারমিন নামের তরুণ মেয়েটির জীবনে অনেক স্বপ্ন। অনেক দূর যাবেন। আরো বড় পরিসরে কাজ করবেন। কবিতা, কথোপকথন নিয়ে কাজ করতে চান তিনি। নিজের অ্যালবাম করার আগ্রহ আছে। যদিও এখন ফেইসবুক, ইউটিউবে আবৃত্তির দর্শক বেশি বলে সে পথে হাঁটছেন। তার ফেসবুক পেইজে আবৃত্তি কর্মকান্ড শেয়ার করেন। বলেছেন, ‘আমি আবৃত্তি, প্রশিক্ষণ, উপস্থাপনা, সংবাদ পাঠ, নেপথ্যে কণ্ঠদান-এই কাজগুলোতে থাকার চেষ্টা করছি, যেহেতু প্যাশনকে প্রফেশন বানানোতেই বেশি বিশ্বাসী। পরিবার ও সময়ের প্রয়োজনে চাকরিতে যেতে পারি।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দাপিয়ে বেড়ানো জেবুন নাহার শারমিন বলেছেন ‘আমাদের পরিবারটি বেশ ধর্মভীরু, তবে গোঁড়া নয়। আমার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সবসময় তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি বললে ভুল হবে। প্রতিদিন নিজেকে মানসিকভাবে শক্ত রেখে আজ এতদূর এসেছি। তবে কৃতজ্ঞতা জানাই তাদের, সবসময় না হলেও মাঝে, মাঝে আমার সিদ্ধান্তে সহযোগিতা করেন। তাই অনেক।’
প্রিয় ছাত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি মঞ্চের প্রধান উপদেষ্টা ও দর্শনের সহযোগী অধ্যাপক মাছুম আহমেদ বলেছেন, ‘আবৃত্তির পাশাপাশি মঞ্চের কাজগুলোতে আমাদের শারমিনের সাংগঠনিক ভূমিকা চমৎকার। অত্যন্ত চটপটে মেয়ে। আবৃত্তির প্রতি তার খুব খুব অঙ্গীকার আছে। নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে অনেক বছর ধরে। আমাদের সব আয়োজনে থাকে। আমরা তো জানি, যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেকোনো আয়োজনে এমনকী প্রগতিশীল আন্দোলনগুলোতে কবিতা দারুণ ভূমিকা পালন করে। এমন ভালোবাসায় আমি তাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ ও ভালোবাসা প্রকাশ করছি।’
এখন জেবুন নাহার শারমিনের অনলাইন ব্যাচ আছে ছোট ও বড়দের, যেখানে কর্মশালাগুলো করেন। নিয়মিত আবৃত্তি চর্চার সুযোগও রেখেছেন আগ্রহীদের অনুরোধে। চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যানের আয়োজনে, অক্সিজেন স্কুল ও কলেজে, প্রমিতি সাংস্কৃতিক একাডেমিতে, ‘কবিতা’ ফেসবুক পেইজের আয়োজনে, স্বামী আনোয়ার শাকিলের বগুড়া জেলা শহরে, রোটারি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে উপস্থাপনা, আবৃত্তি, উচ্চারণ, কবিতা পাঠের প্রশিক্ষণ দেন। ফেইসবুকে ছবি আছে তার বাংলাদেশের বিখ্যাত শিল্পপতি নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল মাতলুব আহমদের সঙ্গেও।
আবৃত্তি, উপস্থাপনা, বক্তৃতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন আয়োজনে গিয়েছেন। মাইজভান্ডারী একাডেমি, কণিকা- একটি রক্তদাতা সংগঠনের কাজে অংশ নিয়েছেন। কখনো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি মঞ্চের হয়ে, কখনো একক আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজারে কাজ করেছেন। ২০১৮ সালের ৪ ও ৫ মে ‘উচ্চারক আবৃত্তি কুঞ্জ চট্টগ্রাম’র ১৫ বছর পূর্তি উৎসবে ‘সম্মাননা স্মারক’ লাভ করেছেন। 'পলাশ ছোঁয়া শব্দবানের খোঁজে' শিরোনামে প্রতি বছর শ্রাবণী সেন শাওনের স্মরণে তারা আয়োজন করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একক আবৃত্তি প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতাটির বিষয় সাধারণত বাংলাদেশ (ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ, প্রকৃতি ও দেশপ্রেম)। ২০১৯ সালের ৯ আগষ্ট তারা করেছেন ‘আবৃত্তির জানালা পর্ব-২ ও ‘অভিষেক অনুষ্ঠান’। আয়োজনটির উপস্থাপক এবং অন্যতম আবৃত্তিকার ছিলেন। হয়েছে চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির আর্ট গ্যালারিতে। আয়োজক ‘একুশ (মানবিকতা ও আবৃত্তি চচা কেন্দ্র)’। ২০১৯ সালের ২১ ও ২২ নভেম্বর পুর্ণমিলনী অনুষ্ঠান করেছেন 'চিটাগং ইউনিভার্সিটি এলামনাই এসোসিয়েশন’র । আবৃত্তি করেছেন এবং ছিলেন আয়োজক-প্রচারণা ও প্রকাশনা সেল। সেবারের ১৬ই ডিসেম্বর পালনে কাজ করেছেন আবৃত্তি মঞ্চে সবসময়ের মতো। ২০২০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ‘চিটাগাং ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন’র আয়োজনে অন্যতম ছাত্রী উপস্থাপক ও আবৃত্তিকার হিসেবে যোগ দিয়েছেন। নানা ধরণের সচেতনতা কার্যক্রমেও নিয়মিত অংশ নিয়েছেন জেবুন নাহার শারমিন টিআইবি, সনাকসহ নানা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। প্রতিবছর আবৃত্তি করছেন ‘চট্টগ্রাম : কবিতার শহর’ অনুষ্ঠানে। তাদের উৎসবটি হয় জেলা শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে। আয়োজন করে ‘তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, বাচিক শিল্পচর্চা কেন্দ্র’। ‘বোধন আবৃত্তি পরিষদ, চট্টগ্রাম’র তারা ৩৪ বছর পূর্তি করেছেন। ভারতের বিপ্লব নন্দীর সঙ্গে একক আবৃত্তি সন্ধ্যা করেছেন জেবুন নাহার শারমিন ‘এসো বসি বিতানে’। টিএসসিতে একজন নামী শিল্পীর একক গানের অনুষ্ঠানে করেছেন উপস্থাপনা। রাঙামাটিতে দ্বিতীয় শুদ্ধ উচ্চারণ কর্মশালা আয়োজিত হয়েছে ‘এসো শুদ্ধ স্বরে বলি রক্তে জেতা ভাষা’ শিরোনামে। প্রশিক্ষক হিসেবে গিয়েছেন। সবসময়ের মতো আন্তরিক সহযোগিতা করায় তাকে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ডিবেট ফেডারেশন শুভেচ্ছা স্মারক’ দিয়েছে। ‘বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী স্মরণ' অনুষ্ঠানে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আবৃত্তি করেছেন। এমন অসংখ্য অনুষ্ঠান শারমিনের পদচারণায় মুখর ছিল। মেয়েটি দেখতেও খুব সুন্দর। দারুণ ভালো, অতি মিশুক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের টানা ১০ বছরের সঙ্গী। তাদের বিজ্ঞাপন, বিশ্ববিদ্যালয়কে চেনারও অন্যতম উপায় হয়ে আছেন। মিষ্টি, চঞ্চল, অমায়িক।
ওএস।
