তুরাগ পাড়ে মর্ডান কন্টেইনার রেস্তোরাঁ ‘ক্যাফে রিভার ফ্রন্ট’
প্রকল্পটির আর্কিটেকচারাল ডিজাইন। ছবি: শেখ মোহাম্মদ রেজওয়ান
তুরাগ নদীর পাড়ে বিরুলিয়া ব্রিজের ধারে চল্লিশ ফুট দীর্ঘ, আট ফুট চওড়া আর সাড়ে ৯ ফুট উঁচু- এমন ১৪টি কন্টেইনার দিয়ে তৈরি হয়েছে ক্যাফে রিভার ফ্রন্ট। জায়গার আসল মালিক পানি উন্নয়ন বোর্ড। তাদের থেকে লিজ নিয়ে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় সবুজ ছায়াময় জনপরিসর হিসেবে গড়ে তুলছে।
আরো কিছু পরিকল্পনায় আছে ড্যাফোডিলের। যেমন ইনোভেশন সেন্টার, ক্র্যাফট ডিসপ্লে সেন্টার গড়ে তোলার পরিকল্পনা। তবে আপাতত ১ ডিসেম্বর থেকে রেস্তোরাঁটি পরীক্ষামূলকভাবে (সফট লঞ্চিং) চালু করা হবে। এর দক্ষিণদিকে এর প্রবেশদ্বার, উত্তরদিকে নদী কিছু দূরে তবে পশ্চিম দিক একেবারেই নদী ঘেঁষা, মিরপুর-আশুলিয়া রাস্তাটি পূব পাশে। হালকা শীতের শুরু হলেও উত্তরে হাওয়া ভিতরে ঠান্ডা , নদী ছুঁয়ে আসা পশ্চিম দিকের হিমেল বাতাসও ছড়িয়ে যাচ্ছে।
সিমেন্ট, কংক্রিট, ইট দিয়ে যে স্থাপনা তৈরি হয় তাতে পানির ব্যবহার হয় পর্যাপ্ত পরিমাণে, আর কন্টেইনারের মতো উপকরণ দিয়ে তৈরি স্থাপনাগুলো হয় শুষ্ক। এতে ব্যাপক হারে ঝালাই বা ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করা হয়। শীতপ্রধান দেশগুলোতে কন্টেইনার স্থাপনা অনেক জনপ্রিয়। এর প্রধান কারণ দ্রুত এবং স্বল্প খরচে একে বাসযোগ্য করে তোলা যায়।
শীতপ্রধান দেশে দুইজনের একটি পরিবারকে দেখা যায় বনের কাছে, জলাশয়ের ধারে একটি কন্টেইনারেই বাসা বানিয়ে ফেলেছে। বড় সুবিধা এর দেয়াল, ছাদ ও দরজা পাওয়া যায় রেডিমেড। স্থাপনাটি লোহা দিয়ে তৈরি বলে এগুলো দিনের তাপ ভিতরে বেশি ধরে রাখতে পারে আবার বাইরের ঠান্ডাও কম ঢোকায়। আমাদের দেশে অবশ্য এটাই বড় প্রতিবন্ধকতা।
কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা রেস্তোরাঁর মেহমানদের কাছের গোলাপগ্রাম বা বিরুলিয়া জমিদার বাড়ি অথবা ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরিয়ে আনার।
রেস্তোরাঁটি পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হুমায়ুন কবীর। তিনি বলেন, 'আমরা একে কেবল একটা খাওয়ার জায়গা হিসেবে গড়ে তুলছি না, আমরা চাই দিনভর গেস্টরা এখানে অবসর যাপন করুক, ফেরার সময় মনে রাখার মতো স্মৃতি নিয়ে ফিরুন। তা হতে পারে মাছ ধরা বা সবজি চাষ। কাস্টমার নয়, আমরা চাইছি গেস্ট। একটি পরিবারে বৃদ্ধ, মাঝবয়সী, নারী ও পুরুষ এবং শিশুরাও থাকে। প্রত্যেকের জন্যই এখানে কিছু না কিছু থাকবে। সবারই অবসর-বিনোদনের জায়গা করে তোলার চেষ্টা রাখব আমরা।'
শেখ মোহাম্মদ রেজওয়ান ২০১২ সালে বুয়েট থেকে বিআর্ক (ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার) সম্পন্ন করেন। তারপর যোগ দেন স্টেট ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগে। একইসঙ্গে কয়েকজন সহপাঠী ও বন্ধু মিলে গড়ে তুলেন একটি স্থাপত্য চর্চা প্রতিষ্ঠান বা আর্কিটেকচার ফার্ম। প্রথম দিকে আবাসিক ভবনেরই নকশা করতেন। দুই বছর পর তিনি যোগ দেন ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচারে।
প্রকল্পটির সাথে শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে যুক্ত ছিলেন। প্রকল্পটিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে দুইজন ইন্টার্নশিপ করেছিলেন। শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিতে ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে তাদেরকে যুক্ত করা হয়েছিল।
