‘পদ্মা সেতু’ দেশের অর্থনীতির নতুন লাইফ লাইন
সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে প্রমত্তা পদ্মার বুকে নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ জেলা তো বটেই বাংলাদেশের অর্থনীতির নতুন লাইফ লাইন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হচ্ছে আজ। যা দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে বড় ভূমিকা রাখবে।
প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের দেশের অন্যতম বড় যোগাযোগ অবকাঠামো স্বপ্নসারথি পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে পাল্টে যাবে দেশের অর্থনীতি। আমূল পরিবর্তন আসবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায়। ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ হবে ব্যবসা-বাণিজ্য। গড়ে উঠবে শিল্প কারখানা। সমৃদ্ধির পথে হাঁটবে বাংলাদেশ। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ যাবে অনন্য উচ্চতায়।
পদ্মা নদীর কারণে রাজধানীর সঙ্গে ঢাকা বিভাগেরই পাঁচটি জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল বছরের পর বছর। শুধু ঘণ্টার পর ঘণ্টা নয়, দিনও পার হয়ে গেছে পদ্মা নদী পাড়ি দিতে। ইচ্ছা থাকলেও অনেকে বাবা-মা থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজনের চিকিৎসা করাতে পারেননি নদী পারাপারের বিড়ম্বনায়। অর্থনৈতিক ক্ষতিও কম হয়নি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘পদ্ম সেতু শুধু একটি সেতু না এটি হচ্ছে সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে নতুন করে চেনার পথ। দেশের সক্ষমতা জানান দেওয়ার আওয়াজ। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে তথা অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটবে। কারণ ঢাকা বিভাগের জনগণই আগে দিনের মধ্যে রাজধানীর সুফল পেত না। খুলনা ও এর আশপাশের জেলায় রপ্তানিমুখী বড় শিল্পকারখানা নেই। যাতায়াত সহজ না হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যেও অনেক পিছিয়ে ছিল। কিন্তু পদ্মা সেতুর আশির্বাদে শুধু দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলা নয়, সারা দেশ এর সুফল পাবে। কৃষকের ফসল আর পচবে না। কৃষকের উৎপাদিত ফসলসহ মাছ, চাল, মৌসুমি ফল সহজেই রাজধানীসহ অন্যান্য জেলায় পৌঁছবে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে নৌপথে ঢাকায় আসতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাজধানীতে পৌঁছে যাবে। কৃষক পণ্যের ন্যায্য দাম পাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ মানুষ দিনের মধ্যেই কাজ শেষে বাড়িতে ফিরতে পারবে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন বন্দর, অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণও হবে। এ জন্য দক্ষিণাঞ্চলে ইতোমধ্যে জমির দাম অনেক দাম বেড়ে গেছে। দ্রুত শিল্পায়ন হবে। এভাবে বিভিন্নভাবে অবদান রাখবে পদ্মা সেতু। উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডের কারণে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রায় ২ শতাংশ অবদান রাখবে। সারা বাংলাদেশ হাতের তালুতে আসবে।’
ব্যবসা-বাণিজ্যে অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে পদ্মা সেতু। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পথ দেখাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারের সুযোগ করছে। এই বাণিজ্য শুধু দেশে নয়, অন্যান্য দেশের সঙ্গেও যুক্ত হওয়ার পথ দেখাচ্ছে। বাড়বে রপ্তানি। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান। বেকারত্ব ঘুচবে কয়েকগুণ। শিল্প কারখানার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করবে কৃষি নির্ভর অর্থনীতিও।
অর্থনীতিবিদরা আগেই গবেষণা করে দেখেছেন পদ্মা সেতু চালু হলে ব্যাপকভাবে কর্মচাঞ্চল্য গড়ে উঠবে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রায় ২ শতাংশ অবদান রাখবে। পদ্মা নদীর কারণে বছরের পর বছর দেশের একটা বড় জনগোষ্ঠী বঞ্চিত ছিল সবরকম সুযোগ সুবিধা থেকে। সেটি এখন দূর হয়ে গেছে। একসময় যেমন উত্তরবঙ্গ বিচ্ছিন্ন ছিল। কিন্তু যমুনা নদীতে সেতু নির্মাণের পর উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবনযাত্রার মান যেমন বেড়েছে, আর্থসামাজিক অবস্থা পরিবর্তন হয়েছে, ঠিক তেমনি শিল্পায়নে বিপ্লব ঘটেছে দেশের উত্তরজনপদে।
