অভাবে মোড়ানো এক নারীর জীবন
ভারতের বিখ্যাত নারী প্রযোজক গুনিত মঙ্গা তার দেশকে দুটি অস্কারটি এনে দেওয়ার গৌরবে ভাসছেন। স্বল্পদৈর্ঘ্য শাখায় এবার তার নির্বাহী প্রযোজিত ‘দ্যা এলিফেন্ট হুইসপারস’ অস্কার নিয়ে ফিরেছে। এই ছবিটিতে আরো টাকা ঢেলেছেন-পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার কার্তিকি গনজালভেস, দুগলাস ব্লুস ও অচিন জৈন।
৩৯ বছরের প্রযোজক গুনিতের একই শাখায় ‘প্রিয়ড: এন্ড অব সেনটেন্স’ একই রকম নির্বাহী প্রযোজনার সূত্রে ৯১তম অস্কারে, ২০১৮ সালে সেরা প্রামাণ্যচিত্রের অস্কার জয় করেছে। তবে জীবন কখনো ফুলের পাপড়ি বেছানো ছিল না গুনিতের জন্য। ভয়াবহ দু:স্বপ্নের মতো মেয়েবেলা কেটেছে। সম্পত্তি নিয়ে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বিবাদ থাকায় সেগুলো ভোগ করতে পারতেন না তারা। ফলে এক রুমের একটি পাঞ্জাবি ঘরে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের কষ্টের জীবন বেছে নিতে হয়েছে তার বাবা-মাকে। মাকে এত দমন ও নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে যে, একবার মামারা গুনিতের মাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে চেষ্টা করেছিল। তারপর তারা বাড়ি ছেড়ে পালালেন। এরপর থেকে তাদের ধার করে, করে জীবনযাপন করতে হয়েছে। অভাবের কোনো সীমা ছিল না। তারা আর পাঞ্জাবে নয়, দিল্লীতে থাকতেন।
গুনিত বলেছেন, ‘বাইরের বিশ্বের কাছে আমরা একটি সুখী পরিবার হিসেবে ছিলাম। তবে কেউই জানতেন না, দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পর আমাদের পরিবারে কী ঘটত? একটি বড় বাড়িতে একটি ঘর নিয়ে আমরা থাকতাম। ভাইদের সঙ্গে সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে আমার মাকে যুদ্ধ করে যেতে হয়েছিল। তারা তাকে নিপীড়ন করেছিলেন। আমার মনে পড়ে, একবার তাদের ঝগড়া বিবাদ এমন অবস্থায় পৌঁছালো যে, মামারা মাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে চেষ্টা করলেন। এরপর আমার বাবা পুলিশকে ডেকে নিয়ে আসলেন ও আমাদেরকে খাবলে নিয়ে নিলেন এবং তারপর আমাদের সবাইকে নিয়ে দৌড়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলেন।’
একটি নতুন বাড়িতে ওঠার পর এই পরিবারের সদস্যরা তাদের জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু করলেন। একানেও তাদের স্বপ্ন দেখানোর নায়িকা তার মা। তিনি নীচতলায় তিনটি শোবার ঘরের একটি বাসার স্বপ্ন দেখে বেড়াতেন। মায়ের এই স্বপ্নকে সত্যি করতে ১৬ বছর বয়স থেকেই গুনিত মঙ্গাকে কাজে নামতে হলো। তিনি বলেছেন, ‘আমরা আমাদের জীবনকে নতুনভাবে তৈরি করেছি। আমি মায়ের জন্য তিনটি পা দিলেই বাসায় ঢুকে পড়া যায় ও তিনটি শোবার ঘর আছে এমন একটি বাড়ি বাড়ি কিনে দেবার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। ফলে তখন থেকে আমাকে কাজে