বয়স ২২ হলেও মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সংকট প্রবল
মাওলানা ভাসানীর নামে তার টাঙ্গাইলের সন্তোষে আছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ‘মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’। ১৯৯৯ সালে তৈরি হলেও এখনো আবাসনের তীব্র সমস্যা পোহাতে হয় ছাত্র, ছাত্রীদের। তারা পড়ালেখা করতে পারেন না। বাড়ি থেকে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা করে এনে চলেন। অথচ প্রায় সবাই নিম্মমধ্যবিত্ত ও নিম্মবিত্তের সন্তান। ক্যাম্পাসটি ঘুরে, উপাচার্য ও অধ্যাপকদের সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন ঢাকাপ্রকাশ ২৪.কমের প্রতিনিধি ও ছাত্র রাসেল চৌধুরী
মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নামে তার টাঙ্গাইলের সন্তোষে একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির। ‘মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’। ২২ বছর পরেও ছাত্র, ছাত্রীদের আবাসের সংকট কাটাতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি। এখন এই নামকরা ক্যাম্পাসে পড়ালেখা করছেন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ছাত্র, ছাত্রী। ক্যাম্পাস ঘুরে জানা গিয়েছে, তাদের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত ও নিম্মমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। মেধা ও যোগ্যতায় ভর্তি হয়েছেন এখানে। তবে এই অভাবী ছেলেমেয়েরা বলেছেন, প্রথম বর্ষ থেকে তাদের থাকা, খাওয়ার চরম সংকট থাকে। পাঁচ বছর পর পাশ করে ফেললেও আবেদন করা হলের সিট পান না। মেয়েদের সংকট আরো তীব্র। তাদের বাবা, মাও চরম উদ্বিগ্নতায় ভোগেন, মেয়ে কোথায় থাকে? কীভাবে থাকে? নিরাপদে থাকে তো? তার কোনো অসুবিধা হয় না তো? এই অভাব ও অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রায় সব ছাত্রীর মা-বাবার, তাদের নিজেদের। ছেলেদের জন্য মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে তিনটি ও মেয়েদের জন্য আছে দুটি হল। তবে সেগুলোতে সিটের সংখ্যা খুব কম রেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ছাত্র, ছাত্রী বেড়েছে এখানে, সিট সেভাবে বাড়েনি। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার চোখেই পড়ছে অনেক বছর ধরে, আবাসনের দারুণ অভাব।
বেশিরভাগ ছাত্র, ছাত্রীই সন্তোষ, কাগমারি, পাল পাড়া, বেবিটেক্সি স্ট্যান্ড, শান্তিকুঞ্জ মোড় ও শহরে মেস এবং বাসা ভাড়া নিয়ে কয়েকজন মিলে থাকছেন বিশ্ববিদ্যালয় চালু হওয়ার পর থেকে। এই বাসাগুলোর এবং তাদের সিটগুলোর ভাড়া অনেক বেশি। এক কথায় মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রীদের সরকারী ফিতে হলে থাকা হয় না, সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও। এমন নয় যে তাদের জায়গার অভাব আছে বা সরকারের বরাদ্দ আনা যায় না। বেশি টাকা খরচ করে থাকতে গিয়ে, খেতে হচ্ছে বলে তারা মা-বাবার গালাগাল শোনেন, খারাপ পরিবেশে থাকেন। লেখাপড়ার মান ভালো হয় না। ভবিষ্যত অন্ধকার থাকে। খরচ মেটাতে গিয়ে অনেকে টিউশনি করেন বলে পড়ালেখার মান ভালো হয় না। তাদের এখানে টিউশনি তেমন নেই, কম টাকা পান। কিন্ত চলতে তো হবে?
কদিন আগেই ভর্তি হলেন ২০২০-’২১ শিক্ষাবর্ষের নতুন ছাত্র, ছাত্রীরা। এই দিনই তাদের অভিভাবকরা জেনে গিয়েছেন, এখানে বিশ্ববিদালয় থাকলেও আবাসনের তীব্র অভাব আছে। শায়লা খানম নামের একজন ছাত্রীর সঙ্গে আসা অভিভাবক বলেছেন, ‘আমরা এই ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট হয়েছি। তবে মেয়েকে বাইরে রাখতে হলে এই পরিবেশের কী দাম? হোস্টেলে বা মেসে থাকলে সে কী খাবে? কীভাবে থাকবে? লেখাপড়ার পরিবেশ পাবে? ভালো ফলাফল ও মানুষ হয়ে বেরুতে পারবে?’
এই বিষয়ে অনেক সিনিয়র ও জুনিয়র ছাত্র, ছাত্রীর সঙ্গে আলাপ করেছেন এই প্রতিবেদক রাসেল চৌধুরী। তারা বলেছেন, ‘আমাদের অনেকের পরিবার খুব গরিব। ফলে দ্রুত আমাদের জন্য হলের ব্যবস্থা করতে হবে।’ প্রথম বর্ষের ছাত্র মোহাম্মদ মামুন জানিয়েছেন, ‘আমরা এখানে নতুন পরিবেশে ভর্তি হয়েছি, চারপাশের অপরিচিতদের ভালোভাবে চিনিও না। আমাদের কারো কোনো আত্মীয়, পরিজন এখানে থাকেন না। টাঙ্গাইলে টিউশনি বা অন্য কোনো কাজের সুযোগ ছাত্র, ছাত্রীদের জন্য নেই। যারা টিউশনি করেন অনেকটা জোর করে নেন। ফলে বাসা থেকে আমাকে মাসে, মাসে এতগুলো টাকা কীভাবে দেবেন এই দু:শ্চিন্তায় পড়ালেখায় মন বসে না। দ্রুত হলে সিট পেলে ভালোভাবে পড়ালেখা করতে পারবো। কী করবো বুঝতেও পারছি না।’
তার ঠিক চার বছরের সিনিয়র প্রান্ত রায়। চতুথ বর্ষের এই ছাত্রটি বলেছেন, ‘আমি তো এখনো হলে উঠতে পারিনি। ওরা কীভাবে পারবে? প্রতিটি মাসে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা করে প্রথম বর্ষ থেকে দিয়ে চলেছি থাকা ও খাওয়ার জন্য। এত টাকা যোগাড় করতে খুব কষ্ট হয়।’ তিনি জানলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এখানেও হলে থাকতে মাসে ১৫শ টাকা লাগে। হলে থাকতে ও দুই বেলা-দুপুর এবং রাতের খাবার খেতে তাদের খরচ সামান্য হয়। তিনি বলেছেন, হলে প্রতিদিনের খাবার খরচ ৫০ টাকা। ফলে গড়ে ৫ হাজার টাকা বাঁচবে সিট পেলে। এই আশায় তিনি এখনো পড়ালেখা প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও সিটের জন্য হণ্যে হয়ে ঘুরছেন।
তাদের সবার খুব মন খারাপ হয়, পরিবারের হাল ধরতে এগিয়ে না এসে বা সামান্য টাকা মা-বাবার হাতে তুলে দিতে না পেরে টাকা চেয়ে আনতে হয়। টাকার জন্য মা, বাবার সঙ্গে ঝগড়া করতে হয়। এই সমস্যাগুলো জানার পরেও শিক্ষকরা কেন সমাধানে নামছেন না? মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সিমন মিয়া বলেছেন, ‘এখনো আমরা প্রথম বর্ষে আবেদনের পর এখনো তিন বছরে সিট পাইনি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী সুবিধার ছিঁটেফোটাও লাভ করতে পারি না। আমার মতো এমন শত, শত ছাত্র, ছাত্রী আছেন। শিক্ষকরা আমাদের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে বলেন। কীভাবে উঠবো? আমরা আবাসন সমস্যার সমাধান অনেক বছর ধরে চেয়ে আসছি। কিন্তু হচ্ছে না। কেন?’