পদ্মা সেতু নির্মাণ হওয়ার ফলে একই চিত্র দেখা যাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতেও। এই অঞ্চলে আগামী কয়েক বছরে শিল্পায়নে বিপ্লব ঘটবে। মানুষের কর্মযজ্ঞ বাড়বে। এক কথায় পদ্মার ওই পারের ২১ জেলার অর্থনীতি যেমন বদলে যাবে, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও বড় পরিবর্তন আসবে।
যশোরের বেনাপোল ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থল বন্দর দেশের অর্নীতির চাকা সচল করতে কয়েকগুণ সক্রিয় হয়ে উঠবে। একইভাবে মোংলা ও পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্রবন্দরও অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে।
আশা করা হচ্ছে, পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিপণ্য সহজেই ঢাকায় পৌঁছবে। এতে করে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের সকল জেলায় কৃষিপণ্যের সরবরাহ বাড়বে। কৃষিপণ্যের দামও সাধারণের নাগালের মধ্যে থাকবে। কৃষকরাও তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবে। এতে করে অর্থনীতির চাকা দ্রুতগতিতে ঘুরবে।
পদ্মা সেতু শুধু দেশীয় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বা দেশের অন্যান্য জেলার অর্থনীতে ভূমিকা রাখবে না, বৈদশিক মুদ্রা অর্জনেও বড় ভূমিকা রাখবে। এই সেতুর কারণে ভারতে, নেপাল, ভুটানসহ আশপাশের দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে বড় ভূমিকা রাখবে এমনটাই মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। পদ্মা সেতুতে যখন রেল লাইন চালু হবে এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রেল যোগাযোগ সহজ হয়ে উঠবে তখন আরও বেশি সুবিধা পাওযা যাবে।
পদ্মা সেতুর স্বপ্নসারথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে বলেছেন, ‘পদ্মা সেতুকে ঘিরে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক গড়ে তোলা হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য একটি জায়গা খোঁজা হচ্ছে।’
পদ্মা সেতুর ফলে বাংলাদেশের যে সামর্থ্য সেটা বিশ্বে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরবে। এই সেতু ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে মোটর পরিবহন কানেকটিভিতে আছে। এশিয়ান হাইওয়ে ও রেললাইন লিংকেও যুক্ত হবে। এর পরিচিতি কেবলমাত্র যে বাংলাদেশে থাকবে তা না, আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক পর্যায়ে চলে যাবে। এর গুরুত্ব বিশ্বেও যাবে। পর্যটনেরও অপার সম্ভাবনা।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটানো পদ্মা সেতু যেমন রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর দূরত্ব কমাবে, তেমনি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনেও রাখবে বড় ভূমিকা। এই সেতুর কারণে পদ্মার ওই পারের পর্যটন শিল্পেও বড় পরিবর্তনের প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। পর্যটকদের কাছে এখন পর্যন্ত বিশ্বের একমাত্র ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন আর সাগরকন্যা কুয়াকাটা অন্যতম পর্যটন স্পট। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজারকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে বড় একটি পর্যটন স্পট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে টুঙ্গিপাড়া। সেখানেও অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলোর বাইরে আরও বহু পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে যেগুলো এখনও পর্যটকদের কাছে ওইভাবে প্রকাশ পায়নি। পদ্মা সেতুর কারণে অন্ধকারে থাকা পর্যটন স্পটগুলো আলোকিত হবে। গড়ে উঠবে কর্মসংস্থান। অর্থনৈতিক বাঁক বদলে রাখবে গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা।
যাত্রাপথের বিড়ম্বনা দূর হওয়ায় এখন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলমুখী হবেন দেশি-বিদেশি পর্যটকরা। সহজেই যেতে পারবেন সুন্দরবন, কুয়াকাটা, বঙ্গবন্ধুর মাজার, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা কিংবা অন্যান্য জেলার পর্যটন স্পটগুলোতে। অর্থনীতির পরিবর্তনে এসব পর্যটনস্পটগুলো হয়ে উঠবে বড় সম্ভাবনাময় খাত।
এনএইচবি/এসএন