নামতে হয়েছিল। বিদ্যালয়ের লেখাপড়াকে ব্যালেন্স করতে হয়েছে ও রাস্তায়, রাস্তায় ঘুরে আমি পনির বিক্রি করতাম। কখনো একজন ঘোষক, কখনো বিক্রেতা, কখনো একজন ডিজে। কলেজে ভতি হওয়ার পর থেকে আমি মুম্বাইতে আসতে শুরু করলাম যেন ছবিতে কাজের সুযোগ পাই। একজন সমন্বয়ক বা কো-অর্ডিনেটর হতে চেয়েছিলাম ফিল্মে, এরপর একজন প্রডাকশন ম্যানেজার। যাই আমি আয় করতাম না কেন, আমার বাবা-মাকে আমাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য দিয়ে দিতাম।’
ধীরে, ধীরে কিছু টাকা জমানোর পর এই পরিবারটি তাদের স্বপ্নটিকে আসলেই সফল করতে পেরেছিল। তারা একটি বাড়ি কেনার জন্য বায়না করেছিলেন। তবে যখন বাড়িটি তাদের হাতে তুলে দেওয়ার সময় হলো, এর ছয় মাসের ব্যবধানে গুনিত মঙ্গা তার বাবা ও মাকে হারিয়েছেন। তার মায়ের গলায় ক্যান্সার হয়েছিল। বাবা মারা গিয়েছেন কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ায়। এরপর তার হৃদয় ভেঙে গেল ও পুরোপুরিভাবে মুম্বাইতে চলে এলেন। একটি পুরোপুরি বদলে যাওয়া জীবনের সন্ধানে তিনি নিজের ব্যাগগুলো গোছালেন এবং বাড়িটি বিক্রি করে দিলেন। তারপর টাকাগুলো নিয়ে বম্বেতে কাজ করতে চলে এলেন। নিজের জন্য সিনেমাতে শক্তি খরচ করার স্বপ্নটি বাতিল করে দিলেন ও এরপর থেকে তার পরিচালকদের স্বপ্নগুলোই হলো তার স্বপ্ন। সবসময় তাকে নিজের শক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়েছে ও প্রতিদিন গড়ে ৪ ঘন্টা মোটে ঘুমাতে পারতেন। তখনো তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল সিনেমা বানানোর স্বপ্নই। কেননা, এই কাজটিকে তিনি সবসময় ভালোবাসতেন। তবে কাজটি তার জন্য কোনোদিনও সহজ ছিল না। দর্শক-তহবিল যোগাড় থেকে আন্তর্জাতিক বিক্রিগুলোর প্রতিটিতে তিনি তার মুখে একটি হাসি নিয়ে সমস্যাগুলোর মোকাবেলা করেছেন। তবে সবসময় একটিই অভাবে ভুগেছেন, সেটি হলো, তার পিতামাতার প্রশংসা ও তাদের অনুপস্থিতি।
গুনিত মঙ্গা বলেছেন, ‘আমি এখনো মনে করতে পারি, আমার বাবা তার স্বর্ণের খাদা বা শিখ পুরুষদের ধর্মীয় হাতের বালাটি বিক্রি করে দিলেন আমাকে বিদ্যালয়ের হয়ে প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যেতে। এর কারণটি হলো, তিনি আমাকে বিশ্বটি দেখাতে চেয়েছিলেন। কোনো ব্যাপারই ছিল না তারা কীভাবে এরপর সমস্যাগুলোর মোকাবেলা করেছেন দুজনে। ফলে আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময়গুলো-যেগুলো এসেছে ‘অস্কার’-উৎসবগুলোতে বা যখন আমরা ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ এবং ‘দি লাঞ্চবক্স প্রযোজনা করেছি বা যখন নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি চালু করেছি (অচিন জৈন’র সঙ্গে মিলে তিনি তাদের ‘শিখিয়া এন্টারটেইমেন্ট’ শুরু করেছেন ২০০৮ সালে), সবসময়ই আমার চাওয়া ছিল বাবা-মা পেছনে আছেন।’
ওএফএস/এএস