পুলকিত হতে থাকে প্রাণ
আমাদের ক্যাম্পাসটিকে অনেকে চেনেন। গণ বিশ্ববিদ্যালয়। আছে ঢাকার সাভারে। একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। বংশী নদীর তীরের, মোট ৩২ একরের বিরাট ক্যাম্পাস। যখন সূর্যের বিদায় বেলা ঘনিয়ে আসতে থাকে, ইফতার তৈরির কোলাহল বেড়ে যায় আমাদের। ভীড় জমাতে থাকে দুষ্টু, ভদ্র আর প্রিয় বন্ধুগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের বিরাট মাঠে একে, একে আসতে শুরু করেন সম্মানিত শিক্ষকরা। আপনা থেকেই সবার পুলকিত হতে থাকে প্রাণ। কিছুক্ষণ পর আজান হবে। আমরা সারাদিনের রোজা শেষে ইফতার করতে পারবো।
এই মাঠের চারপাশে উলু ফুলগুলো দুলতে থাকে বাতাসে। জ্বলজ্বল করে জ্বলে তারা। মৃদু বাতাসে দোল খেতে থাকে। ততক্ষণে সৌন্দর্য আরো বাড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষকের ইফতারের আয়োজন চলে। বিরাট মাঠটিতে ব্যাচ, বিভাগ, বন্ধু, অনুষদ, সহকর্মী এভাবে ভাগে, ভাগে বসতে থাকে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব ছেলেমেয়েরা মাঠের মধ্যে গোল হয়ে বসতে থাকেন। একটি প্রাণ, একটি বিশ্ববিদ্যালয়, একদল মানুষ এভাবে আমাদের ইফতার সম্পন্ন হয়। কোনো জাদুকরের বিস্ময়কর কোনো ভালোবাসার ভুবন যেন এটি।
সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। কেউ ছোলা, কেউ মুড়ি আবার কেউ পেয়াজু কিনে এনেছেন। কেউ ব্যস্ত প্লেট সাজাতে। আবার কেউ প্লেটে, প্লেটে তুলে দিচ্ছেন পরম মমতায়। কারো ব্যস্ততা ফল কাটায়, কেউ খাবার পানি গ্লাসে, গ্লাসে ঢেলে দিচ্ছেন। এভাবেই ইফতারকে বরণ করে নেন বরাবর আমাদের সকলে। সামাজিক ভেদাভেদ তখন আর থাকে না। ভালো, খারাপ ছাত্রের মন খারাপটুকু আর নেই। খোশ মেজাজের মানুষগুলো আলাপে মত্ত হয়ে ওঠেন। এই আবেশে শিক্ষক ও ছাত্রের দূরত্ব কাটে। নানা ধরণের ঝামেলার অবসান ঘটে। বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলো গাঢ়তর হয়।
নিজের পরিবারগুলোকে ফেলে অনেক দূরের ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার বেদনায় উপশম নিয়ে আসে আমাদের এই দিনগুলো। আমাদের তো হল নেই। নেই কোনো ক্যাফেটোরিয়া। তবে আছে এই বিশাল সবুজ মাঠ। ফলে এটিই সবেধন নীলমণি। আমাদের সঙ্গে আশেপাশের মানুষরা কখনো আসেন, প্রায়ই এখানে সেখানে বিচ্ছিন্নভাবে তাদের দলগুলোকে আমরা ইফতার করতে দেখি। অনেকে আমাদের পরিচিত। যেহেতু সারাক্ষণ থাকি এখানে। এই আয়োজনে আরো আলাপ হয়। আমরা গল্পে মাতি। সহযোগিতায় নিজের খাবার এগিয়ে দেই তাদের পাতে।
এই মুহূর্তগুলোই আমাদের মনে করিয়ে দেয়-ছাত্র, ছাত্রীরাই ক্যাম্পাসগুলোর প্রাণ। আশপাশের ছাত্রেরা যে এসেছে তখন আমাদের দলে। এই নিয়ে বলেছেন আইনের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র সাজ্জাদ হোসেন সোহাগ, ‘পরিবারের বাইরে এখানে আসার আগে কোনোদিন ইফতার করিনি। এভাবে এত দারুণ করে সবাই মিলে ইফতারের আয়োজন আসলেই অন্যরকম।’ এরপর জানালেন, ‘আমাদের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরের প্রথম সেমিস্টার তো অনলাইনে রুমে বন্দী হয়ে কেটেছে। পড়ালেখার জন্য বিভাগে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পারিনি। এই দ্বিতীয় সেমিস্টারের পাঁচটি মাস হলো। এখনো সেভাবে কারো সঙ্গে পরিচিত হয়ে পারিনি। তবে এই আয়োজন আমাকে দারুণ সুযোগ করে দিলো। অনেকের সঙ্গে মেলামেশা, আলাপ-পরিচয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে ইফতারে এসে আমরা সবাই পরিচিত। সবাই আমার আপন।’
করোনাভাইরাসের আক্রমণে দুটি বছর কেড়েছে জীবন থেকে। ফলে বেদনার গল্পও কম নেই। অনেককিছু মিস হয়েছে। ফলে ইফতারের এই অন্যরকমের, অনন্য আয়োজন সবাইকে আবার মিলিয়ে দিয়েছে। শেষ বর্ষের শেষ সেমিস্টারে পড়েন যারা, তারা ক্যাম্পাস জীবনের এমন ইফতার, এই বন্ধন ও ভালোবাসাগুলোকে বহুকাল মিস করবেন।
ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদের ফাতেমা আক্তার মণিকা বলেছেন, ‘আমার জীবনের সময় খুব দ্রুত বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। এভাবে আর কোনোদিন ইফতার করা হবে না। সত্যিই মিস করবো সবাইকে।’ বলাই হলো না, ছেলেমেয়ের ভেদাভেদ এই সময়ে আর থাকে না। ছাত্রী, শিক্ষিকা অবলীলায় সবার সঙ্গে, সাবাই মিলে ইফতার করেন। আমাদের জীবনের নিস্তব্ধ ক্ষণগুলোতে এমন মুহূর্তরা আসবে বারবার ভালোবেসে।
ওএস।