এ প্রকল্পটির তত্ত্বাবধানে ছিলেন জয়েন্ট ডিরেক্টর (প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট) নাজিম উদ্দিন সরকার, স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের সাথে যুক্ত ছিলেন সিনিয়র সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ফয়সাল আহমেদ এবং ইঞ্জিনিয়ার মেহেদী হাসান মজুমদার।
ড্যাফোডিল বিশ্বের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও আন্তর্জাতিক কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত। বিশ্ব ততদিনে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং তার প্রভাব নিয়ে সরগরম, সচেতনতাও বাড়ছিল ক্রমে ক্রমে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠার নীতি গ্রহণ করে। তাই যখন বিরুলিয়ায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়, বিশ্ববিদ্যালয়টি তাতে পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও নবায়নযোগ্য উপকরণ দিয়ে স্থাপনা তৈরির প্রয়াস নেয়।
ফলাফলে কন্টেইনার হাউজ এবং কন্টেইনার দিয়ে তৈরি একটি ছাত্রী হোস্টেল প্রতিষ্ঠিত হয়। রেজওয়ান ও তার বন্ধু স্থপতি আজকা ইশিতা এর মধ্যে নীলফামারী উপজেলা পরিষদের শিশু পার্ক তৈরির দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তারা গতানুগতিক চিন্তার বাইরে গিয়ে এখানে টায়ার দিয়ে বিভিন্ন রাইড গড়ে তুলেন।
প্রকল্পটির বিষয়ে শেখ মোহাম্মদ রেজওয়ান বলেন, আমরা পৃথিবীতে অনেক প্রোডাক্ট ব্যবহার করার পর আবার প্রকৃতিতে ছেড়ে দিচ্ছি। আমাদের প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য ছিল অব্যবহৃত ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার উপযোগী করে তোলা এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য সামঞ্জস্য রাখা। আমাদের প্রকল্পটিতে একটি ব্রিক ফাউন্ডেশন করে স্লাব কাস্টিং করে কন্টেইনার গুলোকে ব্যবহারের উপযোগী করেছি। কন্টেইনার গুলোকে ওয়েল্ডিং এর মাধ্যমে সংযুক্ত করেছি। এখানে জানালা এবং দরজা গুলো আশেপাশের প্রাকৃতিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে কাঠামো সাজিয়েছি। ওয়েদারের উপরে ভিত্তি করে প্রকল্পটির ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্ট করা হয়েছে।
এ দেশে কন্টেইনার স্থাপনা জনপ্রিয় হওয়ার একটি কারণ সরকারি অনেক জমি বেকার পড়ে থাকা। সরকারের কাছ থেকে লিজ নেওয়া জমিতে যেহেতু স্থায়ী কাঠামো গড়া যায় না তাই কন্টেইনার হাউজ একটি ভালো বিকল্প। আড়াই মাসের মধ্যে ফাউন্ডেশন ছাড়াই এ দিয়ে স্থাপনা তৈরি করে ফেলা যায়।
রেস্তোরাঁ কাজে না এলে রেস্ট হাউজে পরিবর্তন করে নেওয়াও কঠিন কাজ নয়। মেগা মল বা মিলনায়তন হিসেবেও ব্যবহার করা চলবে। আমাদের দেশে একাধিক সমুদ্র বন্দর আছে। কন্টেইনার প্রয়োজনীয় সংখ্যায় পাওয়াও কঠিন নয়। সেগুলো অব্যবহৃত পড়ে থাকলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। কন্টেইনার পাওয়া যায় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকায়। কেবল খেয়াল রাখা দরকার চোরা ফাটল আছে কি না আর তা পরীক্ষা করার জন্য বর্ষাকালই উপযুক্ত সময়।
এছাড়াও তিনি (শেখ মোহাম্মদ রেজওয়ান) রেস্তোরাঁটি সবাইকে ঘুরে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান।