আর বাজবে না তার ড্রাম...
বিশ্বকে বদলে দেওয়া, সর্বকালের সেরাদের অন্যতম ড্রামার টেইলর হকিন্স আর নেই। তিনি মার্কিন রক ব্যান্ড দি ফো ফাইটার্সের ড্রামার ছিলেন। খুব ভালো গাইতেন। তার জীবনের গল্প...
টেইলর হকিন্সের পুরো নাম অলিভার টেইলর হকিন্স। ১৯৭২ সালে জন্মেছেন আমেরিকার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ফোর্ট ওর্থে। বেড়ে উঠেছেন ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লাগুনা বিচে। ক্যালিফোনিয়ার অরেঞ্জ কাউন্টির একটি ছোট্ট শহরে, সাগরের ধারে। ছোটবেলায় দক্ষিণ ক্যালিফোনিয়ান একটি ছোট ব্যান্ড সিলভিয়াতে গান ও বাজানো শুরু করেন। এরপর ড্রামারের বিখ্যাত ক্যারিয়ারটি শুরু করেন। প্রথম কাজ করেছেন কানাডিয়ান গায়ক স্যাস জর্ডানের ড্রামার হিসেবে। তারপর চলে আসেন ‘দি এলানেস মোরিস্যাট’ ব্যান্ড দলে। ১৯৯০’র দশকের মাঝামাঝিতে গিয়ে টানা দুটি বছর ড্রামার হিসেবে বাজালেন, গাইলেন টেইলর হকিন্স। তারপর ‘দি ফো ফাইটাস’-এ।
তার ড্রাম বাজানোর ভালোবাসা তৈরি হয়েছে ও অনুকরণ করতেন ছোটবেলায় জেইন’স অ্যাডিকশন নামের মার্কিন রক ব্যান্ডের ড্রামার স্টিফেন পারকিনসকে। তিনি এখনো বেঁচে আছেন। গুরুর কথা বলেছেন টেইলর হকিন্স এভাবে-‘আমার ড্রামগুলো তার মতো করে বসাতাম। পুরো কাজকর্মের সবই তার মতো ছিল। এখনো তার অনুকরণ সেভাবে করি। নিজের স্টাইল আমার বাজানো ও গানে আছে। তবে তার মতো করে শব্দ বানাই না। আমি আমার মতো করে শব্দ করি। তবে আমার জন্য তিনি বিরাট বড় একজন অনুপ্রেরণা।’
২০১৯ সালে এপিকে হকিন্স বলেছেন, তার ড্রামিং জীবনের শুরু দিকে আরো অনুপ্রেরণা ছিলেন ‘দি পুলিশ’ ব্যান্ডের ড্রামার স্টুয়ার্ট কোপল্যান্ড, ‘কুইন’র রজার টেইলর ও ফিলিপ কলিন্স। ফিলিপ কলিন্স ‘দি জেনেসিস’ ব্যান্ডের ড্রামার। তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি আমার সবসময়ের প্রিয় ড্রামারদের একজন। আপনি জানেন, তিনি যে একজন বিখ্যাত ড্রমার ছিলেন লোকেরা তা ভুলে গিয়েছে এবং সেই সঙ্গে এও ভুলেছে, সোয়েটার পরা একজন ভালো মানুষ ছিলেন।’
১৯৯৭ সালে তিনি চলে এলেন মার্কিন রক ব্যান্ড ‘দি ফো ফাইটার্স’-এ। ১৯৯৪ সালে দলটি প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠাতা ডেইভ গ্রোল। এর আগে মার্কিন ব্যান্ডদল নির্ভানাতে, ড্রামার ছিলেন। তিনি একজন বিশ্বখ্যাত গায়ক, নিজের প্রজন্মের সেরা ড্রামারদের অন্যতম। তার নির্ভানা দলের প্রধান ও লিড সিঙ্গার কার্ট কোবেনের আত্মহত্যার পর দলটি ভেঙে গেল। এরপর নতুন দল ‘দি ফো ফাইটার্স’ গড়ে তোলেন। তিনি প্রধান ভোকালদের, গিটারবাদককে তার নতুন দলে নিয়ে নিলেন। তিন বছর পর ১৯৯৭ সালে হকিন্স যোগ দিলেন।
তার ও গ্রলের একটি শোতে শোর পেছনের অংশে আলাপ। গ্রলের নতুন ব্যান্ড দলটি তখন কদিনের মধ্যে একটি নতুন কাজ শুরু করবে। তাদের ড্রামার উইলিয়াম গোল্ডস্মিথ দল ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তাকে দলে আসতে অনুরোধ করলেন প্রধান। এর আগে থেকেই হকিন্স ফো ফাইটার্সের খুব ভক্ত। দ্রুতই এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। ‘দি এলানেস মোরিস্যাট’ ব্যান্ড দল থেকে ট্যুরগুলোর ড্রামার হিসেবে দলে আসলেন।
