অক্সফোর্ড মিশনারিদের গীর্জার গল্প

বরিশালে আছে এই এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম গীর্জা। মোটে একতলা তবে আজকের পাঁচতলার সমান। বেথেলহেম থেকে সংগ্রহ করা একটি ক্রুশ আছে। আছে স্কুল, অনাথালয় ও চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রসহ অনেক কিছু। দেখে এসে লিখেছেন ও ছবি তুলেছেন ইমরুল কায়েস
ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রী মিশনারীরা তাদের মা-বাবা, ভাই-বোন, সহপাঠী, শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ সবার দানে পরিচালনা করেন দাতব্য কর্মগুলো। তাদের গীর্জাগুলোর নাম অক্সফোড মিশন চার্চ। তারা ১৬ শতকে ব্রিটেনের খৃষ্ট ধর্মীয় বিপ্লবের অনুসারী একটি উপদল। ব্রিটিশ রীতিতে ২০০১ সালের হিসেবে বিশ্বের মোট ১শ ১০ কোটি মানুষ ধর্ম পালন করেন। বাংলাদেশ ও ভারতে তাদের কার্যক্রম আছে। বরিশাল শহরের বগুড়া রোডের ধারে অক্সফোর্ড মিশন চার্চ। চার্চ মানে গীর্জা। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়। গীর্জাটি এদেশের সবচেয়ে সুন্দর প্রার্থনাকেন্দ্র। ধর্মপ্রাণ খৃস্টানদের ১২টি গুরুত্বপূর্ণ দিবসের অন্যতম ১২ জানুয়ারি। বোধদয় দিবস হিসেবেও খ্যাত ‘এপিফানি’। এই দিবসগুলোকে ঘিরে যে গীর্জাগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলো আলাদা নামে পরিচিত। এটি যেমন এপিফানিক গীর্জা বা এপিফানি গীর্জা। বরিশালের মানুষ ‘লাল গীর্জা’ নামেও চেনেন। পুরোটাই লাল রঙে ঢাকা। ব্রিটেনের ‘দি অক্সফোর্ড মিশন’ এই বছর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদের ১৪০তম বার্ষিকী উদযাপন করছে। বরিশালে তাদের ১২৫তম আর খৃষ্ট সেবিকা সংঘের ৫০ বছর। ভারতের কলকাতার কাছের বেহালা এলাকাতে তাদের সেন্ট জোসেফ প্রাইমারি স্কুলে ছেলেদের আনাথালয় আছে। একটি চোখের হাসপাতাল, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। তাদের বিদ্যালয়গুলো ইংরেজি মাধ্যম। বরিশালে তারা বোর্ডিং স্কুল, খৃস্টান ছাত্রদের ছাত্রাবাস, সেন্ট অ্যান’স মেডিক্যাল সেন্টার, এতিমখানা ও প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা করেন। ১৯৭০ সালে স্বাধীনতার আগের বছর বরিশালের জোবারপুর গ্রামে মিশন সেবিকা সংঘটি প্রতিষ্ঠা করেন। খৃস্টান সেবিকা সংঘ পরিচালনা ও তত্বাবধান করে ছেলে ও মেয়েদের হোস্টেল এবং ছোট শিশুদের একটি খেলাকেন্দ্র।
দেখতে দারুণ অক্সফোর্ড মিশন চার্চ। এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে। নকশাকার মাদার এডিথ নামে পরিচিত এডিথ ল্যাংরিজ। মোট ৯৫ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। একজন মিশনারি বসতি স্থাপন কর্মী। ব্রিটিশ ভারতে কাজ করেছেন। তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রথম সুপিরিয়র হিসেবে কাজ করেছেন সিস্টারহুড অব এপিফানিতে। জন্মেছিলেন লন্ডনের মার্লেবোর্নে। ১৮৬৪ সালে। এডিথ কুইন্স কলেজে পড়ালেখা করেছেন। সেখানে গণিতে তিনি সবার সেরা হয়েছেন। এরপর যখর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লেডি মার্গারেট হল নামের কলেজে ভর্তি হলেন, বলে ফেললেন, এখন আর গণিত পড়তে আমার ভালো লাগে না। ফলে ছয় সপ্তাহের কেবল মুখস্ত করতে হবে এমন একটি কোর্স নিলেন লাতিন, যাতে এই ভাষার ক্লাসিকগুলো