শিক্ষকরা জানিয়েছেন, একটি ভর্তি হওয়া সেশনের ছাত্র-ছাত্রীরা পাশ করে না যাওয়া পর্যন্ত মানে অন্তত পাঁচ বছর আগে আবাসনের সংকট কাটাতে পারবেন না। এই বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের প্রভোস্ট এবং হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেছেন, ‘আসলে আমাদের হলগুলোর সবগুলো মিলিয়ে পর্যাপ্ত আবাসনের ব্যবস্থা নেই। সিট নেই বলে ছেলে, মেয়েরা হলে থাকতে পারে না। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ আমরা সব অধ্যাপকরা হলের সংকট কাটানোর জন্য কাজ করে চলেছি। আগামী পাঁচ থেকে সাত বছর পর মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কোনো সিটের সংকট থাকবে না। সব ছাত্র, ছাত্রী হলে সিট পাবে। তাতে নতুন ছাত্র, ছাত্রীরা র্যাগিংয়ের শিকার হবে না। কোনো অপসংস্কৃতির চচাও থাকবে না।’ তিনি আরো জানালেন, ‘হলে থাকার ব্যবস্থা করতে পারলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। রোধ করতে পারবে।’
অধ্যাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলামের কাছ থেকে জানা গেল, হলে থাকতে না পেরে ছাত্র, ছাত্রীরা অপসংস্কৃতির শিকার হচ্ছেন। তাদের মধ্যে বাজে র্যাগিংয়ের চর্চা চলছে। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন তৈরি হচ্ছে শেখ রাসেল হল। এই হলের প্রভোষ্ট হিসেবে এর মধ্যে দায়িত্ব পেয়েছেন ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ইশতিয়াক আহমেদ তালুকদার। স্যার বলেছেন, ‘আগামী মাসের শেষ দিন মানে ৩০ মে, ২০২২ তারিখে আমাদের হলটির কাজ শেষ হবে। ফলে অন্তত ছয়শ ছেলে থাকতে পারবে। তাতেও আমাদের আবাসন সমস্যার কিছুটা লাঘব হবে। তাদের জীবনগুলো বদলে যাবে।’ তিনি জানিয়েছেন, ‘আমরা নবাগতদের এবং জুনিয়রদের আবাসনের ব্যবস্থা এখানে করব। তারাও যেন সিট পায়, সেটি আমি গুরুত্ব দিয়ে দেখবো। অন্তত ৩০ জনকে আবাসনের সুবিধায় এনে আমি হলের কাজ শুরু করবো।’
আরেকটি হল তৈরি হচ্ছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল। এই প্রতিবেদক হলটি ঘুরে দেখেছেন। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় হল হচ্ছে এটি। হলটিও এই বছরের মাঝামাঝিতে তৈরি হয়ে যাবে, জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। তারা বলেছেন, এখানে অন্তত ১ হাজার ছাত্রীর থাকার ব্যবস্থা হবে। ফলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আবাসিক সংকটের অনেকটা দূর হবে।
নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সংকট নিয়ে ছাত্র ও সাংবাদিক রাসেল চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছেন ভিসি স্যার। অধ্যাপক ড. মো. ফরহাদ হোসেন বলেছেন, ‘২০২২ সালের জুনের মধ্যে আমাদের শেখ রাসেল ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের কাজ আমি শেষ করব বলে কাজ করছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান সংকটও আছে। তারপরও আমি আরো দুটি হল তৈরি করতে কাজ করবো।’ তারা জানিয়েছেন, ‘এর ফলে আগামী এক কী দুই বছরের মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সংকটের তীব্রতা কাটবে, ভালোভাবে থাকতে পারবে ছাত্র, ছাত্রীরা। তারা থাকলে শিক্ষকদেরও থাকার ব্যবস্থা হবে প্রভোস্ট, হাউজ টিউটর হিসেবে। তখন ছাত্র, ছাত্রীদের প্রায় সবাইকে আবাসনের সুবিধা প্রদান করা যাবে। প্রশাসন কাজ করে চলেছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিবেশ, ছাত্রছাত্রীদের জীবনের মান বাড়বে। তাদের কম দামে ভালো খাবারের ব্যবস্থাও করতে পারবেন শিক্ষকরা। তাদের পড়ালেখা ও ফলাফল অনেক ভালো হবে।’
ওএস।