তিনি ১৯৯৭ সালে ‘দি কালার অ্যান্ড দি শেপ’ নামের অ্যালবামটি তৈরি করার কদিন পরে যোগ দিলেন। তাদের আলাপ সম্পর্কে টেইলর হকিন্স বলেছেন, ‘এই কথা বলতে আমার ভয় লাগছে না যে, আমাদের দুজনকে বদলে দেওয়া সেই প্রথম সাক্ষাৎটি প্রথম দর্শনে ভালোবাসার মতো ছিল। আমরা গানের ও সুরের জোড়া যারা এখনো জ্বলে চলছে।’ তার সম্পর্কে নিজের ‘দি স্টেরিটেলার’ বইতে গ্রল লিখেছেন, ‘এরপর থেকে আমরা থামানো যায় না একটি জোড়াতে পরিণত হয়ে গেলাম। যেকোনো ধরণের সাধনা ও অভিযানে আমরা নিজেদের খুঁজে পাই।’
১৯৯৭ সালে এসে টেইলর হকিন্স দলের সবচেয়ে বিখ্যাত গান ‘এভারলং’র ভিডিওতে কাজ করলেন। তবে গানটি রিলিজের সময়ও দলে যোগদানের জন্য অপেক্ষা করছেন। আরো কিছু কাজ বাকি। এরপর থেকে টানা দুটি দশক তিনি তাদের সঙ্গে বাজিয়ে চলেছেন। এখানে তিনি তার ভীতিকর ও চমকপ্রদ কাজ করেছেন। এমন একটি দলের ড্রামার ছিলেন, যেটি রক ব্যান্ডের ইতিহাসে সর্বকালের সবচেয়ে ভালো ড্রামারদের তৈরি একটি দল। তারা সবচেয়ে ভালো বাজানো মানুষদের অন্যতম। তিনি বলেছেন, ‘প্রথমে আমি সামান্য ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তবে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি।’
২০১৪ সালে অ্যান্ডারসন কুপারের সঙ্গে ৬০ মিনিট নামের একটি সাক্ষাৎকারে গ্রল বলেছেন তার ব্যান্ডে হকিন্সের প্রভাব নিয়ে, ‘আপনার দলে যখন টেইলর হকিন্সের মতো একজন ড্রামার থাকবেন, আমরা কেউই কোনো অপরিহার্য কারণ বাদে তাকে হারাবো না। কেননা আমার দলে আছেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ড্রামার। সে আমার চেয়েও টেকনিক্যালি উন্নত মানসিকতার।’ সেই একই সাক্ষাৎকারে টেইলর বলেছেন এই ব্যান্ডে তাকে জায়গা করে নিতে তার কিছু সময় লেগেছে। তবে দলের প্রধান ও বিখ্যাত ড্রামার তার জন্য জায়গাটিকে কোনোদিনও কঠিন করে তোলেননি।
তিনি তার সুরে প্রথম ভালোবাসা ব্রিটিশ ব্যান্ড দি কুইনের প্রতি আবেগের কথাও জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমি রজার টেইলর হতে চেয়েছিলাম ও যেতে চেয়েছিলাম কুইনে। তাদের একজন হতে চেয়েছি আমি টেইলর হকিন্স।’ নিজের সম্পর্কে বলেছেন, ‘১০ বছর বয়স থেকে আমি স্টেডিয়ামগুলোতে ড্রাম বাজাচ্ছি।’
তাদের ব্যান্ডদল দি ফো ফাইটাস রক অ্যান্ড রোল হল অব ফেমে ২০২১ সালে জায়গা পেয়েছে। আগের বছর তাদের নির্বাচিত হবার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘যেকোনো সময়ে বা মূহূর্তে, যেকোনো ক্ষণে আপনি কোনোকিছু যোগ করতে গিয়ে নার্ভাস হয়ে যেতে পারেন। তবে কেউই ডেইভ গ্রলের চেয়ে ভালো বাজাতে পারেন না। এই দর্শনটি তার নিজের হাতের মধ্যে আছে।’ দুজন একত্রে কাজ করেছেন তাদের ব্যান্ডের কনসার্টগুলো। তখন হকিন্স ভোকাল হিসেবে ব্যান্ডে গেয়েছেন। ভক্তরা তার মৃত্যুর খবর প্রদানের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কুইনের ‘সামবডি টু লাভ’ গানটি গাইছেন-ভিডিও ক্লিপ সংযুক্ত করেছেন।