পড়তে পারেন। তিনি একটি শিক্ষাবৃত্তিতে পুরস্কৃত হয়েছিলেন এবং ১৯৮৫ সাল থেকে লাতিন ভাষায় পড়ালেখা শুরু করলেন। ১৮৮৮ সালে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে অনার্স পাশ করলেন। চাকরি করেছেন সহকারী ওয়ার্ডেন হিসেবে। ছিলেন লেডি মার্গারেট হলের ছাত্রী হোস্টেলের তত্বাবধায়ক। তবে তিনি একজন মিশনারী বা সেবিকা হতে চেয়েছিলেন। সিস্টার এডিথ ল্যাংরিজকে বরিশালের এপিফানির প্রধান নির্বাচন করা হলো। তাদের সবাইকে বরিশাল আকর্ষণ করেছিল নানা কারণে। ফলে এখানে এপিফানি ব্রাদারহুড তৈরি হলো ১৮৯৫ সালে। আজও তার অনিন্দ্য স্থাপনাটির বুকে লেখা আছে-স্থপতি মাদার এডিথ ল্যাংরিজ। এই ব্রাদারহুডের প্রধান ফাদার ই.এল, স্টং নিমার্ণ কাজ ও সমাপ্তি দেখাশোনা করেছেন, যাতে নিঁখুত হয়, সেই তত্বাবধান করেছেন। সম্পন্ন করে দিয়েছেন ১৯০৭ সালে। প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন ফ্রেডরিক ডগলাস। মোট ৩৫ একর জমির ওপর তৈরি এই গীর্জা এলাকার ভেতরে আছে চারদিকে বড় দালান ও পাম গাছের সারি। এত সুন্দর ও বৈশিষ্ট্যময় গীজা আর চোখে পড়ে না এখানে। পূর্ব থেকে পশ্চিমে কাঠামোটি। নীচ থেকে ওপরে ৪২ মিটার আর চওড়ায় ২২ মিটার। গীর্জার ভেতরে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে ঘন্টাঘর। পরে তৈরি তবে আসলের অনুসরণে। পশ্চিম দিকে আলাদা একটি ছাদ ঢাকা করিডোর বানানো হয়েছে পরে জীবনের নিরাপত্তার জন্য। এখনো সুদৃশ্য ও দৃঢ় নিয়মিত যত্নে। খালি চোখে গীর্জার কোনো বদল ঘটেনি মিশনারী ফাদার, ব্রাদার ও সিস্টারদের ভালোবাসায়। তারা জানিয়েছেন, অক্সফোড মিশন চার্চের সব নিমার্ণ উপকরণই বাংলাদেশ থেকে নেওয়া। মাটি কেটে সেগুলোকে পুড়িয়ে লাল শক্ত মাটি এর ইট। কাঠ, সিমেন্ট, রডও এখানে পাওয়া। নিমার্ণ করেছেন এই দেশের মানুষরাই। ভেতরে চারটি বেদী আছে। সেগুলোর মার্বেল পাথরগুলো ভারত থেকে মিশনারিদের মাধ্যমে আনা। মোট ৪০টি খিলানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে অক্সফোড মিশন চার্চ। ১৯৬০, ১৯৭০ ও পরের ঘূর্ণিঝড়গুলোতেও উপকূলীয় এই নদীময় বিভাগে গীর্জাটির তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।
ভেতরে ঢুকলে সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোড়া মাঠ, ১৩টি পুকুর, অক্সফোর্ড মিশন প্রাইমারি ও হাই স্কুল, হাসপাতাল, গ্রন্থাগার, ছাত্র-ছাত্রী হোস্টেল, ফুল ও ঔষধি গাছের বাগান আছে। মূল গীর্জার ভেতরে বিশাল প্রার্থনা গৃহ আছে। আজও সবার মন টানে প্রবলভাবে বিশাল ও নান্দিক বলে। এটি বিরাট। প্রায় ৫০ ফিট। তিন দিকে দরজা। চারদিক থেকে বারান্দা ও বেরুনোর পথ। ছাদে কাঠ আছে নিয়মানুসারে। ফ্লোরটি টাইলস ও কাঠে মোড়া। জেরুসালেমের বেথেলহেমে প্রভু যীশুর জন্মস্থান থেকে সংগ্রহ করা বিরাট একটি ক্রুশ এখানে গীর্জার প্রধান আকর্ষণ। শান্ত-সিগ্ধ যাজক, যাজিকাদের এই ভুবন সারি, সারি পাম গাছের ছায়ায়। বিরাট এক দীঘির পাশে ফাদারস হাউস। তার জলে প্রতিবিম্ব হয়। আছে মাদারস হাউস। অক্সফোর্ড মিশনারিদের গীর্জার প্রার্থনার ঘন্টাটিই এশিয়ার সবচেয়ে বড় ঘন্টা। প্রতিদিন সাতবার বাজে। ঘণ্টার নিচেই চার্চের ছোট্ট অফিস। অক্সফোর্ড মিশনকে সাহায্য করতে ও জানতে-http://www.oxford-mission.org/home/index.html.
ওএস।
