নওগাঁর টুপি যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে
নওগাঁর মহাদেবপুরের গ্রামে গ্রামে গৃহস্থালী কাজের ফাঁকে নারীদের হাতে সুই-সুতা ও কাপড়। কারও হাতে সাদা রংয়ের কাপড়। সুইয়ের ফোঁড়ে নান্দনিক নকশা ফুটে উঠছে একেকটা কাপড়ে। বিশেষ কায়দায় সেলাই ও ভাঁজ করে এই কাপড় দিয়ে বানানো হচ্ছে টুপি। এই টুপি যাবে মধ্যপ্রাচ্যের ওমানসহ বিভিন্ন দেশে। টুপি তৈরি করে স্বাবলম্বী হওয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে নারীরা।
জানা যায়, উপজেলার ভালাইন, মধুবন, কুঞ্জবন, খাজুর, রনাইল, খোসালপুর, সুলতানপুর, উত্তরগ্রাম শিবগঞ্জ, গোয়ালবাড়ি এবং তাতারপুরসহ অন্তত ৫০ থেকে ৬০টি গ্রামে বিভিন্ন বয়সী নারী বিশেষ ধরনের এসব টুপি তৈরি করছেন।
ঐ অঞ্চলের নারীদের হাতে তৈরি এসব টুপি ওমান ছাড়াও পাকিস্তান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, কাতার, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। মানভেদে একেকটি টুপি দেড় থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়ও বিক্রি হয়।
রমজান আর ঈদুল ফিতরকে ঘিরে টুপি তৈরির কারিগররা পার করছেন এখন ব্যস্ত সময়। সাদা কাপড়ে তাদের সুইয়ের ফোঁড়ে ফুটে উঠছে নান্দনিক নকশা। পরে বিশেষ কায়দায় সেলাই ও ভাঁজে এই কাপড়ই হয়ে যাচ্ছে টুপি।
বোতাম, চেন, দানা ও মাছকাটা নামে চার ধরনের টুপি সেলাই করা হয়। কয়েক হাত বদলের পর একটি পূর্ণাঙ্গ টুপি তৈরি হয়। টুপির মধ্যে বেশি সময় ও পরিশ্রম হয় দানা সেলাইয়ে। টুপি ব্যবসায়ীরা টুপি তৈরির সব উপকরণ কারিগরদের সরবরাহ করেন।
মানভেদে একেকটি টুপিতে নকশা তুলতে ২০-২৫ টাকা আবার কোনো টুপিতে নকশা করতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয় কারিগরদের। এতে টুপিতে নকশা তৈরির কাজ একজন নারী কারিগরের মাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা আয় হয়। টুপিতে নকশা তোলার কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেক নারী। অভাবের সংসারে ফিরেছে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য।
প্রায় একযুগ আগে জেলার মহাদেবপুর উপজেলায় টুপি ব্যবসা শুরু করেছিলেন ফেনীর একদল ব্যবসায়ী। পরে প্রশিক্ষণ দিয়ে টুপি সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন তারা। এসব টুপির কারিগর মূলত নারীরা। টুপিগুলো তৈরির পর ঢাকার চকবাজার, বাইতুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেটে পাঠানো হয়। সেখানকার ব্যবসায়ীরাই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এগুলো রপ্তানি করে থাকেন।
উপজেলার টুপি ব্যবসায়ী মাজহারুল ইসলাম জানিয়েছেন, প্রায় ১০ বছর ধরে এই এলাকায় বিদেশি টুপি তৈরির কাজ শুরু হয়। আগে শুধু ‘কুপিয়া’ টুপি এখানে তৈরি হতো। এটি ওমানের জাতীয় টুপি। এখন পাকিস্তান, সৌদিআরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, কাতার, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচের বিভিন্ন দেশে এখানকার তৈরি টুপি যাচ্ছে। এসব টুপি ঢাকার চকবাজার, বাইতুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেটে পাঠানো হয়। সেখানকার ব্যবসায়ীরা আবার মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এসব টুপি রপ্তানি করেন। কাপড় ও নকশাভেদে এসব টুপি ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হয়।
এদিকে যে দেশের জাতীয় টুপি বানানো হচ্ছে সেই ওমান দেশটি কোথায় তা ঠিকভাবে জানেনও না অনেক নারী কারিগররা।
উপজেলার খোসালপুর গ্রামের রাবেয়া খাতুন জানিয়েছেন, প্রতিটি টুপি তৈরি থেকে ২০ থেকে ২৫ টাকা করে পেয়ে থাকেন তিনি। দশ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে মহাদেবপুর সদরের খোসালপুর এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করেন। এখানে এসে এক বছর পর এক প্রতিবেশির উৎসাহে শুরু করেন টুপিতে নকশা তোলার কাজ। স্বামী ও নিজের আয় দিয়ে এখন সংসার চলছে স্বাচ্ছন্দ্যে। নিজেদের উপার্জিত টাকা দিয়ে তিন শতক জমি কিনে তাতে ইটের বাড়িও তুলেছেন।
রনাইল গ্রামের শামিমা আক্তার বলেন, স্বামী দিন মজুরের কাজ করে। তার একার আয় দিয়ে আগে টেনেটুনে কষ্ট করে সংসার চলত। অনেক সময় আধপেটা করে খেয়ে থাকতে হত। তবে গত চার-পাঁচ বছর টুপিতে নকশা তোলার কাজ শুরু করে এখন সংসার ভালোই চলছে। বাড়িতে হাঁস-মুরগি, ছাগল ও গরু পালন করছে তারা। এক মেয়ে ও ছেলে লেখাপড়া করে। কলেজে পড়ুয়া মেয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি মায়ের সঙ্গে টুপিতে নকশা তোলার কাজ করে।
মহাদেবপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিজানুর রহমান বলেন, মহাদেবপুরের নারীরা টুপি তৈরি করে স্বাবলম্বী হওয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। তাদের প্রচেষ্টার কোনো তুলনা হয় না। এসব কারিগররা যাতে সঠিক মজুরি পান এবং কোনো ধরণের হয়রানির শিকান না হন সেজন্য প্রশাসন তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে আসছে। এই সব কারিগরদের আরও উন্নত প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।