তিনি রোগাক্রান্ত ছিলেন। ২০০১ সালে লন্ডন সফরের সময়ে টেইলর হকিন্স হেরোইন মাত্রাতিরিক্ত খেয়ে দুটি সপ্তাহ কোমাতে ছিলেন। এই নিয়ে ২০১৮ সালে বলেছেন, ‘আমার জীবনকে পরিবতন করে দেওয়া একটি আসল মূহুর্ত ছিল।’ তার মৃত্যুতে কলম্বিয়ার মার্কিন দূতাবাস শোক প্রকাশ করেছে। তাদের আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেছেন এই ড্রামারের পরিবার, বন্ধু ও ভক্তদের জন্য।
এই ব্যান্ড দলে প্রতিষ্ঠাতা ও সামনের সারির প্রথম ব্যক্তি ডেইভ গ্রলের পর ফো ফাইটার্সের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন তিনি। গ্রলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারগুলো প্রদান করতেন। ব্যান্ডের ভিডিওগুলোতে খুব ভালোভাবে তার কাজ ও অংশগ্রহণ আছে। দলের সম্প্রতি প্রকাশিত ভৌতিক-কৌতুকের ছবি ‘স্টুডিও ৬৬৬’-এ অংশ নিয়েছেন। তিনি তাদের ব্যান্ডের সবচেয়ে ভালো অ্যালবাম ‘ওয়ান বাই ওয়ান’, ‘অন ইউর অনার’-এ কাজ করেছেন। তার একক গানগুলোর মধ্যে আছে ‘মাই হিরো’ ও ‘বেস্ট অব ইউ’। দলে শুরু থেকে একশর বেশি কনসার্টে তার অনন্যতা, অতিমানবের মতো পারফরমেন্সগুলো দেখিয়েছেন তিনি।
তাদের লাইভ শোগুলোতে অনেকবার গ্রলকে ড্রামের পেছনে চলে যেতে দেখা গিয়েছে ও তখন নিজের প্রিয়, কুইনের অ্যালবামের শিরোনাম ‘সামবডি টু লাভ’ গানটি গেয়ে শ্রোতা, দশর্কদের মাত করেছেন টেইলর হকিন্স। চিলিতে ২০২১ সালের ১৮ মার্চ এই গানের আগে বলেছেন, ‘দি ফো ফাইটার্সের লিড সিঙ্গার হবার সবচেয়ে ভালো সুযোগটি আসে এই একটি গানে, যেটি গাই আমি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ড্রামার।’ তার গলায় গানটি বিশ্বজুড়ে নন্দিত হয়েছে।
তিনি সহ-প্রকল্প হিসেবে ‘হকিন্স অ্যান্ড দি কোয়াটাইল রাইডাস’-এ কাজ করেছেন। এই ব্যান্ডে ২০০৬ সালে তারা ‘গেট দি মানি’ নামের একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন।
দলের প্রধান গ্রল তার ‘দি স্টেরিটেলার’ নামের বইতে হকিন্সকে আরেক মায়ের ঘরে জন্ম নেওয়া তার ‘ভাই’ বলে উল্লেখ করেছেন। আরো লিখেছেন, ‘আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, সে এমন একজন মানুষ যার জন্য আমি বুলেট খেতে রাজি।’ তার মৃত্যুর পর দলের প্রধান জানিয়েছেন, ‘আমার একজন প্রিয় শয্যাসঙ্গীর মৃত্যুর হলো।’
তার স্ত্রী অ্যালিসন ও তিনটি সন্তান বেঁচে আছে। তিনি ২০০৫ সালে বিয়ে করেছেন। তাদের কিশোর সন্তানেরা বেঁচে আছে। তাদের নাম হলো অলিভারে শেইন হকিন্স, এভারলি হকিন্স ও এনাবেল হকিন্স। তারা ক্যালিফোর্নিার হিডেন হিলসে বাস করতেন।
তিনি ২০০৫ সালে তার দীর্ঘদিনের এই বান্ধবীকে বিয়ে করেন। স্ত্রী তার ব্যক্তিগত জীবনে কেবল বিরাট ভূমিকা পালন করেননি, তাকে একজন রক স্টার হিসেবে বিকশিত হতে অবদান রেখেছেন। তবে একটি সাক্ষাৎকারে এই গায়ক হিসেবে নাম কামানো তারকা ড্রামার বলেছেন, কোনোদিন বিয়ে করবেন বলে ভাবেননি তিনি এবং মোটে ২৫ বছর বয়সেই তার সন্তান থাকবে কল্পনাতে ছিল না। অলিভার তাদের ছেলে, বাকিরা মেয়ে। একটি বড় শহরের ধারের বাড়িতে বাবা ও স্বামী হিসেবে তার জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি তার ‘গেট দি মানি’ নামের অ্যালবামটি প্রকাশ করেছেন। একটি গান আছে ‘মিডল চাইল্ড’। এটি বাবা মেয়ে অ্যানাবেলের জন্য লিখেছেন। প্রথমে তিনি তার বড় সন্তানের জন্য লিখতে চেয়েছেন, তবে তার জন্য গানের ঠিক লাইনগুলো খুঁজে পাননি তখন।