ঝরাপাতায় চলে সংসার!
প্রতি বছর মাঘ থেকে চৈত্র মাসে টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়াঞ্চলের গাছের ঝরাপাতা আশীর্বাদ হয়ে আসে কয়েক হাজার পরিবারের জীবনে। ঝরাপাতা কুড়িয়ে সংসার চলে অন্তত তিন হাজার পরিবারের।
মাঘ-চৈত্র মাসে গাছের ঝরে যাওয়া পাতা বিক্রি করে ওই সব পরিবারের শুধু আর্থিক চাহিটাই মিটছে না, এতে বনে আগুন লাগার আশঙ্কা কমছে। ফলে একদিকে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে। অন্যদিকে ওই সকল পরিবারগুলো খানিকটা অর্থিক সুবিধা পাচ্ছে।
টাঙ্গাইল জেলাসহ দেশের জামালপুর জেলার দক্ষিণ অংশ, নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা উপজেলা ও গাজীপুর জেলার বনভূমি নিয়ে মধুপুর গড় অঞ্চল গঠিত। গড়াঞ্চলের উত্তর অংশ মধুপুর গড় ও দক্ষিণ অংশ ভাওয়াল গড় হিসেবে পরিচিত। টাঙ্গাইল বন বিভাগের আওতায় ৯টি রেঞ্জে ৩৪টি বিট, ৩ টি সামাজিক বনায়ন নার্সারী ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং ৯ টি সামাজিক বনায়ন কেন্দ্র রয়েছে।
মধুপুর গড়াঞ্চলে টাঙ্গাইল বন বিভাগের রেঞ্জগুলো হচ্ছে- টাঙ্গাইল সদর রেঞ্জ, ধলাপাড়া রেঞ্জ, হতেয়া রেঞ্জ, বহেড়াতলী রেঞ্জ, বাঁশতৈল রেঞ্জ, অরণখোলা রেঞ্জ, মধুপুর রেঞ্জ, দোখলা রেঞ্জ ও মধুপুর জাতীয় উদ্যান সদর রেঞ্জ। এরমধ্যে মধুপুর গড়াঞ্চলের মির্জাপুর, সখীপুর, কালিহাতী, ঘাটাইল ও মধুপুর উপজেলায় প্রাকৃতিক ও সৃজিত উডলট বাগান রয়েছে। মধুপুর ও ঘাটাইল উপজেলার প্রাকৃতিক বনে সবচেয়ে বেশি শাল-গজারী ও সেগুন গাছ পাওয়া যায়।
ষড়ঋতুর এ ব-দ্বীপে বঙ্গীয় মাঘ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত এতদাঞ্চলের আবহাওয়া এক প্রকার নাতিশীতোষ্ণ থাকে। শীতের পিঠা-পায়েসের পর বাঙালি হৃদয়ে বসন্ত দোলা দেয়। বনের গাছ-গাছালি পাতা ঝড়িয়ে নবরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ওই ঝড়েপড়া পাতাগুলোই প্রায় তিন হাজার পরিবারের যাবতীয় খরচ মেটাচ্ছে।
মধুপুর গড়ের জয়নাগাছা, পীরগাছা, চুনিয়া, ফেকামারী, লুহুরিয়া, অরণখোলা, কামারচালা, সানিয়ামারী, ভুটিয়া, গাছাবাড়ি, ফুলমালিরচালা, বাঁশতৈল, কাকড়াজান, যোগীরকোফা, বহেরাতলী, ঝড়কা, ঘোড়ামারা, দেওপাড়া, ধলাপাড়া, চৌরাসা, বটতলী ইত্যাদি এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নিম্ন আয়ের মানুষরা ভোর থেকে বিকাল পর্যন্ত শাল-গজারী গাছের ঝড়াপাতা সংগ্রহ করছেন।
ঘোড়ার গাড়ি ও ভটভটিতে করে এসব পাতা পরিবহন করা হয়। প্রতি গাড়ি ঝরাপাতা আটশ থেকে বারশ টাকায় বিক্রি হয়। আনারাস চাষিরা মূলত এই পাতার ক্রেতা।
আনারস চাষি আবুল কালাম, মজিবুর রহমান মেম্বার, আব্দুল লতিফ ও রহমান মিয়াসহ অনেকেই জানান, জমিতে আনারসের চারা লাগানোর পর মাটির আদ্রতা রক্ষা ও আগাছা গজানো রোধ করতে বনের ঝড়াপাতা বিছিয়ে দেওয়া হয়।
মধুপুর চুনিয়া বন থেকে পাতা সংগ্রহকারী মফিজুল ইসলাম জানান, তার বাড়ি মধুপুর উপজেলার শোলাকুড়ি গ্রামে। মাঘ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত কোন কাজ না থাকায় তিনি বন থেকে ঝরাপাতা সংগ্রহ করে আনারস চাষিদের কাছে বিক্রি করেন। প্রতিদিন তিনি এক গাড়ি পাতা সংগ্রহ ও সরবরাহ করতে পারেন।
হাতিমারা গ্রামের আমির হোসেন জানান, অভাবের কারণে লেখাপড়া করাতে পারেন নি। বছরের অন্য সময় তিনি দিনমজুরের কাজ করেন। মাঘ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত বনের ঝরাপাতা সংগ্রহ করে বিক্রি করেন।
সোনাতন গ্রামের বাদশা মিয়া জানান, তিনি পেশায় দিনমজুর। তার মেয়ে এইচএসসিতে পড়ালেখা করে। মেয়ের পড়ালেখা ও সংসারের খরচ যোগাতে তিনি বন থেকে পাতা সংগ্রহ ও বিক্রি করছেন।
তিনি আরও জানান, ঝড়াপাতা সংগ্রহ করতেও পুরো মৌসুম অর্থাৎ মাঘ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত বন বিভাগের কমিউনিটি ফরেস্ট ওয়ার্কারদের (সিএফডব্লিউ) আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা নগদ দিয়ে বনে ঢুকতে হয়। টাকা না দিলে কাউকে বনের পাতা সংগ্রহ করতে দেওয়া হয় না। প্রতিবাদ করতে গেলে বন আইনে মামলা দেওয়ার ভয়-ভীতি দেখানো হয়।
মধুপুর দোখলা রেঞ্জ অফিসার ইসমাইল হোসেন পাতা সংগ্রহকারীদের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বনের গাছ রক্ষায় ঝরাপাতা সরানো প্রয়োজন। তাই পাতা সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার প্রশ্ন অবান্তর।
তিনি আরও বলেন, বনের ঝরাপাতায় আগুন দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কাঠ চোর চক্র বনের গাছ কেটে নিয়ে যায়। ঝড়াপাতা সরিয়ে নিলে আগুন দিতে পারে না। তাই তারা স্থানীয়দের পাতা সংগ্রহে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। তারপরও মাঝে মাঝে চোরের উপদ্রপ লক্ষ করা যায়।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদুর রহমান জানান, পাতা বনাঞ্চলে অনেক উপকারে আসে। পাতা পঁচে জৈব সার সৃষ্টি হয়, যা বনে চারাগাছ জন্মাতে সাহায্য করে। তবে ঝরেপড়া পাতা বিক্রি করে কিছু মানুষের উপকারও হচ্ছে।
কেএফ/